বাহন বদলালে আরোহীর চোখে পড়ে ভিন্ন অনিয়ম!

শামস্ রহমানশামস্ রহমান
Published : 7 August 2018, 02:03 PM
Updated : 7 August 2018, 02:03 PM

আমি ঢাকায় ছিলাম গত সপ্তাহে। তখন নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন চলছিল। আমার একাশি বছরের মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম উত্তরায় ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। ফেরার পথে ভর দুপুরে জসিমউদ্দিন রোডের মাথায় আটকা পরি প্রায় আড়াই ঘণ্টার জন্য। সম্প্রতি বাসচাপায় যে দুজন শিক্ষার্থী মারা গেছে তাদের বাবা মায়ের সন্তানহারার যে বেদনা তার তুলনায় আমার বৃদ্ধা অসুস্থ মায়ের রাস্তায় অপেক্ষার কষ্ট তেমন কিছুই নয়।

সন্ধ্যায় এক গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর সাথে দেখা। বললেন – শিপমেন্ট জনিত কারণে তার ব্যবসার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সমাজে এভাবে আরও অনেকেই আরও অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও হতে পারে। তবে, ভবিষ্যতের সড়ক নিরাপত্তার কথা ভেবে সাময়িকের জন্য এটুকু কষ্ট স্বীকার করে  নিতেই হবে।

যে কোনও সিস্টেমের মত সড়ক পরিবহনও একটা সিস্টেম। সাধারণত একটা সিস্টেম পরিচালিত এবং প্রভাবিত হয় কিছু সংখ্যক 'অ্যাক্টর' দ্বারা। তেমনিভাবে সড়ক পরিবহন সিস্টেমও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিচালিত ও প্রভাবিত হয় অসংখ্য 'অ্যাক্টর' দ্বারা। যেমন, রাস্তা-ঘাটের হাল, যানবাহনের ফিটনেস,  রাস্তায় যানবাহনের মোড় (যেমন, অযান্ত্রিক ও যান্ত্রিক – রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, মোটর গাড়ি, ট্রাক, বাস ইত্যাদি), যানবাহনের চালক ও মালিক, শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রাফিক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়; সর্বোপরি পথচারী এবং যানবাহনের আরোহী। এসব বা এরা সকলে প্রত্যক্ষ 'অ্যাক্টর'। এগুলোর বাইরে আরও 'অ্যাক্টর' আছে যা বা যারা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে আমাদের সড়ক পরিবহন সিস্টেম। নিঃসন্দেহে এটা একটি জটিল সিস্টেম।

সিস্টেম যখন ঠিকভাবে কাজ করতে অপারগ, তখন সিস্টেমের সবাই সবাইকে অবিশ্বাস করে এবং দোষারোপ করে। যেমন, আমি দেখেছি বাস-ট্রাকের চালককে বেপরোয়াভাবে চালাতে, তেমনি দেখেছি আরোহীদের তাগাদা দিতে গাড়ি দ্রুত চালাতে। কেউ যখন টয়োটায় চেপে চলে, তার কাছে মনে হয় –

  • 'রিক্সা চলে অনিয়মে, যত্রতত্র।
  • ঠিক রাস্তার মোড়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকে যানবাহন। সৃষ্টি করে প্রতিবন্ধকতা।
  • পথচারী সড়ক পাড় হয় সড়কের যেখানে সেখানে, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে।
  • এমনকি, বিপদ জেনেও দ্রুতগামী গাড়ির সামনে হাত তুলে রাস্তা পার হবে, তবুও ব্যবহার করে না পাশের ওভারব্রিজ।
  • অযথা বাস চলে দ্রুত বেগে।
  • অনির্ধারিত স্থানে এবং রাস্তার মাঝখানে থামিয়ে যাত্রী তোলে।
  • ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ অপারগ।

আবার সেই একই ব্যক্তি যখন রিক্সার আরোহী, তখন তিনি মনে করেন –

  • 'যান্ত্রিক গাড়িগুলো ভয়ানক। চলে বেপরয়া।
  • পথচারী ফুটপাত রেখে অযথাই রাস্তায় হাঁটে।
  • বাস-ট্রাক চলে বেপরোয়া, দিগ্বিদিক ছাড়া।
  • অকারণেই রিক্সাচালককে ট্রাফিক পুলিশ বিরক্ত করে।

একইভাবে আবার সেই ব্যক্তি যখন পায়ে হাঁটেন, তখন তার কাছে মনে হয় –

  • রকমারি হকার দোকানের ভিড়ে ফুটপাত হাঁটার অচল
  • রাস্তার ধার দিয়ে পার্কিং করা যানবাহন ও রিক্সার ভিড়। না যায় হাঁটা ফুটপাতে, না যায় রাস্তার ধার ঘেঁষে।
  • পথচারীদের রাস্তা পারাপারের অপর্যাপ্ত সুযোগ।

সেই একই ব্যক্তি যদি হয় ট্রাফিক পুলিশ, তার কাছে কি মনে হয়? সে দেখে –

  • প্রায় সব চালকই অপ্রশিক্ষিত অথবা অর্ধ-প্রশিক্ষিত, সে রিক্সারই হোক আর গাড়িরই হোক।
  • কোনওভাবে লাইসেন্স পেয়ে রাস্তায় নামে চালক বেশে।
  • অনিয়মের কারণে ধরলেই বলে – সুবিধা নিচ্ছি।
  • কথায় কথায় শ্রমিক ইউনিয়নের ভয় দেখায়।

সেই ব্যক্তি যদি হয় বাস-ট্রাকের চালক, সে কীভাবে দেখে? সে দেখে –

  • রাস্তার হাল সেই সাথে অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে বিলম্ব হওয়া।
  • ট্রিপের সংখ্যা কমে যাওয়া।
  • গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্বের কারণে যাত্রীদের অস্থিরতা।
  • মালিকের চাপ।
  • চাপের মুখে 'প্রায়' ফিট গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামা।
  • অনির্ধারিত জায়গায় পথচারীর রাস্তা পারাপার।
  • ট্রাফিক পুলিশের হয়রানি।
  • যত্রতত্র রিক্সা, স্কুটারের ছুটাছুটি।

এভাবেই চলে ব্লেইম-গেইম। এর জন্য কে দায়ী? এক কথায় সিস্টেম। আর আমরা যেহেতু সবাই এই সিস্টেমেরই অংশ, তাই আমরা প্রত্যেকেই দায়ী। তবে এটা সত্য, এই  সিস্টেমে সবাই যেহেতু সমান প্রভাবশালী নয়, তাই দায়িত্বও সমান নয়। যাদের প্রভাব বেশি, তাদের অ্যাকাউন্টেবিলিটি বেশি, সেই সাথে তাদের সড়কের নিরাপত্তার দায়িত্বও বেশি। নিঃসন্দেহে বলা যায় সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনার আশু উন্নয়ন অপরিহার্য।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার। আমাদের সড়ক পরিবহন সিস্টেমের 'অ্যাক্টর'দের মাঝে মাত্র দুটি বিষয় জড় পদার্থ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এক, রাস্তার হাল। দুই, যানবাহন। বাকি সবাই মনুষ্যজাতিসম্বন্ধীয়। শুধু দক্ষ চালক, ট্রাফিক পুলিশ বা নাগরিক হওয়াই যথেষ্ঠ নয়, আমাদের প্রত্যেকের সচেতন নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে হবে। কাজটি সহজ নয়। তবে, আজই হোক তার শুরু।

দেশটা আমাদের। দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার দায়ীত্বও আমাদের । ইতিমধ্যে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নয়টি দাবি মেনে নিয়ে তা সম্পাদন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার প্রধান। শিক্ষার্থীদের এবার ঘরে ফেরার সময়।

আমি তারণ্যে বিশ্বাসী। কারণ বিন্দুমাত্র খাদ থাকে না তারণ্যের বিশ্বাসে। বলাবাহুল্য, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বে। সম্প্রতি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চও জেগে উঠে তরুণ ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের সঠিক বিচারের দাবিতে সৃষ্ট হয় এ মঞ্চ, যার সব স্লোগানের শেষ স্লোগান – জয় বাংলা। আজকের নিরাপদ সড়কের দাবির নেতৃত্বেও ছাত্র সমাজ। তাদেরও একটি প্রধান স্লোগান – 'মুজিব কোটে মুজিবকেই মানায়, চামচাকে না'। 'জয় বাংলা' আর 'মুজিব' আমাদের জাতীয় ওরিয়েন্টেশনের অংশ, তাতে আমাদের প্রজন্ম বিশ্বাসী। দলমত নির্বেশেষে সমগ্র জাতি যত তাড়াতাড়ি জাতীয় ওরিয়েন্টেশন তথা '৭১ এর মূলধারায় বিশ্বাসী হয়ে উঠবে, জাতীয় সমস্যা সমাধানের পথ আরও সহজ থেকে সহজতর হবে।