ধন্যবাদ ও শুভকামনা

লুৎফুল হোসেন
Published : 5 August 2018, 12:04 PM
Updated : 5 August 2018, 12:04 PM

গত চার দশকে কোনো সরকার যেটা করতে পারেনি। প্রাপ্তবয়স্ক কোটি জনতা পারেনি। আমাদের সন্তান, নিষ্পাপ শিশু-কিশোররা, তা করে দেখিয়েছে। অনুন্মোচিত ও অনুচ্চারিত সত্য উন্মোচিত ও উচ্চারিত হয়েছে। এদেশের মানুষ ৪৭ বছরে এক দিনের জন্য যে শৃঙ্খলা রাজপথে আনতে পারেনি। শিক্ষার্থী সন্তানেরা তা করে দেখিয়েছে। জাগতিক পিছুটান আর স্বার্থের টানাপড়েন কোটি মানুষের হাতে পরিয়ে দিয়েছিলো যে অক্ষমতার শিকল, তা ধরে টান মেরেছে আমাদের উত্তর প্রজন্ম। আশাহীনতার আঁশটে গন্ধ যখন ছেয়ে ফেলেছিলো আমাদের পুরো পৃথিবী তখন বৃষ্টিস্নাত সবুজের বিস্তৃতি মেলে জীবন ও সম্ভাবনার আলো ছড়িয়েছে আমাদের সন্তানেরা।

রাজপথে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ তাদের আসল কাজ নয়। দেশের মানুষকে শৃঙ্খলা শেখানোও নয়। রাষ্ট্র পরিচালনাও নয়। তবু তারাই আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এই আমরা বড়রা যে রোজ রোজ তাদের ভালো হতে বলে হাজার বুলি কপচাই, সেই আমরাই জীবন যাপনে সত্যব্রতী নই। নিজের সঙ্গে সৎ নই। আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর পৃথিবী রেখে যাওয়ার বুলি আউড়ে মুখে ফেনা তুলি, কিন্তু সেই লক্ষ্যে করণীয়টুকু করি না। তাদের প্রতি দেখানো আমাদের যাবতীয় ভালোবাসাকে তাই আজ খুব সঙ্গতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ওরা।

ওরা হাতে নাতে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এদেশের সরকারী সংস্থা, নিয়ম নীতির নির্ধারক ও প্রয়োগকারীরাই পথে পথে নিয়ম না মানায় অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। তাদের বৈধ কাগজবিহীন বাহন ও চালক আইন অমান্য করার পাশাপাশি সরকারকে বঞ্চিত করেছে প্রাপ্য রাজস্ব থেকে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের ফলেই সর্বোতভাবে পুনরুন্মোচিত যে, গোটা গণপরিবহন খাত আজ মালিক সমিতি ও শ্রমিক সমিতির মাফিয়া চক্রের চাঁদাবাজি আর অরাজকতার কাছে জিম্মি। এই খাতে প্রতিদিন লেনদেন হয় একাধিক কোটি টাকার চাঁদা আর বখরার ভাগ। যার সামান্যতম পরিমাণও জোটে না সরকারী কোষাগারের ভাগে। আর এই অপকে সংঘটিত করবার হাতিয়ার হতে গিয়ে এক শ্রেণীর পরিবহন শ্রমিক পেয়ে গেছে হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধ অবলীলায় ঘটাবার বিকারহীন মানসিকতা ও দুঃসাহস।

চার দশকের ঘুণে ধরা এক জাতীয় সমস্যার রোগ নিরূপণ পর্বটি শিশুরা করে দিয়েছে। এবার এর নিরাময় করতে যে কাঠ-খড় আর সময় পোড়ানো লাগবে, তা খুব সামান্য নয়। বিষয়টা সব বুঝদার মানুষই উপলব্ধি করেন। এর সবটা সময় শিক্ষার্থীদের পথে থাকাটা আবশ্যক নয়। প্রক্রিয়ায় কোথাও সংকট বা সমস্যা উদ্ভূত হলে, তার সমাধানে উত্তর প্রজন্মকে আবার যদি আসতে হয়, সে সুযোগ জাতি তাদের করে দেবে নিশ্চিত। সেই আস্থা ও ভালোবাসা এই পাঁচ দিনে ওরা অর্জন করেছে।

একটা বিষয় স্পষ্ট যে সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিলো পথে পথে নির্বিচারে মানুষ খুন, এবং গণ ধর্ষণের মতো ঘটনা যখন পরিবহন শ্রমিকরা দিনের পর দিন অবলীলায় ঘটিয়ে যাচ্ছিলো। অথচ তাদের জবাবদিহিতার কোনো বালাই ছিল না, পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিক সমিতি দুটির আশকারার দৌরাত্ম্যে।

সমস্যা যখন চিহ্নিত এবং সমাধানের নানান উপায় নিয়ে খসড়া প্রস্তাবিত, তখন অপেক্ষা শুধু সময়ের। বিশেষজ্ঞ মত সম্পৃক্ত করে সমাধানের পথ ও পন্থা সুবিন্যস্ত ভাবে নির্দিষ্ট করা এবং তার বাস্তবায়নের জন্য সে সময়টুকু দিতেই হবে। অতএব আপাতত অমূল্য অর্জনের সাফল্য মালা গলায় নিয়ে শিক্ষার্থীরা এবার ঘরে ফিরুক, নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে ফিরুক এটাই সচেতন জনসমষ্টি এখন চাইছে। তাদের মিশন পারফেক্টলি একম্পলিশড্। হ্যা, তাদের পর্বের করণীয়টুকু তারা নির্ভুল ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করেছে। এবার পালা রাষ্ট্রযন্ত্রের।

এখানে একটা কথা খুব সহজভাবে স্পষ্ট ও দৃশ্যমান যে, বর্তমান 'নিরাপদ সড়ক চাই' ও 'পথে পথে দুর্ঘটনার নামে অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড ও অপরাধসমূহের বিচার চাই', দাবীগুলোর সুফলভোগের প্রথম পক্ষটি নিঃসন্দেহে সাধারণ জনগণ। তবে সুফলভোগের দ্বিতীয় পক্ষটি কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে জনতার প্রতিপক্ষ হিসেবে দৃশ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকার। হ্যা, এটাই নিরেট সত্য ও বাস্তবতা। কারণ পরিস্থিতি যতো বেশি নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে সাধারণের দুর্ভোগ বাড়বে এবং সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে। সরকারের ও দেশের বিরুদ্ধচারীরাও এই সুযোগে ততো বেশি বেসামাল হয়ে উঠবে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সে অনুপাতে নাজুক হবে। সরকারকে আরো বেশি বৈরি সময় পাড়ি দিতে হবে।

আমাদের বুঝতে ভুল করা চলবে না যে, উদ্ভূত সংকট সমাধানে সত্যিকারের প্রতিপক্ষরা হলো –

এক.  বছরে শত শত কোটি টাকার চাঁদা ও বখরার ভাগীদার মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলো এবং এর ভাগ পাওয়া অন্য সকল পক্ষ।

দুই.  ক্ষমতার বাইরের সকল রাজনৈতিক শক্তি, যারা কখনোই এ সমস্যার বিন্দুমাত্র সমাধান তো দূর, সত্য উন্মোচন বা উচ্চারণও কখনো করতে পারেননি। (তারা তাই আর কিছু করতে পারুক কি না পারুক, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুবিধা নিতে তৎপর হবে।)

তিন.  বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী সকল পক্ষ, যারা যে কোনো মূল্যে এদেশের ভালো কিছুই সইতে অক্ষম।

চার.  এতোদিন ধরে চলমান অব্যবস্থার বদৌলতে সরকারী কোষাগারের প্রাপ্য অর্থ ও এর বাইরে নানান পন্থায় জনগণের পকেট কাটা অর্থের আনুকূল্য ভোগ করতেন যেসব নীতি নির্ধারক, আইন প্রণেতা এবং তার প্রয়োগকারীরা। যাদের ফায়দা বন্ধ হয়ে যাবে নীতি সিদ্ধ প্রথা চালু হলে।

সত্যিকারের প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করতে পেরে ওঠার পাশাপাশি গোটা পরিস্থিতির চিত্রটাও স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। তখন প্রসঙ্গটির সম্ভাব্য সমাধান এবং করণীয়গুলো বুঝতে পারাটাও সহজতর হবে যা কারো কাছে।

নিরাপদ সড়কের দাবীকে ঘিরে আন্দোলনের সমস্যা নিরূপণ এবং সম্ভাব্য সমাধানের পথ নির্দেশনার পরও এখন শিক্ষার্থীরা যতো বেশি সময় রাজপথে অবস্থান করবে, সরকারকে সমস্যা সমাধানে মনযোগী হবার বদলে ততো বেশি ব্যস্ত থাকতে হবে পরিস্থিতির নাজুকতা নিয়ে স্পর্শকাতর ঘটনায় পতিত হবার আশঙ্কা থেকে তাদেরকে সামলে রাখতে। পাশাপাশি ফায়দার খোলা মিষ্টিতে বসতে উদগ্রীব সুবিধাভোগী মাছিরা ভন ভন করে চেষ্টা করে যাবে মিষ্টি নষ্ট করতে, রোগ-বালাই ছড়াতে।

শিক্ষার্থীদের ঘরে ও শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যাওয়াটা এখন যেমন জরুরী তেমনি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভূত সমস্যা  সমাধানের পথে সরকারের সঠিক এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া। সরকারের আশু পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ কি কি তার একটা খসড়া রূপরেখা তুলে ধরা যাক।

এক.  বৈধ নিবন্ধন ও ফিটনেস বিহীন গণপরিবহনের কোনো গাড়ি পথে নামবার সুযোগ চিরতরে বন্ধ করা।

দুই.  নিবন্ধনহীন চালককে স্টিয়ারিঙের পিছনে বসবার পথ মজবুত ভাবে রুদ্ধ করা।

তিন. বিদ্যমান প্রহসনের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ইতি ঘটিয়ে বাহন ও চালক উভয়ের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নিবন্ধন সনদ প্রদানের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।

চার.  গণপরিবহন খাতকে মালিক ও শ্রমিক সমিতির রাহুমুক্ত করে ভাড়া, সেবা এবং বাহনের যৌক্তিক ও জনবান্ধব সমন্বয় নিশ্চিত করা।

পাঁচ.  নগর পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী বিশ্বের শত শত শহরের সফল গণপরিবহন ব্যবস্থার আদলে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার আওতায় একটা বা দুটা গণপরিবহন সেবা সংস্থার অধীনে জনগনকে নায্যসেবা প্রদান নিশ্চিত করা।

ছয়.  নিয়ম ভঙের জন্য (আর্থিক ও পয়েন্ট কর্তনের মাধ্যমে লাইসেন্স বাতিলের প্রথা) এবং দুর্ঘটনার কারণে হতাহতের জন্য (হতের জন্য কোটি এবং আহতের জন্য মাত্রা বিবেচনায় পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার) বড় অংকের ক্ষতিপুরণের বোঝা মূলত মালিক এবং যৌক্তিক ভাবে চালকের উপর আরোপ করা। এর পাশাপাশি যথাযথ শাস্তির বিধানটিও চালু করা।

সাত.  ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাখতে এবং আইন মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ করতে আইন প্রয়োগকারী এবং মান্য করবার পক্ষ উভয়ের জন্য নিয়মিত কর্মসূচী রাখা। শাস্তি ও প্রণোদনার নীতি ঘোষণা এবং সত্তর চালু করা।

আট.  আইন প্রয়োগকারীদের অনিয়মের ক্ষেত্রে জোরালো শাস্তির বিধান রাখা। সেটা প্রয়োগের যৌক্তিক এবং ভ্রান্তিহীন পন্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।

নয়.  অপরাধ সংঘটনের সম্ভাব্য পক্ষ এবং বিচার প্রয়োগের পক্ষ, এই উভয় ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব রহিত করা।

দশ.  সরকারের পক্ষ থেকে যা পদক্ষেপ নেবার তা শীঘ্র আইন হিসেবে পাশ করে এবং তার যথাযথ প্রয়োগের নজির স্থাপন করে, দ্রুত শিক্ষার্থী ও আপামর জনতার আস্থা অর্জন করা।

খুব নিশ্চিত এইসব ঘিরে একটা শঙ্কা সরকারের ভেতরও জোর কাজ করছে। গত দুইদিনই পুলিশ তাই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের মাঝে এসে বারবার পরিচয়পত্র যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে কোনো অনুপ্রবেশকারীর আগমন না ঘটবার বিষয়টা।

পুলিশের পাশাপাশি এ আন্দোলনে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াবার আশঙ্কা আসলে পরিবহন শ্রমিকদের। কারণ মোটা দাগে তারা মূলতঃ শিক্ষিত ও সূক্ষ্ম বিবেচনাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী নয়। তারা মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর ঢাল বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। এতেই তারা অভ্যস্ত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের রুজি বিঘ্নিত হচ্ছে। এবং তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি যে সমিতির বংশবদ না হয়েই যথেষ্ট নিশ্চিত হতে পারতো, সে সত্য ও বাস্তবতা তাদেরকে বোঝাবার মতো কোনো পুরোহিত আজ আমাদের সমাজে বিদ্যমান নেই।

হ্যা, এ বাদেও ভয় আছে। যে সমস্ত আইনের পক্ষের লোককে আইন ভঙ্গ করবার অপরাধে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরা পড়ে হেনস্তা হতে হয়েছে, তারা কেউ কেউ প্রতিশোধ পরায়ন হলে ঠিক ঠিক তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা ছেলেপুলেদের খুঁজে বের করে প্রতিশোধ নিতে পারবে আগামীতে যে কোনো সময়। সরকারকে তার আপন স্বার্থেই দায়িত্ব নিতে হবে সব নেতিবাচক সম্ভাব্যতাকে নাকচ করে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার। এক্ষেত্রে কিছুমাত্র শঠতা বিপদজনক বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে, কথাটা সুস্পষ্টভাবে মনে রাখতে ও মানতে হবে সরকারকে।

শ্রেণি বা গোষ্ঠীভিত্তিক এইসব সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হবার আগেই অবস্থা সামাল দিতে না পারলে তার মূল্য অনেক অনেক বেশি ও বেদনার হয়ে দাঁড়াবে। তেমন কিছু হবার আগেই ঘটনা যৌক্তিক খাতে প্রবাহিত হওয়া জরুরী। এজন্যে সবার আগে আন্তরিক হতে হবে সরকারকে, তাদের গ্রহণযোগ্য নমনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে, শিক্ষার্থী ও সাধরণের আস্থায় এসে। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষার্থীদের বাবা-মা এবং ইতিবাচক রাজনীতি ও সমাজনীতিতে বিশ্বাসী সমাজের সকল বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ জনকে।

এতোসবের বিপরীতে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক জনগণ, যারা এতোকাল কিছুই করে উঠতে পারিনি এসব সমস্যা নিরূপণ ও সমাধানের; আমাদের গুরুদায়িত্ব হলো প্রতিদিন প্রতি পদক্ষেপে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমাদের সন্তানদের অর্জনের যথাযথ মর্যাদা দেবার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদেরকে আইন প্রয়োগের গুরুদায়িত্বের কথা প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাওয়া। সমস্ত প্রাপ্তি নিঃশর্তভাবে হাতে এসে ধরা দিলেও আইন প্রতিপালনের পথ থেকে সরে গেলেই ভেস্তে যাবে আমাদের উত্তরাধিকারের কালজয়ী অর্জন। আমাদের প্রত্যেকেরই কথাটা মনে রাখতে হবে, প্রয়োগে রাখতে হবে।