বরাবর: নির্বাচন কমিশন

মারুফ রসূল
Published : 27 July 2018, 02:04 PM
Updated : 27 July 2018, 02:04 PM

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় ২০১৩ সালের ১ অগাস্ট যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছিলেন মহামান্য হাইকোর্ট। এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদনও একই বছরের ৫ অগাস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এই রায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সার্থক প্রতিফলনের প্রশ্নে একটি যুগান্তকারী রায়।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াতে ইসলামকে নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি রিট আবেদন করে। তাতে বলা হয়— চার কারণে জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধন পেতে পারে না। এক, জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উত্স বলে মনে করে না। সেইসঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না। দুই, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজে-কর্মে ও বিশ্বাসে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল। তিন, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে কখনও কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না। চার, কোনো দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে— তাদের জন্ম ভারতে, বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে।

ওই রিটের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট একটি রুল জারি করেন। রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি(১)(বি)(২) ও ৯০(সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না— তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।

এরই মধ্যে নিবন্ধন বাঁচাতে দলীয় গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন আনে যুদ্ধাপরাধীদের এই দলটি। গঠনতন্ত্র থেকে 'আল্লাহ প্রদত্ত ও রসুল প্রদর্শিত' ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বাদ দিয়ে 'গণতান্ত্রিক' রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হয়। নিবন্ধন বাঁচানোর জন্য গঠনতন্ত্রে বারংবার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামী যে ধর্মকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক ভণ্ডামি করে— তা দেশের জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের এই রায় ঘোষণার পর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম মন্তব্য করেছিলেন— "এ রায় জামায়াত নিষিদ্ধের আইনি ভিত্তি হবে" (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম, article654272.bdnews)। কিন্তু জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমরা সরকারের পক্ষ থেকে দেখছি না। উপরন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াতের নেতারা নির্বাচনের মাঠে ঠিকই সক্রিয় আছে।

দুই

খলের যেমন ছলের অভাব হয় না, জামায়াতে ইসলামীরও ভণ্ডামি ও অপকৌশলের অভাব হয় না। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। পরে অবশ্য পৃথক দু'টি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এই নির্বাচনের ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ জারি করে। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিলো— এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগের রাতেই (৮ জানুয়ারি, ২০১৮) জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম-উদ্দিনকে ওই নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে।

বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে না পারলেও সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারবে বলে অনেকেই মত দেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়সমূহ, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় এবং গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করলে বোঝা যায়— চাইলেই জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা স্বতন্ত্র বা অন্য কোনো দল থেকে নির্বাচন করতে পারে না। সে জন্য অবশ্য নির্বাচন কমিশনকেও উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করলে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সে সময় গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন— "কোনো জামায়াত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর শর্তসমূহ পূরণ করতে পারলে প্রার্থী হতে পারবেন। তবে নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন লাগবে।" (সূত্র: বিবিসি বাংলা, news-42621871)। তাঁর এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হবার ক্ষেত্রেও 'শর্ত পূরণ' এবং কমিশনের 'অনুমোদন' প্রয়োজন।

এ কথা ঠিক যে, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী আদালতের রায়ে প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়— যে সংগঠনকে আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধের একাধিক মামলার রায়ে 'ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন' হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সে-ই সংগঠনের নেতা-কর্মী (যদি তারা যুদ্ধাপরাধী না-ও হয়) কীভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে? যে যুক্তি-তর্কের আলোকে মহামান্য হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে, অর্থাৎ সংগঠনের নানাবিধ কার্যকলাপের যে সমালোচনা রায়ে নথিভুক্ত আছে— তার দায় তো সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরই। সংগঠন বা নির্বাচনী প্রতীক তো একটি তত্ত্বগত ধারণা। এর মূল চালিকাশক্তি হলো সে-ই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এখন জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না বা নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে তারা 'দাঁড়িপাল্লা' ব্যবহার করতে পারবে না— যে আদর্শিক চিন্তা থেকে মহামান্য আদালত এই যুক্তিযুক্ত রায় দিয়েছেন— স্বতন্ত্র বা অন্য কোনো দলের প্রার্থী হিসেবে জামায়াতের নেতারা যদি নির্বাচন করতেই পারে, তবে এই রায়ের কোনও অর্থ থাকবে না। কেননা, ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গই সংগঠন পরিচালনা করে থাকে; সুতরাং সংগঠন নিষিদ্ধের রায় কেনো উক্ত সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর বলবৎ হবে না— এ প্রশ্ন করা যেতেই পারে। আসন্ন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আমরা লক্ষ করেছি— সিলেট সিটি কর্পোরেশন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন প্রতিদ্বন্ধিতা করছে মহানগর জামায়াতের আমির ৩৪ মামলার আসামী (এর মধ্যে ১৫টি বিচারাধীন) এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। তার নির্বাচনী প্রচারণায় জামাত-শিবিরের সশস্ত্র ও হিংস্র মহড়াও আমরা দেখেছি গণমাধ্যম মারফত। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলাম নামে বা 'দাড়িপাল্লা' প্রতীকে নির্বাচনে না থাকলেও স্বাধীনতাবিরোধী অপ-আদর্শের ধারকরা ঠিকই নির্বাচনে আছে বহাল তবিয়তে।

তিন

আগেই বলেছি, ট্রাইব্যুনাল তার একাধিক রায়ে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তত্কালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) সম্বন্ধে 'ক্রিমিনাল অর্গানাজেশন', 'যুদ্ধাপরাধী সংগঠন', 'পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর সংগঠন' ইত্যাদি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু নির্বাচনে বা অন্যান্য যে কোনো রাষ্ট্রীয় কার্যে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা যেনো অংশগ্রহণ না করতে পারে— সে বিষয়ে সুস্পষ্ট অভিমত পাওয়া যায় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের রায়ে আদালতের অভিমতে। রায়ের "Role of Jamaat-e-Islami during independence struggle of Pakistan and Bangladesh" অংশে আদালত অভিমত দেন যে—

  1. It is gathered from facts of common knowledge and evidence on record that under the leadership of accused Prof. Ghulam Azam almost all the members of Jamaat-e-Islami along with its subordinate organs actively opposed the very birth of Bangladesh in 1971 and after 42 years, it is noticed that some of anti-liberation people are still staying in the helm of Jamaat-e-Islami as a result young generation belonging to Jamaat-e-Islami are being psychologically reared up and nurtured with anti-liberation sentiment and communal feeling which is matter of great anxiety for a nation. There is no proof before the nation that those who played anti-liberation role in 1971 have ever changed their attitude towards liberation war by expressing repentance or by showing respect to the departed souls of 3 million martyrs.
  1. In the interest of establishing a democratic as well as non- communal Bangladesh, we observe that no such anti-liberation people should be allowed to sit in the helm of Executives of the Government, social or political parties including government and non-government organisations. We are of the opinion that the Government may take necessary steps to that end for debarring those anti-liberation persons from holding the said superior posts in order to establish a democratic and non-communal country for which millions of people sacrificed their lives during the war of Liberation.

(ICT-BD Case No. 06 OF 2011, p. 232-233)

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির কারণ শুধু এইটুকু জানানো যে, ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের নতুন প্রজন্মের নেতা-কর্মীদের বাংলাদেশ বিরোধিতার এবং সাম্প্রদায়িকতার মনস্তাত্ত্বিক দিকটি তুলে ধরেছেন যথাযথ কারণসহ। 'স্বাধীনতাবিরোধী' হিসেবে এই মনস্তত্ত্বকেও বিবেচনায় নিয়েই গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাষ্ট্রীয় যে কোনো কাজে এদের অংশগ্রহণ রহিতকরণে সরকারের প্রতি ট্রাইব্যুনাল অভিমত দিয়েছেন। সুতরাং সরকারের উচিৎ এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়সমূহ এবং জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠনের যে কোনো নেতা-কর্মীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা দিয়ে সুস্পষ্ট বিধান আরোপ করতে পারেন। না হলে আইনের ফাঁক-ফোকরকে কাজে লাগিয়ে ধান্ধাবাজ জামাত-শিবির ঠিকই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা চালিয়েই যাবে। তাহলে তাদের দলীয় নিবন্ধন আর প্রতীক বাতিল করে লাভ হলো কী? জনপ্রতিনিধি হিসেবে কোনো সিদ্ধান্ত তো আর দলের 'নাম' বা 'প্রতীক' নেয় না, নেয় সে দলে ক্রিয়াশীল নেতা-কর্মীরা।

আর আইনের এতগুলো সুস্পষ্ট অভিমত থাকার পরও ক্ষমতাসীন দল যদি মনে করে— জামায়াতকে নির্বাচনের মাঠে রেখে তারা রাজনৈতিক অঙ্ক কষবেন; তাহলে সবিনয়ে জানাতে চাই— ইতিহাস বলে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এইসব আদর্শহীন অঙ্কের ফলাফল সচরাচরই শূন্য; কখনও কখনও নেতিবাচকও।