৩০ লাখ শহীদদের নামে বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল হোক

ফেরদৌসী বেগম
Published : 27 July 2018, 11:56 AM
Updated : 27 July 2018, 11:56 AM

অভিনন্দন জানাতে গিয়ে আজ মনে পড়ছে, ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে নিজ গ্রামে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের নামে এবং সেখানকার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের উৎসর্গ করে দেশিয় উদ্ভিদ রোপণের যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম তা আজ সফলতা পেয়েছে।

৩০ লাখ শহীদের নাম স্মরণ করেই জাতীয়ভাবে ২০১৮ সালে বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একটি ছাতিম গাছ লাগিয়ে মাসব্যাপী এই বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু করেন। এই ছাতিম গাছই রবীন্দ্রনাথ লাগিয়ে ছিলেন ১০০ বছর আগে বোস ইন্সিটিউটে, সাথে ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বোস। ১৯৯৬ সালে উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিলুপ্ত প্রায় ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রথমে যে বিষয়টি আমার নজরে আসে, বাংলাদেশের ঐতিহ্যময় উদ্ভিদ যা আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসায় আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছিলেন তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। যেমন- হরতকি, বহেরা, আমলকি (ত্রিফলা), নিম, সোনালু, অর্জুন, অশোক, ছাতিম, কদম, শিমুল, পলাশ, হিজল, তমাল, অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা… এরকম হাজারো প্রজাতির উদ্ভিদ।

গ্রামে বাড়ির পাশের বাগানের যে ফলের গাছ ছিল, যেমন- খুদি জাম, দেশিয় জাম, নানা জাতের পেয়ারা, লটকন, বেতফল, কাও, ডেওয়া, কামরাঙ্গা, করমচা, গাব- এইরকম শত রকমের ফল সব হারিয়ে যাচ্ছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে গ্রামের ছেলেমেয়েরা এইসব বাগান (হোম স্টেট ফরেস্ট) ফল খেয়ে পেট ভরে পুষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরতো।

পৃথিবীর অনেক দেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এরকম হাজারো প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের দেশ আমি আর কোথাও দেখিনি। ১৯৯৮ সালে আমাদের প্রতিষ্ঠান DEBTEC  এর একটি প্রকল্প ছিল ঔষধি উদ্ভিদ ও বিভিন্ন ফলফলাদির গাছ, উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও গ্রামের মহিলাদের আয়ের উৎস তৈরি করা।

এই প্রকল্পের কাজটি আমার নিজ গ্রাম লক্ষ্মীপুরের দক্ষিণ মাগুরিতে শুরু করি। কাজ করতে গিয়েই প্রথমে আমার ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে একটি জরিপ করি, সারা গ্রামের গাছের উপর। এই জরিপের সঙ্গে বয়স্ক মানুষের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে তাদের আগের প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞানকেও লিপিবদ্ধ করি। যাকে বলা হয় 'ইনডিজিনাস নলেজ ডকুমেন্টশন'।

জরিপের ফলে আমরা দেখতে পাই, পুরো গ্রামে মাত্র ৫টি নিম, ১টি হরতকি গাছ, ৪টি বহেরা গাছ এবং ৪টি আমলকি গাছ রয়েছে। আর অন্য গাছের কথা তো বাদই দিলাম, সব নিজস্ব উদ্ভিদগুলো হারিয়ে গেছে। এই উদ্ভিদের জায়গা দখল করে নিয়েছে মেহগনি, সেগুন, ইউক্যালিপটাস এবং পুরো গ্রামের জীব-বৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন। আমরা যারা জীববৈচিত্র্যের কথা বলি, এ নিয়ে কাজ করি তারা জানি যে- উদ্ভিদ, প্রাণী ও মাটির অনুজীব পারষ্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। প্রাণী তার আশ্রয়স্থলে উদ্ভিদ না পেলে, ওই জায়গায় বসবাস করে না।

যেমন- পুকুর-বিলে অর্ধ নিমজ্জিত হিজল, তমাল, করচ না থাকলে কৈ, মাগুর, শিং, শৌল, মেনি মাছ হয় না। এই ফলাফল নিয়ে আমরা যখন বিশ্লেষন করি, তখন আমরা দেখার চেষ্টা করি যে বাংলাদেশে বিভিন্ন আর্য়ুবেদিক, ইউনানি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে তারা তাদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ঔষধি উদ্ভিদ কোথা থেকে সংগ্রহ করে!

তখন আমরা তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তারা এগুলো ঢাকার মৌলভীবাজার ও চক বাজারে ঔষধি উদ্ভিদের এক বড় বাজার  রয়েছে, সেখান থেকে সংগ্রহ করে। এরপর আমরা মৌলভীবাজারের বড় বড় পাইকারী বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, কাল মেঘ, তুলসি, অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, হরতকি, বহেরা, আমলকি, অর্জুনসহ সকল ঔষধি উদ্ভিদই ভারত থেকে আমদানি হয়, কিছু চীন থেকেও হয়। এ আমদানির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার উপরে।

আমরা তখন জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রথমবারের মত এই বিষয়টি তুলে ধরি এবং অনবরত এই নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, পত্রিকায় লেখালেখি ইত্যাদির মাধ্যমে গণ সচেতনতা তৈরি করি ও বই লিখি। এই কার্যক্রমকে একটি আন্দোলনে রূপান্তরিত করি। ১৯৯৮ সালে জাতীয় বৃক্ষমেলায় আমি প্রথম ঔষধি উদ্ভিদের উপর একটি প্রর্দশনীর স্টল দেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার স্টল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন যে, "আমি প্রতিদিন সকালে চিরতা ভিজানো পানি খাই।" আমরা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, তৎকালীন স্থানীয় সরকার, সমবায় ও  পল্লীউন্নয়ন মন্ত্রীকে নিয়ে ১৯৯৮ সালে 'জীবনের জন্য ঔষধি উদ্ভিদ' শিরোনামে একটি সেমিনার আয়োজন করি, যাতে জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ড. নুরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।

এত কথা লেখার কারণ, আমার গ্রামে এই জরিপের পর আমি তিন পর্যায়ে ১৫ হাজার দেশিয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণের সিদ্ধান্ত নেই। ১৯৯৮ সালে যখন বৃক্ষরোপণ শুরু করি, তখন কিছু স্থানীয় মাস্তান আমাদের বৃক্ষগুলো উপড়ে ফেলে ও কেটে দিতে থাকে। আমি তখন আমার নিজ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাই স্কুলের শিক্ষকদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসি। আলোচনার মধ্যে দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে পেয়ে তাকে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের নাম বলতে বলি, দশম শ্রেণীর ছাত্র একজন বীরশ্রেষ্ঠের নামও বলতে পারে না। সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে স্কুলের বিজয় দিবস অনুষ্ঠান। আমি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেই, প্রথমে স্কুল প্রাঙ্গণে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের নামে দেশিয় গাছ লাগানো হবে। প্রত্যেকের নামে ২টি করে ফলজ, ২টি বনজ, ২টি ঔষধি গাছ লাগানো হবে।  তার সাথে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধে নিহত শহীদ ব্যক্তি, এলাকার সমাজসেবক, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের একজনের নামে এবং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, আমার বাবার দাদীর নামেসহ প্রত্যেকের নামে এভাবেই গাছ লাগানো হবে।

অন্যান্য স্কুলেও একইভাবে গাছ লাগানো শুরু হবে। কর্মসূচিটি ২৬ মার্চে শুরু হলেও, কাজটি আমরা বছর জুড়ে করতে থাকি এবং প্রত্যেকটি গাছে বীরশ্রেষ্ঠ ও অন্যান্যদের নাম টিনের নেমপ্লেটে করে লাগিয়ে দেই। যাতে শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীরা সকলেই এর থেকে তাদের নাম জানতে পারে। শুরু হয় এক নবযাত্রা। শুধু স্কুলে নয়, অনেকে মসজিদে, বাড়িতে এভাবে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগাতে থাকে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়, মাস্তানরা লাগানো গাছ নষ্ট তো করলই না বরং তারা পাহারা দিতে লাগলো।

কিন্তু আমার গ্রামের অত্যন্ত প্রভাবশালী ধনী এক রাজাকারের কারণে প্রচন্ড বাঁধাগ্রস্ত হয় একবছর কাজ করার পর, কাজটি আর করতেই পারছিলাম না। গাছগুলো আজও সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পরবর্তীকালে আমি নাটোরের লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়ি ইউনিয়নে একটি গ্রামে ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করি। গ্রামের নামকরণ হয়ে যায় 'ঔষধি গ্রাম', আমার নাম হয়ে যায় 'ঔষধি আপা'। ওই গ্রামের মানুষেরা আমার নামে গান লিখে, কবিতা লিখে। আমরা গ্রামের ঔষধি উদ্ভিদ উৎপাদকদের ঢাকার ঔষধি উদ্ভিদ ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেই। এতে করে আজও তারা এই কাঁচামাল বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে।

বর্তমান যে স্লোগানটি 'ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগান' এটি পরবর্তীতে আমাদেরই দেয়া। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ৩০ লক্ষ শহীদের উদ্দেশ্যে যে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি অনুরোধ করছি যে, বৃক্ষগুলো অবশ্যই যেন দেশিয় প্রজাতির বৃক্ষ হয়, যা আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে। যে ফল খেয়ে আমাদের শিশুরা তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিতে পারবে। আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন সহিঞ্চুতা তৈরি হবে।

আরেকটি অনুরোধ, সড়কের আইল্যান্ডে যে গুল্ম জাতীয় গাছ লাগানো হয়, সেগুলো যেন তুলসী, কালমেঘ, আকন্দ, নিম জাতীয় গাছ লাগানো হয়, তাতে শব্দ দূষণ ও মশার উপদ্রব কমে যাবে। সর্বশেষে প্রত্যেক গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদের নামে গাছ লাগালে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের সংখ্যা আমরা জেনে যাব। এই মহান কর্মসূচির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশবাসী সকলকে আবারও অভিনন্দন।