মাহমুদুর রহমান: হামলা না আত্মঘাতী অপকৌশল?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 July 2018, 12:34 PM
Updated : 25 July 2018, 12:34 PM

দেশ ও দেশের বাইরে যে পরিবেশ তাতে আমি অন্তত কোন ধৈর্য বা সহিষ্ণুতা দেখতে পাইনা। মারমুখি আচরণ আর কথায় কথায় তেতে ওঠা যেন আমাদের নিয়তি। জানিনা এর পেছনে কী মনস্তত্ব! তবে মনে হয় রাজনীতি আর তার ইন্ধনই মূল। ক'দিন আগে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার ছবি দেখলাম।

রাজনীতি পারেনা এমন কোনও বিষয় নাই। রাজনীতি পারে বলেই ঢাকার রাজপথে গ্রেনেড হামলা হয়। রাজনীতি পারে বলেই জেলখানার মত নিরাপদ জায়গায় নেতাদের গুলি করা যায়। রাজনীতি পারে বলেই একরাতে জাতির জনকসহ তাঁর পরিবারকে নিশ্চিহ্ণ করার অপপ্রয়াস চালানো যায়। রাজনীতি পারে বলেই জেনারেল জিয়াকে নৃশংসভাবে হত্যার পর তাঁকে দু জায়গায় দাফন করাও দেখেছি বৈকি! রাজনীতি পারে বলেই আজো বহাল তবিয়তে আছে আরেক জেনারেল এরশাদ।

ফলে মাহমুদুর রহমানের মত আরও নিম্মগ্রেডের নেতা  বা বিএনপি সমর্থকের জন্য কী নাটক হতে পারে বোঝা মুশকিল। আমাদের প্রশ্ন একটাই যদি তাঁর ওপর হামলা করতেই হতো তো এত পরে করার কি আসলেই কোনও দরকার আছে? না ছিলো? তার যখন রমরমা বা তিনি যখন খালেদা জিয়ার ওপর ভর করে আসমানে উড়ছেন তখন তো এমন কিছু দেখিনি।

এমন কি যখন জেলে গেলেন ফিরে আসলেন তখনও না। যার মানে হামলাকারীরা আসলে কারা সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। মনে রাখা দরকার রাজনীতি এমনই এক বিষয়, কে কাকে কখন বলি দেবে জানা যায়না। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি পঁচাত্তরে জেলখানায় নিহত চার জাতীয় নেতাকে হত্যার আগে কারাপ্রধান বঙ্গভবনে ফোন দিয়েছিলেন। তখন তাঁকে গেইট খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল এই চার নেতার একসময়ের সহযোগী তাদের দলের নেতা মীরজাফর মোশতাক। ফলে এটা বোঝা কষ্টের কিছুনা রাজনীতি মানে আসলে একটা খেলা। আর সে খেলায় কে কখন কার ফাঁদে পড়ে বলি হবে কেউ জানেনা।

মাহমুদুর রহমানের অতীত আমাদের অজানা না। হঠাৎ করে উদিত হবার পর হেন কোন অপকর্ম নাই তিনি করেননি। অপকর্ম বলতে চুরি বাটপারি বা ডাকাতি নয়, এই অপকর্ম একটি জাতির শান্তি ও স্বাভাবিকতা বিনষ্টের জন্য যথেষ্ট। একটা পত্রিকাকে সম্বল করে সারাদেশে ঘৃণা আর বিদ্বেষের আগুন জ্বালানোর কাজে নেমেছিলেন তিনি। মতিঝিলের ঘটনা থেকে ঢাকায় যে অশান্তি- তার দায়ের অনেকটাই মাহমুদুরের।

আওয়ামী সরকারকে নাস্তানাবুদ করে শেখ হাসিনাকে সরানোর অপকৌশলে তিনিই ছিলেন পুরোভাগে। রাতারাতি হিরো বনে যাওয়া মাহমুদুর রহমান ও তার মিডিয়া এমন সব কথা বলছিলো, মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ আরেকটি পাকিস্তান না হওয়া পর্যন্ত তাদের শান্তি নাই।

এই লোকটির শক্তি ও উৎস কী সরকার নিশ্চয় ভালো জানে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা আর হিংসার চরম উস্কানি দেয়ার পরও তার বিরুদ্ধে তেমন কোনও অ্যাকশনে যায়নি সরকার। কোথায় কোন্ আপস, কোন্ ষড়যন্ত্র- জানিনা।

তবে 'হিন্দুদের দিল্লির দালাল আর ছাল তুলে নেয়ার' ঘোষণা দেয়ার পর ও আমরা তার বিরুদ্ধে কোনও অ্যাকশন দেখিনি। হয়তো আওয়ামী লীগের একাংশও তার এই বক্তব্যের সাথে একমত। কিন্তু মাহমুদুর রহমান সেখান থেমে থাকেননি। তারপর তিনি নামলেন সরকারে বিরুদ্ধে। হেফাজতি হুজুরের কাছে গিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করার পর টনক নড়েছিল সরকারের। ততদিনে জল অনেক গড়িয়ে গেছে। যাই হোক তারপরও আমরা তার বিরুদ্ধে সত্যিকারের কোনও কার্যকর ভূমিকা দেখিনি। যেখানে আরো ন্যূনতম অপরাধে মানুষ ভুগেছে বা অপরাধহীন হয়েও সাজা খেটেছে সেখানে রহমান সাহেব মহানন্দে জীবন উপভোগ করে গেছেন।

মাঝখানে কিছুদিন কারাভোগ বা উপভোগের বেরিয়ে এসে এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন। তাই হঠাৎ করে কুষ্টিয়ায় কেন এই হামলা তা নিয়ে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক। যেভাবেই হোক মারমারি বা রক্তপাত আমাদের কাম্য হতে পারেনা। জানি তারা আমাদের ছাড় দেবেনা, দেয়ও না। আমার মত 'মালাউন' নাম পেলে তো আরো জোশ, আরো আনন্দ। তারপরও আমি বলবো এমন হামলা অন্যায়।

কারো রক্তাক্ত মুখ বা পোশাকের ছবি দেখাতে কারোই ভালো লাগার কথা না। তবে এটাও ভাবতে হবে সহানুভূতি বা সমর্থনের আশায় এমন করা হয়েছে কি না! তেমনটা করা কি রাজনীতিতে খুব কঠিন? না আগে কখনো হয়নি? সেদিকে নজর রাখাটা জরুরি বৈকি। সামনে নির্বাচন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন বিএনপি তাঁদের বিরুদ্ধে 'ব্লেইম গেইম' খেলছে। সেখানে এই গেইমটা 'গেইম', না রিয়েল সেটাও দেখা দরকার। আবারো বলছি এতদিন পর হঠাৎ এই হামলা ও রক্তাক্ত ছবির পেছনে কেন জানি কিন্তু বিষয়টা কাজ করছে। তারপরও আমরা চাইনা কোনও সাংবাদিক বা যেকোনও মানুষ এভাবে আক্রান্ত হোক।

মাহমুদুর রহমানের কাজকর্ম পর্যালোচনা করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হবেনা তিনি বা তাঁর মত মানুষের আসলে কী চায়! সেটা বোঝার পরও তাদের হাতে বল তুলে দেয়া বা তাদের দিকে মানুষের সহানুভূতি ঝুঁকতে দেয়া কাজের কথা না। যে বা যারাই করুক তাদের খুঁজে বের করে মানুষকে জানতে দেয়া উচিৎ মূল বিষয় কী এবং কারা তা করেছে। কারণ এটা এখন আমি হলপ করে বলতে পারি নির্বাচন যত কাছে আসবে বিএনপি ও তাদের দোসররা আরো অনেক ষড়যন্ত্র আর অপকৌশলের আশ্রয়  নেবে। তাদের কোনও নেতাকে তারা  টার্গেট করবে কেউ জানেনা। মাহমুদুর রহমান হয়তো তারই একটা মহড়া।

তবে দেশের সার্বিক পরিবেশ আর উন্নয়ন ধারা বিবেচনায় এমন কাজ না করাই ভালো। এতে মানুষের মনে যদি একফোঁটা সহানুভূতি বা সমবেদনা জন্ম নেয় তা আমাদের জন্য মঙ্গলের হবেনা। মনে রাখা দরকার এই লোক আমাদের ইতিহাস অতীত মুক্তিযুদ্ধ এমনকি বর্তমান কিছুই মানেননা। তাকে দেখলে আমার জিন্নাহর কথা মনে পড়ে।

ইনি ও দেখুন পশ্চিমা পোশাক সার্ট প্যান্ট ছাড়া পড়েননা। ধর্মীয় কোনও লেবাস গায়ে রাখেন না। কথাবার্তাও আধুনিক। কিন্তু মনে আর চিন্তায় ঘোর সাম্প্রদায়িক। এমন মানুষেরা ধমর্কে যতটা ব্যবহার করেতে পারে প্রকৃত ধার্মিকরা কখনোই তা পারেননা। তাই তাকে আমি জামাতের চেয়েও ভয়াবহ মনে করি। কারণ এদের অন্তরে ঘৃণা আর প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছু থাকেনা।

তাকে সুযোগ করে দেয়া তাই একেবারেই অনুচিত। আমরা মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে বিচার বা মামলা চাই, হামলা চাইনা।  মুক্তিযুদ্ধের চরম দুশমন আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের  বা সংখ্যালঘুদের নামে প্রগতিশীলতা উচ্ছেদের অপচেষ্টায় তার বিরুদ্ধে সরকার ও রাষ্ট্রের অবস্থানই এখনো পরিষ্কার হলো না কেন? এটাও জানতে হবে বৈকি।