শেখ হাসিনা: একটি খণ্ডিত বিশ্লেষণ

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 22 July 2018, 03:57 PM
Updated : 22 July 2018, 03:57 PM

The greatest threat to freedom is the absence of criticism.

 Wole Soyinka

এক.

পাঠকদের কাছে একটি কৈফিয়ত দিয়ে লেখাটি শুরু করছি। পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে বিশ্লেষণটি পূর্ণাঙ্গ না হয়ে খণ্ডিত কেন! এর কারণ মূলত দুটো। এই সময়ে বসে অনেক ক্ষেত্রেই একজনের পক্ষে একটি বিষয়ের পুরো চিত্র দেখতে পারা বা অনুধাবন করা সম্ভব হয় না; ঘটনা থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, ততই বিষয় বা ঘটনার সার্বিক মূল্যায়ন সহজতর হয়ে উঠে।

দ্বিতীয় কারণটির সাথে যুক্ত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা, যার কারণে গণতন্ত্রকে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব হয় নাই। এদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বাতাবরণটিই এমন যে পারিবারিক পরিবেশ থেকেই শিক্ষা দেয়া হয় ধর্ম, রাজনীতি থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্কের নানাবিষয় সম্পর্কে কথা না বলতে। ফলে, পারিবারিক এবং সামাজিক পরিমণ্ডল থেকেই প্রশ্ন না করার বা কথা না বলার সাংস্কৃতিক আবহেই শ্রেণি নির্বিশেষে প্রায় সবাইকে বেড়ে উঠতে হয়। অর্থাৎ, গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতির প্রথম পাঠটি আমরা অনেকেই আমাদের পারিবারিক মন্ডল থেকেই পেয়ে থাকি।

একটি দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক রূপকে ধারণ করেই যেহেতু রাষ্ট্র গড়ে উঠে ফলে, একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা হলেও স্বাধীনতার প্রায় ৪৭ বছর পরেও সেটি গড়ে তোলা সম্ভব হয় নাই। কিন্তু, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন তখন কেউ কেউ আশা করতে শুরু করেছিলেন তিনি হয়ত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গণতন্ত্রহীনতার রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবেন বা অন্তত চেষ্টা করবেন। সে বাংলাদেশ হবে এমন যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনও বিষয়ে মত প্রকাশের অধিকারের পাশাপাশি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, এবং নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।

কিন্তু, কিছুদিনের মাঝেই একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল- সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্রসহ বিভিন্ন দল, প্রেশার গ্রুপ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান- কেউই এমন বাংলাদেশ চাচ্ছে না যেখানে সব মানুষ সব বিষয় নিয়েই নিঃশঙ্ক চিত্তে কথা বলতে পারবে। ডান, বাম, দক্ষিণপন্থা- যে যেই রাজনৈতিক মতাদর্শেই বিশ্বাস করেন, সবাই ১/১১ উত্তর এমন বাংলাদেশ দেখতে চাইলেন যেখানে তাঁদের মতাদর্শের পূর্ণ বিকাশের নিশ্চয়তা থাকবে। কিন্তু, তাঁদের বিরুদ্ধ বা সমালোচনাকারী মত বা চিন্তার কোনও অস্তিত্ব থাকবে না।

পাশাপাশি, শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলও চাইল কিছু ব্যক্তিবর্গ, ঐতিহাসিক ঘটনা এবং ইতিহাসের কিছু বাঁক সম্পর্কে আওয়ামী লীগের দলীয় ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে অন্য চিন্তা বা ভাবনার অস্তিত্ব যাতে রাষ্ট্র এবং সমাজে না থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়টা নিশ্চিত করার জন্য এবং এর পাশাপাশি কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে যাতে সমালোচনার মুখোমুখি পড়তে না  হয় তার উদ্যোগ গ্রহণ করে- যার ফল হলো তথ্যপ্রযুক্তি আইনসহ নানাবিধ আইন। এ সমস্ত আইনে ধর্মীয় ও সামাজিক স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও যাতে কোনও প্রকার আলোচনা, সমালোচনা না হয় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ফলে, এমন এক ধরণের বাতাবরণের মাঝে দাঁড়িয়ে বর্তমান এবং ঐতিহাসিক নানা ব্যক্তিবর্গ, ঘটনা, ইতিহাস, মতাদর্শ, সামাজিক এবং ধর্মীয় নানা বিষয় সম্পর্কে কোন লেখক বা গবেষকের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়; তাঁর বিশ্লেষণটি খণ্ডিত হতে বাধ্য।

কৈফিয়তটি অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল। এবার দেখা যাক নানা নিষেধাজ্ঞার জালে যখন লেখক, গবেষকরা বন্দি থাকেন তখন তাঁরা কি ধরনের লেখা লিখেন। এটা বোঝার জন্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণচীন বা উত্তর কোরিয়ার দিকে চোখ ফেরাতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে মার্কস, লেনিন, স্তালিন নিয়ে অনেক লেখালিখি, 'গবেষণা' হয়েছে। কিন্তু, সবকিছুর মূল সুর ছিল একই- তাঁরা 'মহামানব', তাঁদের কোন ভুল বা অন্যায় থাকতে পারে না।  মাও-সে-তুঙ্গের চীনে তাঁর উপর লেখা সব গ্রন্থ, প্রবন্ধ, নিবন্ধের মূল বিষয়ই ছিল, তিনি হলেন 'মহামানব' এবং জনগণের দুঃখ, কষ্ট তাঁর চেয়ে ভালো কেউ বোঝে না। উত্তর কোরিয়াসহ অন্যান্য সাবেক সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতেও আমরা একই অবস্থা দেখি।

এ সমস্ত রাষ্ট্রগুলো এ জন্য অনেক বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান জন্ম দিতে পারলেও সেখানে কোনও খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ বা সাংবাদিকের জন্ম হয়নি। কেননা, ভালো সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হবার পূর্ব শর্তই হচ্ছে তুলনামূলকভাবে মুক্ত পরিবেশ, যেখানে তিনি অনেকটা নি:শঙ্ক চিত্তে গবেষণা বা লেখালেখি করতে পারবেন। প্রসঙ্গত, যে সোভিয়েত শাসকরা নিজেদের সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, সেসময় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামে আলাদা কোনও বিভাগ খোলার অনুমতি ছিল না। অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে মুক্ত বাতাবরণ থাকায়, ভারতের মত দেশ যেখানে নামকরা সমাজ এবং রাষ্ট্র গবেষক ও ইতিহাসবিদদের জন্ম দিতে পেরেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণচীন বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো তা পারেনি।

গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকার ফলে ভারতে সরকারী বয়ানের বাইরেও দেশটির ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করবার অবকাশ রয়েছে। এজন্য আমরা নেহেরু, গান্ধী বা ভারতের জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে নানা ধরনের বয়ান দেখি। এর কিছু কিছু বয়ানে নেহেরু, গান্ধীর চরিত্র হনন থেকে শুরু করে সত্য, মিথ্যা মিশ্রিত অনেক কল্পকথা যেমন রয়েছে, তেমনি গান্ধীর যৌন জীবন বা নেহেরুর এডউইনা মাউন্টব্যাটেনের সাথে প্রেম কাহিনী নিয়ে রয়েছে অনেক লেখাজোকা। ফলে, জনগণের পক্ষে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে জানা সম্ভব হচ্ছে। বস্তুত, এটিই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য যেখানে কোনও বিষয়ের শুধু একটি বয়ান নয়, বরং একটি বিষয়কে দেখা হয় নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, এমনকি তা যদি  সরকারী বয়ানের সম্পূর্ণ বিপরীত কোনও দৃষ্টিভঙ্গি হয়, সেখানে থেকেও।

দুই

বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক যাত্রাটা শুরু হয়েছিল অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলের শেষ সময়ে তিনি দেশে ফিরে এমন এক সময়ে দলের হাল ধরেছিলেন, যখন অনেকেই দল হিসাবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। ১৫ অগাস্ট পরবর্তী এ দলটির প্রথম সারির অনেক নেতৃবৃন্দ তখন নিহত। যারা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের একটা অংশ মোশতাকের সাথে যুক্ত হয়ে দলের বাইরে। এছাড়া জিয়ার কঠিন দমন-পীড়ণের শিকার দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী তখন জেলে এবং অনেকেই নানা মামলা মাথায় নিয়ে ফেরার।

এমতাবস্থায়, তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সের একজন তরুণীর হাতে দলের নেতৃত্ব তুলে দেয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত এ প্রশ্ন খোদ আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীর মাঝেই তখন দেখা দিয়েছিল। জিয়ার নীপিড়ণে বিপর্যস্ত, দলীয় কোন্দলে নানা উপদলে বিভক্ত দলের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ দল টিকিয়ে রাখবার উপায় হিসাবে জাতীয় রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, বঙ্গবন্ধুর প্রবাসী জ্যেষ্ঠ কন্যা হাসিনাকে দলীয় প্রধান করবার সিদ্ধান্ত নেন।

দলের নেতৃত্ব হাতে নিয়েই শেখ হাসিনা কতগুলো প্র্যাগমেটিক সিদ্ধান্ত নেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলের রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু যে পথ নির্ধারণ করেছিলেন, অর্থাৎ, সমাজতন্ত্র এবং একদলীয় শাসনের পথ, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের যে নীতি ছিল- পুঁজিবাদ এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র, সে ধারায় দলকে ফিরিয়ে আনেন তিনি। একই সাথে তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত লবি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মার্কিন এবং ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে দলের সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেন।

উল্লেখ্য যে, এর আগে জিয়াউর রহমানও ক্ষমতা দখল করে বঙ্গবন্ধুর পরিণত বয়সের সোভিয়েত লবির রাজনীতির বিপরীতে, তরুণ বঙ্গবন্ধুর মার্কিন ঘেঁষা, পুঁজিবাদী, মুক্তবাজার অর্থনীতি বাংলাদেশে চালু করেন। বর্তমান বাংলাদেশ 'তরুণ বঙ্গবন্ধুর'ই উত্তরাধিকার, পরিণত বঙ্গবন্ধুর নয়। অর্থাৎ, শেখ হাসিনার আদর্শ 'তরুণ বঙ্গবন্ধু', 'পরিণত বঙ্গবন্ধু' নন। তিনি 'তরুণ বঙ্গবন্ধুর' স্বপ্নই বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে চান, 'পরিণত বঙ্গবন্ধুর' নন।

প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্ব হারা বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া এ দলটি জিয়ার নিপীড়নে বিধ্বস্ত হলেও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া এবং জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বিপুল সংখ্যক নিবেদিত বা পরিক্ষীত তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী হাসিনা পান।

তাদের সহায়তায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা প্রমাণ করে আরেক সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য দলের সাথে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তুলে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হন।

পরবর্তীতে হাসিনা তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়াকে ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফরম থেকে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতের সাথে এক যোগে আন্দোলন করে সরকারী আমলাদের সহায়তায় ক্ষমতাচ্যুত করতে সমর্থ হন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি এটা প্রমাণ করেন যে তিনি এবং তাঁর দলের অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনও দলের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার ফেলে দেবার ক্ষমতা নেই।

এর প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮৬ সালে এরশাদ বিরোধী প্রবল আন্দোলনের সময় হঠাৎ করে আন্দোলন বন্ধ করে সিপিবি, ন্যাপ (মো), এবং ভিন্ন প্লাটফরম থেকে জামায়াতসহ শেখ হাসিনা যখন নির্বাচনে চলে যান, তখন বিএনপির পক্ষে তৎকালীন পাঁচ দলীয় বাম জোটকে সাথে নিয়ে সামরিক শাসক বিরোধী কোনও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয় নাই।

শুধু আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেই নয় আরো কিছু ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যেটা এক সময় কল্পনার বাইরে ছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনেন আর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আনেন যুদ্ধপরাধীদের।

বিশেষত, জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এ বিষয়টাই জামায়াত, বিএনপি তো বটেই অনেক সাধারণ মানুষের কাছেই ২০০৯ সালের পূর্বে ছিল কল্পনাতীত। বিষয়টা এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, ২০০৯ সালে হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসবার সাথে সাথে তৎকালীন বিএনপির প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, "আওয়ামী লীগকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই হবে।"

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটা বড় সাফল্য হল জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ক্রমশ উচ্চহারে নিয়ে যাবার যে ধারাবাহিকতা আশির দশক থেকে শুরু হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে একে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া, যার ফল হলো সাত শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি। প্রবৃদ্ধির এ উচ্চহারের ফলে এ বছর বাংলাদেশ ভারতকে প্রবৃদ্ধির হারে পিছনে ফেলে দেবে, যেমন পাকিস্তানকে দিয়েছিল তিন বছর আগে। প্রবৃদ্ধির এ হার ধরে রাখতে পারলে, ২০২০ সাল নাগাদ, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাবে। এ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ফল আমরা দেখি বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এছাড়া সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে- যেমন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃ মৃত্যু, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, স্যানিটেশন সুবিধা, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে,  প্রতিবেশি ভারত এবং পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে দেয়া।

কিন্তু, এ উন্নয়নের ধারাকে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আরো উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে পারত, যদি না ২০০৮ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি রোধের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, সেটা বাস্তবায়ন করতে পারতেন। এটা বাস্তবায়নের ব্যর্থতার ফলে সর্বস্তরে দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি এর সাথে সব পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা সাধারণ জনগণ পর্যবেক্ষণ করেছে। এ দুর্নীতির একটা রূপ হচ্ছে নানা অবৈধ চ্যানেলে মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ দেশি মুদ্রা বিদেশে পাচার, যার সঠিক হিসাব না থাকলেও দেশি বিদেশী নানা পর্যবেক্ষণে গত দশ বছরে এর পরিমাণ কয়েক লাখ কোটি টাকা অনুমান করা হয়।

দুর্নীতির আরেকটি রূপ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হিসাব মতে, গত ১০ বছরে ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ যারা নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে ৬৫ হাজার ৬০২ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভবপর হয়নি। এ ১০ বছরের ৯ বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং অর্থমন্ত্রী ছিলেন মুহিত। এ সময়কালে সরকার ১ হাজার ৯৫৬ ব্যক্তি এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে ওই পরিমাণ টাকা সরবরাহ করেছে।

দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে লুণ্ঠিত এ বিপুল পরিমাণ টাকা যদি জাতীয় অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করা সম্ভব হত, তাহলে প্রবৃদ্ধির বর্তমান হার সাত শতাংশের জায়গায় নয় শতাংশের উপরে থাকত। এতে উন্নত বাংলাদেশ গড়বার যে স্বপ্ন আওয়ামী লীগ সরকার দেশবাসীকে দেখিয়েছে, তা অর্জনের পথে দেশ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যেত।

এ অর্থনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের সাথে দলের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর যোগ থাকবার ফলে তাঁদের নৈতিকতার জায়গাটা দুর্বল হয়েছে যা আখেরে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করেছে। ৮০ এবং ৯০ এর দশকে যে লড়াকু দল নিয়ে শেখ হাসিনা, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলে এ ধরনের নৈতিকভাবে দুর্বল নেতা-কর্মীদের দিয়ে কোনও আন্দোলন সংগঠিত করতে পারবেন কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সাথে যুক্ত নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দলটির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকা দলটির দুর্বলতার আর একটি বড় দিক। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল গণতান্ত্রিক দল হিসাবে দাবীদার দলটির অভ্যন্তরেই গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা। শুরু থেকেই দলটি শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বে পরিচালিত হবার ফলে সভাপতিসহ অধিকাংশ পদই আমরা নেতৃত্বকে কর্মীদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে দেখি না। দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

গণতন্ত্র চর্চার অভাব এবং নেতাকর্মীদের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার জন্য পরিবারকেন্দ্রিক, ব্যক্তিতান্ত্রিক নেতৃত্বের জন্ম লাভ করেছে দলটিতে। দলটির ইতিহাসে দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দেয়া শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল ব্যক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিকতার বাইরে যেয়ে দলে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব তৈরি করতে না পারা। পুঁজিবাদী, গণতান্ত্রিক উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখলেও হাসিনা তাঁর নিজ দলের নেতাকর্মীদেরই সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার বৃত্ত হয় ভাঙ্গতে পারেন নাই বা চান নাই। ফলে, ব্যক্তি হিসাবে শক্ত নেতৃত্ব গড়ে উঠলেও দল হিসাবে আওয়ামী লীগ হয়েছে দুর্বল।

আর এ দুর্বলতার একটি বড় ফল হল নিজেদের ক্ষমতা নিরাপদ- এ মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা জারি রাখবার জন্য হেফাজতসহ বিভিন্ন দক্ষিণপন্থার শক্তিসমূহকে নানাভাবে খুশি রেখে "আসাম্প্রদায়িক" আওয়ামী লীগের রাজনীতি যে 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতির সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি করে না- এটা প্রমাণের নিরন্তর চেষ্টা করে যাওয়া।

দলের এ দুর্বলতার আরেকটি ফল হলো, দলীয় কর্মীদের চেয়ে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর আমলাদের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাওয়া। এ নির্ভরতার ফলে সরকারের চেয়ে রাষ্ট্র হয়ে উঠে শক্তিশালী। যেখানে রাষ্ট্র সরকারের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে সেখানে আইনকে পাশ কাটিয়ে সমস্যা সমাধানের দ্রুত চেষ্টা করা হয়। এর ফলেই গত সাড়ে নয় বছর খালেদা জিয়ার দেখান 'অপারেশন ক্লিন হার্ট' এর পথ ধরেই শেখ হাসিনার সরকারকেও বন্দুক যুদ্ধ/ক্রস ফায়ার চালু রাখতে হয়েছে।

এর সাথে সাড়ে নয় বছরে যেটি যুক্ত হয়েছে, সেটি হল "গুমের সংস্কৃতি"। যদিও এ গুমের সাথে নানা মহল যুক্ত বলে জনমানসে ধারণা, কিন্তু এ "গুমের সংস্কৃতি" থেকে বেরিয়ে আসার কোন প্রচেস্টা এ সরকার হয় নিতে পারছে না অথবা নিতে চাচ্ছে না বলে, জনগণের একটা বড় অংশের কাছে মনে হয়েছে।

বর্তমান মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও  জনগণের বড় একটি অংশের কাছে এ উন্নয়নের কোন স্বীকৃতি নেই। এর না থাকার মূল কারণ হল দুটো-

এক. দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার এবং দলের নেতাকর্মীদের অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সাথে জড়িত থাকা,

দুই. অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত হয়ে না আসা।

দল হিসাবে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও জামায়াত, সিপিবি এবং অন্যান্য দলসহ ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে জনগণের একটি বড় অংশকে এ ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বর্তমান সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না।

এ ধারনাটিকে খণ্ডন করে আওয়ামী লীগ যে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার অথবা অদূর ভবিষ্যতে দলটি সকল দলের অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে- এমন ধারণা ব্যাপক জনমানসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রথিত করতে পারে নাই। আর এ না পারবার ফলে, দেশব্যাপী চলমান উন্নয়ন কর্মসূচির সাথে জনগনের একটা বড় অংশই নিজেদেরকে সংশ্লিষ্ট বোধ করেন না।

বাংলাদেশের জনগনের জন্য সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল আসাম্প্রদায়িক, উদার-গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার কথা বলে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেও এবং সে দলটি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর কন্যার নেতৃত্বে ক্ষমতায় থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সে আদর্শ বাস্তবায়নের ধারে কাছেও বাংলাদেশ পৌঁছাতে পেরেছে বলে খোদ আওয়ামী লীগের সমর্থকরাই মনে করেন না।

বাংলাদেশ ক্রমশ সিঙ্গাপুর, ভেনেজুয়েলা বা রাশিয়ার মত একধরনের 'কর্তৃত্ববাদী গণতান্ত্রিক' রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। এ ধরনের গণতন্ত্রে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন বলে সরকারকে দাবী করতে হয়, কিন্তু জনগণের কাছে সেটা প্রতীয়মান হয় না।

এ ধরণের 'কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রে' প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত 'স্বাধীনতা' থাকে। সেখানে নিয়মিত নির্বাচনও হয় এবং বিরোধী দল তাতে অংশগ্রহণও করে থাকে। জনগণ সে নির্বাচনে ভোটও দিতে পারেন, কিন্তু জনগণসহ সব মহলই জানেন যে, নির্বাচনে সরকারী দলই জয়লাভ করবে এবং তাই হয়ে থাকে।

তিন

লেখার শুরুতেই পাঠকদেরকে একটি কৈফিয়ত দিয়েছিলাম, এটি একটি অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণ হবে। ধৈর্য ধরে এ পর্যন্ত পড়ে পাঠককের কাছে বিশ্লেষণের নানা অসম্পূর্ণতা নিশ্চয় ধরা পড়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা, তাঁর নেতৃত্ব এবং বর্তমান সময় সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ তখনই সম্ভব হবে যদি মুক্তিযুদ্ধের আলোকে ভবিষ্যতে কখনো অসাম্প্রদায়িক, উদার-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠে। সে বাংলাদেশ গড়ে না উঠা পর্যন্ত আরো অনেক বিশ্লেষণই আমরা দেখব, কিন্তু তার সবই হবে হয় খণ্ডিত, না হয় একপেশে বা পক্ষপাত দুষ্ট।