জামায়াত শিবিরের বিপরীতে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির অবস্থান

স্বদেশ রায়
Published : 8 July 2018, 04:47 PM
Updated : 8 July 2018, 04:47 PM

পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করলেও পাকিস্তানি রাজনীতিতে জামায়াত ইসলাম ও তাদের ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক দল ও শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিলো। যে কারণে আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠিত হলে সেখানে জামায়াতে ইসলামী ছিলো। তবে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেবার পরে যখন ধীরে ধীরে বাংলাদেশ সৃষ্টির রাজনীতি শুরু হয় সে সময়ে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশপন্থীদের অবস্থান কী হবে তা পরিস্কার হতে থাকে। ১৯৭০ এর নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনীতির অবিসংবাদিত যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর সহযোগীদের নির্দেশনায় সেটা কার্যকর হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনের আগে পল্টনে শেষ জনসভা করতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী। তারা সেদিন জনসভা ছেড়ে দলে দলে পালাতে বাধ্য হয়। শেখ ফজলুল হক মনি বুঝেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধী শক্তি, এদের সঙ্গে কোন রাজনীতি নয়, এদেরকে দমন করতে হবে। সেদিন জনতা ও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতিরোধের ফলে জনসভা ছেড়ে জামায়াত নেতা মওদুদী সহ সকলে পালিয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামীর জনসভার সেদিন কী অবস্থা হয়েছিলো তার কোন টিভি ফুটেজ আছে কিনা আমার জানা নেই তবে আজকের প্রজম্ম ইচ্ছে করলে ওই সময়ের আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে নিতে পারেন। হাজার হাজার স্যান্ডেল পড়ে ছিলো পল্টনে। তৎকালীন স্বাধীনতাপন্থী ছাত্র, শ্রমিক ও যুবকর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যায় এই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। সত্যিকার অর্থে কোন নির্বাচনী এলাকায়ও সেদিন এই স্বাধীনতা বিরোধীদের দাঁড়াতে দেয়নি তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র ও যুবসমাজ। ১৯৭০ এর নির্বাচন ছিলো বাঙালির স্বাধীনতার জন্যে জনতার রায় পাবার নির্বাচন- তাই ওই নির্বাচনের সব ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানপন্থীদের প্রতিহত করাই কর্তব্য ছিলো। কারণ, আর যাই হোক গণতন্ত্রে 'আমি স্বাধীন থাকবো না' এর পক্ষে কোন ভোট হতে পারে না। স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার, এর বিপরীতে কথা বলার, ভোট দেবার কোন সুযোগ নেই। গনতন্ত্র মানে এতটা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। বরং গণতন্ত্রে স্বাধীনতার স্বপক্ষে অস্ত্রধরা বৈধ এবং স্বাধীনতার বিপক্ষে যারা অস্ত্র ধরবে তারা যুদ্ধাপরাধী, খুনি- তাদের বিচার হবে, তাদের শাস্তি দিতে হবে এটাই বৈধ।

১৯৭০ এর নির্বাচনের আগে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার সহযোগীরা যে শতভাগ সঠিক ছিলেন তার প্রমাণ ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন স্বাধীনতার বিরোধিতা শুধু করেনি, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, নারী ধর্ষণ, পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের নারী জোগান দেয়া সহ যত কুকর্ম সব তারা করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের শুরুতেই এই স্বাধীনতা বিরোধী, নরঘাতক, ধর্ষক ও হানাদার পাকিস্তানি  সৈন্যদের নারী জোগানদাতাদের রাজনীতি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। পৃথিবীর সব দেশে এই ধরনের শক্তি ধর্মের নামে রাজনীতি করে। কেন করে তাও খুব পরিস্কার। কারণ, এই ধরনের অপশক্তির কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী থাকে না, তাই তারা সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে ধর্মের লেবাস পরে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষায় এরা 'ধর্ম ব্যবসায়ী'। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হিন্দু, মুসলিম বৌদ্ধ, খৃষ্টান যে ধর্মের নামেই যে সব শক্তি রাজনীতি করে তাদের সকলের চরিত্র একই। আর এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের শুরুতেই অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর যশোর বিজয়ের পরে, সেখানে জনসভায় দেয়া ভাষনে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশে সব ধরনের ধর্মভিত্তিক সংগঠন করার অধিকার নিষিদ্ধ করেন- যা পরবর্তীতে সংবধিানের অংশ হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে সংবিধানের এই অংশ বাতিল করা হয়। এই বাতিল করার ভেতর দিয়ে জিয়াউর রহমানের আমলে বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী এই জামায়াত শিবিরের রাজনীতি শুরু হয়।

জিয়াউর রহমানের আমল ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষশক্তির জন্যে একটি চরম দুর্দিন। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির জন্যে এমন চরম দুর্দিন আর কখনো আসেনি। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম, 'জয়বাংলা' প্রভৃতি উচ্চারণ অবধি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলো। দেয়ালে জয়বাংলা স্লোগান, বঙ্গবন্ধুর নাম লিখতে গিয়ে তখন জেলে যেতে হয়েছে, গুম হতে হয়েছে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল ছাত্র কর্মীদের। ওই দুঃসময়েও স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি কোন অবস্থান পরিবর্তন করেনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তি। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী এই শক্তিকে প্রতিহত করা, দমন করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। যে কোন পরিস্থিতিতে এদেরকে দমন করতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে। তাদেরকে যতই রাজনীতির নামে সুযোগ দেয়া হবে ততই তারা তাদের শিকড় গেড়ে বসবে ও আঘাত হানবে, ধ্বংস করার চেষ্টা করবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি তাই ওই প্রতিকূল সময়েও জামায়াত ইসলামীকে প্রতিহত করে। জিয়াউর রহমানের আমলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসে রাজনীতি শুরু করতে যায় গোলাম আযম, কিন্তু শুরুতেই প্রতিহত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার ধারক মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র জনতা। শুরুতেই গোলাম আযমকে প্রতিহত করে ঘরে তুলে দেয় মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও জনতা। বায়তুল মোকাররমে সেদিন কীভাবে গোলাম আযমকে প্রতিহত করা হয় তা আজকের প্রজম্ম সেদিনের ফটো সাংবাদিকদের কাছে রক্ষিত ছবি (যা কয়েক রিল ছিলো রশীদ তালুকদারের কাছে) দেখলে বুঝতে পারবে। কতটা ঘৃণা নিয়ে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও জনতা গোলাম আযমকে প্রতিহত করেছিলেন তা ওই সব ছবি দেখলে অন্তত আজকের নতুন প্রজম্ম বুঝতে পারবে,  তারা কতটা ঘৃণার সঙ্গে কিল, ঘুষি, জুতোর আঘাত, লাঠির আঘাত করেছিলো ওই যুদ্ধাপরাধীকে। যেন তাঁদের শিরার প্রতিটি রক্ত কণায় সেদিন উচ্চারিত হচ্ছিলো মওলানা ভাসানীর সেই আহবান, 'ঘৃণাকে জাগ্রত করো'। বাস্তবে ঘৃণাকে জাগ্রত না করলে সত্যকে চেনা যায় না। মন্দকে ঘৃণা করতে শেখার ভেতর দিয়েই ভালো বা কঠিন সত্যকে চিনতে হয়। জিয়াউর রহমানের ওই দুঃশাসনের ভেতর বসে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ৭৫ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার যোদ্ধারা প্রতিহত করে স্বাধীনতা বিরোধী এই জামায়াত  শিবিরকে।

গোলাম আযমকে প্রতিহত করার পরের ইতিহাসও কম নয়। জিয়াউর রহমান, সাত্তারও এরশাদ সরকারের পৃষ্টপোষকতায় একদিকে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আস্তানা গাড়ার সুযোগ পায় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির। প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা একের পর এক প্রগতিশীল শিক্ষক ও ছাত্রদের হত্যা করে। ১৯৭৫ এর প্রতি-বিপ্লবের উত্তরাধিকার এই সব সামরিক ও আধা সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতা বিরোধী ইসলামী ছাত্র শিবিরের ওই সব সদস্যরা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের অবস্থান নেয়। তাদের এই অবস্থান নেবার পক্ষে সেদিন আরো কাজ করে আমেরিকা ও মধ্য প্রাচ্যের অর্থ। কারণ তৎকালীন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্জনকে ধ্বংস করা, আর মধ্য প্রাচ্যের নীতি ছিলো বাংলাদেশকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানানো। এ কারণে সেদিন ইসলামী ছাত্র শিবিরের জন্যে পেট্রো- ডলারের জোগান ছিলো সীমাহীন। একদিকে ১৯৭৫ এর প্রতি বিপ্লবের উত্তরাধিকার সরকারের সহযোগীতা, অন্যদিকে পেট্রো- ডলারের জোগান এ দুই মিলে ইসলামী ছাত্র শিবির তখন ছিলো শত ভাগ অনুকূল পরিবেশে। তারপরেও নিজেদের প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে ছাত্র শিবিরকে একের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিহত করেছে বা প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে স্বাধীনতার সপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা সেদিন। যে কারণে ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এমনকি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের অসংখ্য সদস্যকে শহীদ হতে হয়েছে, পঙ্গু হতে হয়েছে শিবিরের হাতে। তারপরেও স্বাধীনতা বিরোধী এই শক্তিকে প্রতিহত করা থেকে ওই দুর্দিনে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি একটুও পিছিয়ে আসেনি। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র ভূমিতে তাদেরকে সব সময়েই প্রতিহত করেছে স্বাধীনতার স্বপক্ষ ছাত্ররা। রাতের অন্ধকারে ইসলামী ছাত্র শিবির সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলো অপরাজেয় বাংলা ভাঙতে। স্বাধীনতার স্বপক্ষ ছাত্রদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে তারা সেদিন অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিলো। আর যারা স্বাধীনতার স্বপক্ষ ছাত্র সমাজের হাতে ধরা পড়েছিলো, তাদেরকে শুধু পেটানোই হয়নি, গলায় জুতোর মালা পরিয়ে সারা ক্যাম্পাসে ঘোরানো হয়েছিলো। আর ওই সময় থেকে ৯০ অবধি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বপক্ষ ছাত্র সংগঠনের যে কোন মিছিলে স্লোগান ছিলো, 'একটা দুটো শিবির ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর'। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও ১৯৭১ থেকে আজ অবধি জামায়াত ও শিবিরের কর্মকান্ড বিচার করলে, তারা যত নরহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় ও স্বাধীন দেশে করেছে তা বিচার করলে তাদের বিরুদ্ধে এ স্লোগান অনিবার্য। এভাবে প্রতিহত করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। কারণ, তাদের মত একটি সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ ছাড়া কোন পথ খোলা থাকে না। আর দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে, স্বাধীনতার চেতনার স্বার্থে এটা অনিবার্য। ওই স্লোগান জেগে ছিলো বলেই কিন্তু স্বনামে আজো শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারেনি।

স্বনামে ঢুকতে না পারলেও ছাত্রলীগের ভুল অবস্থান ও ছাত্র ইউনিয়ন সহ বেশ কয়েকটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ভুলের কারণে কোটা আন্দোলনের ছদ্মাবেশে ' সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বাংলাদেশ' নামে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে। তাদের প্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ছাত্রলীগ, তাদের প্রবেশ করতে এখনো সাহায্য করছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। এ ব্যর্থতা ও এ ভুলের মাসুল এ জাতিকে অনেকদিন দিতে হবে। তবে দেরীতে হলেও ছাত্রলীগের কর্মী ও সাধারণ ছাত্ররা যে তাদের প্রতিহত করছে এটা দেশের স্বাধীনতার জন্যে, স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির জন্যে একটা শুভ সংবাদ। বিভ্রান্ত কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবি এই প্রতিহত করাকে সমালোচনা করতে পারেন, এটাকে নিন্দা করতে পারেন- তাতে কান না দেয়াই উচিত প্রগতিশীল ছাত্রদের। তাদের মনে রাখা উচিত আহমদ ছফার সেই বিখ্যাত উক্তি, 'ওই সব বুদ্ধিজীবিদের কথা শুনলে শেখ মুজিব কোন দিন দেশ স্বাধীন করতে পারতেন না।' বাস্তবে স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার চেতনা রক্ষা করতে হবে বীরত্ব দিয়ে। বীর ছাড়া স্বাধীনতা আনতেও পারে না রক্ষাও করতে পারে না।