শিক্ষা কেন বৈষম্য বাড়ানোর হাতিয়ার হবে?

রাশেদা কে. চৌধুরী
Published : 1 June 2012, 10:06 AM
Updated : 1 June 2012, 10:06 AM

গত মাসের মাঝামাঝিতে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো। দেখা গেছে, প্রতিবারই আগেরবারের চেয়ে ফলাফল ভালো হচ্ছে। পাসের হার বাড়ছে। এটা খুবই ভালো কথা। কারণ তাতে অপচয় কমছে। অপচয় মানে রাষ্ট্রীয় অপচয়। যদি বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করে, তাতে রাষ্ট্রের অপচয় বাড়ে।

সে দিক থেকে দেখলে পাসের হার বাড়ার বিষয়টি ইতিবাচক। প্রশ্ন হচ্ছে যে, পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের পাসের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি শিক্ষার গুণগত মান বাড়ছে?

এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা হলে তা যুক্তিপূর্ণ হবে না। পাসের হারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা আসলে বাড়ছে কিনা তা জানতে হলে দরকার বড় আকারের গবেষণা। এ ধরনের গবেষণা আগামী পাঁচ বা দশ বছর ধরে চালালে সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব।

আমার কাছে মনে হয় এমন কোনও গবেষণা হলে ফলাফলটা ইতিবাচকই হবে। এর একটা বড় কারণ সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগ। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আর পুরনো পদ্ধতির মতো মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে না। তারা চিন্তা করতে শিখছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সৃজনশীল পদ্ধতির ইতিবাচক দিকটা আমাদের শিক্ষার সামগ্রিক মান বাড়াতে সক্ষম হবে। ছেলেমেয়েরা এখন গণিতে-বিজ্ঞানে ভালো করছে। এটাও কিন্তু ইতিবাচক দিক।

পাবলিক পরীক্ষাগুলোর সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে নানা মুনির নানা মত। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের জন্য পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও নেই এটাও বলাবলি হচ্ছে। তবে জেএসসি-পিএসসির মতো পরীক্ষা নিয়ে আমরা শুরুতে যতটা উদ্বিগ্ন ছিলাম, এখন কিন্তু সে মেঘ কেটে গেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা –সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে ভয় পাচ্ছে না।

তবে আমি সবচেয়ে বেশি যে উদ্বেগের বিষয়টা দেখছি তা হলো, কোচিং-বাণিজ্য বেড়ে যাওয়া। আগে নিচের শ্রেণীতে পড়ুয়া বাচ্চাদের নিয়ে কোচিং-বাণিজ্যটা কম ছিল। এটা এখন বাড়তে থাকবে। আবার পাবলিক পরীক্ষায় ছোটমণিদের অংশগ্রহণের ফলে ভালো ফলাফলের জন্য ওদের ওপর অভিভাবকদের চাপ বাড়তে পারে। তবে এ সবই কিন্তু শহরাঞ্চলের সমস্যা। গ্রামীণ অভিভাবকরা এসব পরীক্ষা নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন নন।

কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য মাঝে সরকার বেশ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শহরের বড় বড় স্কুলগুলোর শিক্ষকরা এটা ব্যাপকভাবে করছেন। কোচিং-বাণিজ্যের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে অন্য আরেকটা সিস্টেম তৈরি হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে শিক্ষার ভিত যত দুর্বল হচ্ছে ততই এটা বাড়ছে। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, কোচিং-নির্ভর শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা যায় না। এটা বন্ধ করার জন্যও পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আগামীতে আরও হবে। আমাদের শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা এভাবে একটা একটা করে ধরে ঠিক করতে হবে।

কোচিং-বাণিজ্যের পাশাপাশি স্কুলগুলোর টিউশন ফি বাণিজ্য নিয়েও কথা বলতে হবে। সেটা আরও ভয়াবহ। এই বাণিজ্য বন্ধ করতে এ বছরের জানুয়ারি মাসে আমরা, গণসাক্ষরতা অভিযান ও ব্লাস্ট মিলে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলাম। তাতে আমরা বড় বড় বেসরকারি স্কুলগুলোতে অতি উচ্চ হারে ফি ধার্য করায় বিষয়টি কেন বন্ধ করা হবে এ মর্মে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন করেছিলাম। এর ভিত্তিতে হাইকোর্ট টিউশন ফি বাণিজ্য বন্ধের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি রিপোর্ট দিতে বলেছেন। মে মাসের মধ্যেই রিপোর্টটা শেষ হওয়ার কথা। আমরা এরপর দেখব, উচ্চহারে টিউশন ফি ধার্য বন্ধ করার ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছেন।

আমি সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন দুটি বিষয় নিয়ে। মাধ্যমিক স্তরে মেয়েরা শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে বটে। এমনিতে উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে বলে মেয়েরা ক্লাস টেন পর্যন্ত স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু এরপর এসএসসি বা উচ্চশিক্ষার লেভেলে গিয়ে ঝরে যাচ্ছে মেয়েরাই বেশি। তাই নারীশিক্ষার হারের সত্যিকারের বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া খুব স্বাভাবিক।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, শিক্ষায় বিরাট বৈষম্য। এটা কমছে না, বরং বাড়ছে। এর ফলে যে কোনও পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে সেরা ৫০ স্কুলের সবই শহরাঞ্চলের। শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সব ধরনের বিনিয়োগই বেশি। একটা জিনিস লক্ষ্যণীয়। ক্যাডেট কলেজগুলো সবসময় ভালো ফলাফল করছে। কারণ সেখানে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি। এ নিয়ে আমার আপত্তি নেই। তবে আমার কথা হলো, সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী প্রতি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে ব্যাপক বৈষম্য দূর করতে হবে। ভালো স্কুল খারাপ স্কুল বলে কিছু থাকবে না। সব স্কুলকেই ভালো স্কুল হতে হবে।

স্কুলে স্কুলে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে বৈষম্য কমলে স্কুলগুলো ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা থেকে শুরু করে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ল্যাব সুবিধা, লাইব্রেরি, বইপত্র, ইকুইপমেন্ট ইত্যাদি সব কিছুতে এগিয়ে যাবে। আমাদের গ্রাম-গঞ্জের অনেক স্কুলে ভৌত অবকাঠামোই নেই। গ্রামের বেশিরভাগ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাব সুবিধা নেই বললেই চলে। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ যদি বাড়ানো হয়, তবে সারা দেশের সব স্কুলেই মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া যাবে।

শিক্ষা হলো বৈষম্য দূর করার হাতিয়ার। তাহলে শিক্ষা কেন বৈষম্য বাড়ানোর হাতিয়ার হবে?

রাশেদা কে চৌধুরী : গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।