বড়দের অতীত বনাম নতুন প্রজন্মের শৈশব

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 15 July 2018, 11:20 AM
Updated : 15 July 2018, 11:20 AM

মনে পড়ে রুশ দেশের উপকথা, ঠাকুর মার ঝুলি, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের রূপকথাগুলোর কথা? সেই যে সুয়ো রাণী আর দুয়ো রাণী, ব্যাঙ রাজকুমার আর বুড়ো আঙলার গল্পগুলো? মনটা কেমন করে উঠলো তাইতো?

কেউ কেউ নিশ্চয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে শুরু করেছেন – ''আমাদের শৈশব কী দারুণ সুন্দর ছিল। রূপকথার জগতে ভেসে বেড়াতাম। দাদি-নানির গা ঘেঁষে গল্প শুনতাম – ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার ছুটেছে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে। এখনকার ছেলে-মেয়েরা রূপকথার মজাই বুঝলো না। তারা শুধু জানে মোবাইল টিপতে আর মারামারির গেইমস খেলতে। ''

বলি, একটু থামুন। আরেকবার গভীরভাবে ভাবুন। সৎ মা মাত্রই খারাপ – এই কথাটা সর্বপ্রথম আমাদের মনে কে ঢুকিয়েছে বলুন তো? রূপকথা। নারী হবে ফুলের মতো সুন্দর, দুধের মতো ফর্সা আর তুলার মতো নরম মনের অধিকারী – কে শিখিয়েছে? উত্তর একই – রূপকথা। আমরাও হত্যার পাঠ শিশুকালেই পেয়েছি। আর তা রূপকথা থেকেই। আমরা শিখেছি যে তলোয়ার দিয়ে এককোপে ডাইনি বুড়ির গলা কেটে দিলেই রাজকন্যাসহ অর্ধেক রাজত্ব পাওয়া যায়। তাই বলি, অতীতের সব কিছু ভালো নাও হতে পারে। আমার কন্যার জন্মের পর আবিষ্কার করলাম ছোটকালে শেখা বাংলা ছড়ার বড় অংশই ছেলে শিশুদের নিয়ে লেখা। কন্যা শিশুর কথা উল্লেখ থাকা এক ছড়ায় বলা হয়েছে 'বর আসবে এখনি, নিয়ে যাবে তখনি'। আমাদের সমাজে কতটা নির্লজ্জভাবে যুগ যুগ ধরে ছোট্ট শিশুদের মনে পুরুষতান্ত্রিকতার বীজ বপন করা হয়েছে! আর আমরা এখনো এই ছড়াগুলোকে জীবনের শ্রেষ্ঠ পাঠ বলে মনে করি!

তার মানে এই নয় যে আমি পুরনো দিনের রূপকথা, ছড়া, গান সবকিছুকে অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দিতে চাচ্ছি। অসংখ্য ভাল জিনিসের মধ্য থেকে কিছু খারাপ কন্টেন্টের উদাহরণ দিলাম মাত্র। এগুলোকে উল্লেখ করার মাধ্যমে দ্বিমত প্রকাশ করছি তাদের সঙ্গে যারা পুরনো সবকিছুকেই ভাল বলে মনে করেন। জাতি হিসেবে আমাদের অনেক বড় দূর্বলতা হলো আমরা অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকি। নতুনকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারি না। যা কিছু আমার শৈশবে ছিল তার কতটুকু সঠিক আর কতটুকু ভুল সেটা আমরা অধিকাংশ মানুষই চিন্তা করি না। শুধু বলতে থাকি এ যুগের সবকিছুই খারাপ, নতুন প্রজন্ম টিভিতে, মোবাইলে খারাপ কন্টেন্ট দেখছে, খারাপ জিনিস শিখছে। তারা উচ্ছ্বন্নে যাচ্ছে।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব কিছু পরিবর্তিত হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আমরা ছোটবেলায় তুষারকন্যা, আলাদিন, স্লিপিং বিউটি ইত্যাদি এনিমেটেড সিনেমা দেখতাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিজনীর সিনেমাতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। নায়িকারা এখন আর রাজপুত্র কবে তাকে উদ্ধার করবে সেই আশায় দিন গোনে না। তারা নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব দিতে পারে। অসংখ্য এনিমেটেড সিনেমার নারীরা ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন, তুখোড়, আত্মবিশ্বাসী। তারা গল্পের মূলচরিত্র। বর্তমান যুগ শিশুদের জেন্ডার সমতার গুরুত্ব শেখাতে চায়। এই সময়ে বসে আমাদের অবশ্যই কোন রূপকথা বা কোন ছড়া পুরুষতান্ত্রিকতার বিষ ছড়ায় সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। আধুনিক সিনেমাগুলো শিশুদের বেশি করে দেখাতে হবে। আমরা যেভাবে শিখেছি আমাদের শিশুরাও ঠিক একইভাবে শিখবে এটা খুবই সংকীর্ণ চিন্তা। আমাদের শৈশবে শেখা গল্প, গান, কবিতা অবশ্যই শিশুদের শেখাবো। তবে সেগুলো পুরনো ধ্যানধারণার বাহক কিনা সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

আমাদের মধ্যে একটি বড় গোষ্ঠী আছেন যারা শিশুতোষ বই বা সিনেমায় ভিন গ্রহবাসীর উপস্থিতি বা স্পেস শিপে চড়ে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়ানোকে পছন্দ করেন না। একটু ভেবে দেখুনতো, আগামী যুগতো হবেই মহাবিশ্বকে জয়ের যুগ। সেই যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আপনি কেন আপনার শিশুর মনের জানালাকে রাজকুমার আর রাজকুমারীতে আটকে রাখতে চান? ভিন গ্রহবাসী, রোবট, টাইম মেশিন এগুলোই এ যুগের রূপকথা। এগুলো নিয়ে শিশুরা যত ভাববে, যত কল্পনা করবে, তত তারা তৈরি হবে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী বা নভোচারী হওয়ার জন্য। এই যে সারাক্ষণ আমরা বলেই চলেছি – এখনকার ছেলে-মেয়েরা বই পড়ে না। আপনি কী অবগত আছেন যে সারা বিশ্ব থেকেই খুব দ্রুত গতিতে কাগজে ছাপানো বই, পত্রিকা ইত্যাদির চল উঠে যাচ্ছে। সবই এখন অনলাইন নির্ভর। নতুন প্রজন্ম বই পড়ে না এই হাহুতাশ থেকে বেরিয়ে এসে আমরা কি তাদের অনলাইন লাইব্রেরিগুলো থেকে কম্পিউটার বা ট্যাবে বই পড়ায় উৎসাহিত করতে পারি না? তারা এ যুগের শিশু। প্রযুক্তি তাদের মুঠোয়। তারা যেভাবে ভালোবাসে সেভাবে গল্পগুলোকে তাদের কাছে উপস্থাপন করলেইতো সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যায়।

এখনকার শিশুরা ছোটকাল থেকেই কম্পিউটার টেপাটেপি করে। তারা টেকনোলজি ভালো বোঝে। কম্পিউটার বড়দের জন্য, এটি অতিরিক্ত ব্যবহার করতে গিয়ে শিশুর চোখ নষ্ট হবে, তারা খারাপ জিনিস শিখবে, ইত্যাদি বলে তাদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করবেন না। এখন অনেক ভাল ভাল শিক্ষামূলক গেমস পাওয়া যায়। শিশুতোষ টিভি শো বানানো হয়, রূপকথার অ্যানিমেশন পাওয়া যায়। সেগুলো আমরা খুব সহজেই আমাদের শিশুদের দেখতে দিতে পারি। এক্ষেত্রে শিশুরা যেন টেকনোলজির সদ্বব্যবহার করে সে দিকে খেয়াল রাখুন। তাদের ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি শেখান। খারাপ কন্টেন্ট থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করুন। এই প্রজন্ম কম্পিউটারে গল্প লিখবে, মোবাইলে ছবি আঁকবে, তাদের মন গ্রহ-গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়ায়, টাইমমেশিনে চড়তে চায় – এগুলোই বাস্তবতা। এটাই সত্য যে অদূর ভবিষ্যতে কাগজের মলাটে বাধানো বই থাকবে না। চক-পেনসিল থাকবে না। রাজা-রাণী আর রাক্ষসপুরীর রূপকথারাও থাকবে না। কিন্তু সাহিত্য থাকবে, চিত্রকলা থাকবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাও থাকবে। সেগুলোর বিষয়বস্তু হবে অন্যরকম। এটাই জগতের নিয়ম। তাই অতীত আঁকড়ে না থেকে আমাদের নিজের চিন্তা-চেতনাকেও আধুনিক করতে হবে। নিজের শৈশবকে শিশুর উপর চাপিয়ে না দিয়ে তাকে তার সময়ের উপযোগী হয়ে বড় হয়ে উঠতে সহায়তা করুন। তাতে জাতি হিসেবে আমরা সবাই উপকৃত হবো।