স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের ‘নির্বাচন-২০১৮’

সাব্বির খানসাব্বির খান
Published : 27 June 2018, 08:02 AM
Updated : 27 June 2018, 08:02 AM

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জাতীয় নির্বাচনে কিছু ইস্যু থাকে, যা সব দলের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত হয়। 'অভিবাসন' ইস্যুটি সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। উগ্র-ডানপন্থীদের কাছে ইস্যুটি অতিমাত্রায় জনপ্রিয় হওয়ায় প্রায় দুই যুগেরও অধিক কাল ধরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংসদে তারা ক্ষমতার প্রায় কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছে। অনেক দেশে উগ্রবাদীরা পার্লামেন্টে ভারসাম্য দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সমর্থ হয়েছে। সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, জার্মানী, ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই প্রবণতা অত্যন্ত প্রকট হওয়ায় মধ্য ও বামপন্থীরা ছাড়াও উদারপন্থী দলগুলো রাজনীতিতে টিকে থাকতে উগ্রবাদীদের প্রবণতায় গা ভাসাতে বাধ্য হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই ইউরোপের বহুল পরিচিত মানবিক গণতন্ত্রের ধারা বিঘ্নিত হচ্ছে! তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উগ্র-মৌলবাদের বিস্তার লাভের মত প্রায় একই ধারায় ইউরোপেও বিস্তার লাভ করছে উগ্রবাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ইউরোপ মানবিক আদর্শের পথে ধাবিত হয়েছিল, তা যেন একটু একটু করে সেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাচ্ছে! নির্বাচনের রাজনীতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রবণতাও ঠিক ইউরোপের ধারায় ধাবমান বললে অত্যুক্তি করা হবে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমা পুঁজিবাদের আশির্বাদপুষ্ট উগ্রমৌলবাদের উত্থান ইউরোপের উগ্র-ডানপন্থীদের মতই লক্ষণীয় এবং একই মানসিকতায় ধাবমান। যে কারণে রাজনীতিতে টিকে থাকার স্পৃহায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদার, মধ্য ও বামপন্থী দলগুলোর মৌলবাদের সাথে আপোষকামী গা ভাসানোর প্রবণতাও কারো দৃষ্টি এড়ায় না!

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও উপরের কথাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক; বিশেষ করে আগামী নির্বাচনের কারণে। প্রাচীন আমল থেকেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি নির্মাণ হয়েছিল সুফিবাদ সংস্কৃতির প্রভাবযুক্ত এক মানবিক ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সেই অনুশীলিত ধর্মীয় অনুশাসনের আধুনিক রূপান্তরই হচ্ছে "ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ", যা পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে সমার্থক নয়। বাহাত্তরে বাংলাদেশে ও তারও পূর্বে ভারতের সংবিধান রচনা ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে হলেও, রাষ্ট্রীয় অনুশীলনে তা একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে বিগত বছরগুলোতে। ধর্মচর্চায় ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত অনুমোদনই হচ্ছে, "ধর্মনিরপেক্ষতা", যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থেকে ধর্ম-শাসনকে বিচ্ছিন্ন করার অনুমোদন দেয়। ধর্মীয় মৌলবাদ বাংলার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সংজ্ঞাকে বিকৃত ও মনগড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নাস্তিকতার সাথে তুলনা করার যে হীনপ্রচেষ্টা দেখিয়েছে, তা মিথ্যার বেসাতি ছাড়া আর কিছুই নয়! সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পূর্ণাঙ্গ রূপই হচ্ছে আমাদের এ অঞ্চলের 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ', যা পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সংজ্ঞা এবং চর্চা থেকে আলাদা। ১৯৭২ সালে  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, "ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দিবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দিবার মতো ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে- আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি" (গণপরিষদের ভাষণ, ১২ অক্টোবর ১৯৭২)।

পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে যে অপপ্রচার চালিয়েছিল, তার প্রধান অংশজুড়েই ছিল ভারতের সাথে ঐতিহাসিকভাবে এই দলটির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা। ভারত বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে অনেকবারই স্বাধীনতাবিরোধী এই চক্রটি বোকা বানিয়েছে বাংলার জনগণকে। তাদের অপপ্রচারগুলো ছিল এমন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দেবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছে। ভারতের প্রতি নতজানু নীতির কারণে আওয়ামী সরকার বিএসএফ দ্বারা সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে তো পারবেই না, বরং তা বহুগুণে বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যানুযায়ী তিস্তার পানি আনতে পারবে না। ছিটমহল সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তিন বিঘার যে অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে, সে অধিকার আওয়ামী সরকার আদায় করতে পারবে না ভারতের কাছ থেকে। ভারতের প্রতি নতজানু রাজনীতির কারণে ভারতীয় পরিবহণকে বাংলাদেশের ভিতরে শুল্কমুক্ত বিচরণের অনুমতি দিয়েছে… ইত্যাদি। তবে ভোটের রাজনীতিতে এই স্বাধীনতাবিরোধী দুষ্টচক্রটি সবচেয়ে বেশি যে প্রচারণা চালিয়ে বাংলাদেশের সহজ সাধারণ মানুষের মনে অমূলক ভীতির সঞ্চার ঘটিয়েছে এবং মহামূল্যবান ভোটগুলো হাতিয়ে নিয়েছে, তা হলো-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে এই দেশ আর মুসলমানদের থাকবে না, মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, আযানের ধ্বনি উচ্চারণ হবে না, সবাইকে জোর করে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হবে ইত্যাদি। স্বভাবতই সরল ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশী মুসলমানেরা ভীত হয়েছে এবং আওয়ামী বিদ্বেষী মনোভাবে জামায়াত-বিএনপিকে ভোট দিয়েছে।

নব্বই পরববর্তীতে আওয়ামী লীগ চারবার ক্ষমতায় এসেছে এবং বর্তমানেও আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মার পানি বন্টন চুক্তি হয়েছে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। তিন বিঘা জমিও বাংলাদেশ ফেরত পেয়েছে। শুল্কমুক্ত ভারতীয় পরিবহণের অনুমতি ভারত পায়নি। সীমান্তে হত্যার প্রবণতা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে এবং দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মাঝে ইতিবাচক বোঝাপড়া পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি বলেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। তিস্তার পানি বন্টনে আওয়ামী সরকারের কূটনীতি এতোটাই ইতিবাচক যে, যেকোন সময়ই এই চুক্তি হয়ে যাবে বলে শোনা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে ভারত এবং মিয়ানমারের কাছ থেকে বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছে সাগরের বিশাল এলাকা। অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপি যে প্রপাগান্ডাগুলো পঁচাত্তরোত্তর নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, সেগুলো খুব সুক্ষ্ম এবং সুন্দর ইতিবাচক রাজনৈতিক জবাব মহাজোট সরকার ইতিমধ্যে দিয়েছে।

স্বাধীনতাবিরোধীরা ভারতবিদ্বেষী অবস্থানে থেকে সুবিধা করতে না পেরে এখন বিভিন্ন পন্থায় ভারতপ্রেমী হওয়ার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি স্বাধীনতার পক্ষের সরকারকে আবারো চেষ্টা হচ্ছে 'নাস্তিক' সরকার আখ্যা দেয়ার। মৌলবাদীরা ব্লগারদের নাস্তিক হিসেবে সিল মেরে দেয়ার যে অপচেষ্টা করেছিল, তাতে তারা অনেকাংশেই সফল হয়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় এবং মদদে শুরু করেছিল ব্লগার, বিদেশী এবং লেখক হত্যা, যার পক্ষে মানুষের এক ধরণের নিরব সমর্থনও তারা আদায় করতে পেরেছিল। বিগত বছরগুলোতে জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট সফল হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের পদক্ষেপগুলোকে জামায়াত-বিএনপি জোট আওয়ামী সরকার কর্তৃক মুসলাম নিধণ কর্মকাণ্ড হিসেবে অপপ্রচার করেছে। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার এবং বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বাম দলগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীন রাজনীতিও মৌলবাদের অগ্রযাত্রাকে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে।

'ধর্মভিত্তিক রাজনীতি' মূল ধর্মের সৌন্দর্য্যকেই শুধু নষ্ট করে না, সেই সাথে কলুষিত করে সমাজ, দেশসহ গোটা জাতিকে। আদর্শিক রাজনীতির অভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে এ দেশেরই বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর হাত ধরে। একাত্তরবিরোধী শাসকরা ধর্মকে ব্যবহার করেছে তাদের অপকর্মগুলোকে প্রতিষ্ঠা দিতে। ধর্মের আড়াল না পেলে অনেক 'নষ্টামী' করা থেকে হয়ত তাদের বিরত থাকতে হতো। শাসকদের ধর্মের দোহাইগুলোর যোগানদাতা হিসেবে একচ্ছত্র ঠিকাদারী নিয়েছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলাম। সরকারের উচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিয়ে মৌলবাদ প্রতিহতের পন্থাগুলোকে খুঁজে বের করা। নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ ছাড়াও সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে ঢুকে পড়া জামায়াত-বিএনপির সদস্যদের খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরী। মহাজোট সরকারের অভূতপূর্ব উন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ গড়ার পূর্বশর্ত হিসেবে বাংলাদেশ থেকে জামায়াত-বিএনপির অপরাজনীতি দূরীকরণের কোন বিকল্প নেই!