আওয়ামী মানসের পুনঃনির্মাণ জরুরী

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 4 July 2018, 05:16 AM
Updated : 4 July 2018, 05:16 AM

"মিমিক্রি' পারফর্মিং আর্টের প্রেক্ষাপটে বেশ লোকপ্রিয় মাধ্যম কিন্তু রাজনীতিতে নয়। "মিমিক্রি' বা বিবেচনাহীন অন্ধ অনুকরণের ঘেরাটোপে পড়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ঐতিহাসিকভাবে সংস্কার বিমুখ। এই মতের সাথে মতানৈক্য পোষণ করার লোক কি খুব বেশি আছে? খুব বেশি কিছু সংস্কার না করে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল "আওয়ামী লীগ" সত্তরে পা দিতে যাচ্ছে আগামী বছরই। সংস্কার বলতে প্রতিষ্ঠাকালীন "মুসলিম" শব্দটি বাদ দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' নামকরণ ।

নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ দলটি এদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের পতাকাবাহী। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে দলটির ভূমিকা অগ্রগণ্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেন ছিল আওয়ামী লীগের আঁতুর ঘর। আত্মপ্রকাশের পর দলটির পথচলা নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না। মোকাবেলা করতে হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক শাসন, জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা রেখেছে।

শাস্ত্রমতে 'স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরধর্ম ভয়াবহ।' অর্থাৎ নিজ ধর্মে নিষ্ঠ থেকে মৃত্যু ভালো, আর পরধর্মে আশ্রয় গ্রহণ ভয়াবহ। বিষয়টি যেমন ব্যক্তির বেলায় প্রযোজ্য তেমন দলের বেলায়ও। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই একটি দর্শন বা চেতনা থাকে। প্রাধিকার সময়ে সময়ে বদলাতে পারে কিন্তু দলের দর্শন বা চেতনা-ধর্ম কখনই না। স্বধর্মচ্যুতির দ্বারা শুধু দলের না দেশেরও বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ঘরানায় বিশ্বাসী হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেই সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলের দর্শন হিসেবে ঘোষণা করেন যদিও আওয়ামী লীগের ভেতরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দলের দর্শনের বিরুদ্ধে বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছে। ডানপন্থী নেতাকর্মী তখনও দলে ছিল তবে দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের সক্রিয় প্রতিরোধের মুখে তাদের তৎপরতা ব্যর্থ হয়েছে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন ধাক্কা খায় একদলীয় বাকশাল চালু, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসন জারির ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে। উদার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও শেকড় সন্ধানী বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারন করেই আওয়ামী লীগ আজ বড় দল। আর বিপরীতে অন্য বড় অংশটি স্থানীয় সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই চরমপন্থার কারণেই ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনগুলো এই দেশে কোনো জনসমর্থন পায়নি, পাবে বলেও মনে হয় না।

পরজীবি যদি ভাল পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে তার বাড় বাড়ন্ত হয় এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি জোট সরকারের শাসন আমলে তার নজির আমরা দেখতে পেয়েছি। বিরুদ্ধ পরিবেশে পরজীবিতা টিকিয়ে রাখা কঠিন কিন্তু তারপরও আমরা দেখছি ঘোষিত অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের আমলেও জঙ্গীপনার কমতি নেই বরং যেকোন সময়ের চাইতে বেশি।

বামপন্থীদের মধ্যে আদর্শিক দেউলিয়াপনা কেবল যে তাদের নিজেদের রাজনীতিতে সংকট তৈরি করছে তাই না, এ দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতেও সংকট তৈরিতে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। বামপন্থীদের ক্ষমতা পিপাসা ও নিজেদের স্বার্থচিন্তা এ অধঃপতনের কারণ। বামপন্থীদের এই অবস্থা যে শাসক শ্রেণিকে সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন, জনগণের প্রতি কর্তব্যহীন এবং বেপরোয়া করতে সহায়ক হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। যেভাবে জবাবদিহিতাহীন সরকার একের পর এক টিকে থাকছে তার সব থেকে বড় শর্ত বামপন্থীরাই তৈরি করেছে। চিন্তার দেউলিয়াপনা ও নৈরাজ্য তাদের অবস্থাকে দাবার কমজোরি সৈন্যের মতো মানহীন গুটিতে পরিণত করেছে।

ডানপন্থীদের খুশি করতে খালেদা জিয়ার সরকার ২০০৬ সালে কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি কিন্তু হেফাজত প্রীতি শেষ হয়ে যায়নি তাতে, যে কারণে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিতে খালেদা জিয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন শরিক হওয়ার জন্য। বোঝা যায় ২০০৬ সালে বিএনপির হেফাজত ভালোবাসার কারণ ছিল ভোটের হিসাব। আবার ২০১৩ সালের মে মাসের কর্মসূচিতে সমর্থনের কারণও ছিল ২০১৪-এর নির্বাচন, যদিও সে নির্বাচনে যায়নি বিএনপি। এখন বিরোধী দলগুলোই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ করে প্রায়ই।

এবার আওয়ামী অথবা ক্ষমতার চৌম্বকে আকর্ষিত ডানপন্থী হেফাজত । চুম্বকত্ব চুম্বকের ভৌত ধর্ম, ক্ষমতাকর্ষণ তেমনি রাজনৈতিক দলের মৌল ধর্ম। ছলে কৌশলে একক অথবা জোটবদ্ধ যেকোন ভাবে ক্ষমতা নিশ্চিত করা রাজনৈতিক দলের একমাত্র উদ্দেশ্য। বাম দলগুলো আওয়ামী জোটে আগে থেকেই ছিল, ক্ষমতার হিসাব নিকাশে ডানপন্থী হেফাজত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বিবেচনায় তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে। ডান বাম দুই বিপরীতপন্থী মতাদর্শের জোট দুদিকে নিয়ে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিতের দৌড়ে আছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব যে কত প্রবল তা এবার দেশে গিয়ে দুই সপ্তাহ অবস্থানের সময় আমি টের পেয়েছি। আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম ও পুরনো রাজনৈতিক দল। তাতে নানা মতের, নানা উদ্দেশ্যের লোক থাকবেই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটি অবহেলিত থাকায় তার মধ্যে শৃঙ্খলা ও নীতিবোধ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এর ওপর আওয়ামী লীগের উপরের স্তরের নেতারাও নিজেদের ক্ষমতা ও অন্যান্য স্বার্থে প্রতি অঞ্চলে দলের ভেতর নিজেদের কোটারি তৈরি করায় সর্বত্র এই কোটারি-দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে স্বার্থসংঘাতও আছে। দেশের একটা পত্রিকায় প্রকাশিত আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এই পর্যবেক্ষণ কি খন্ডন করা যাবে?

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অবদান তুলনারহিত। রাষ্ট্র প্রকল্পে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চেতনা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আওয়ামী লীগের মতো করে ভাবে না অন্য কোনো বড় দল। আওয়ামী লীগ হেফাজতের ঐক্য ক্ষমতা পরম্পরা ঠিক রাখবে কিনা তা সময়েই দেখা যাবে। বিশ্লেষকদের ধারণা আওয়ামী লীগ হেফাজতের ভোট পাবে না। বরং যেসব মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রগতিশীল চিন্তার সেক্যুলার দল হিসেবে সমর্থন করেন, তাঁদের আস্থা হারাবে। কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রের ওপর বসিয়ে দেওয়া যাবে না এটা অনেকে ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়েও বলেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সব নাগরিকের জন্য সব ধর্মের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলনীতিও তাই। আওয়ামী লীগের নিজের ও দেশের স্বার্থে আওয়ামী মানসের পুনঃনির্মাণ জরুরী।