ঊনসত্তর বছর বয়সী বটবৃক্ষ আওয়ামী লীগ : আশঙ্কা ও সম্ভাবনা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 26 June 2018, 03:29 PM
Updated : 26 June 2018, 03:29 PM

প্রচলিত একটা কথা আছে- রাজপথে বা বিরোধীদলে আওয়ামী লীগ যতটা শক্তিশালী ও প্রবল সরকারে নাকি ততটাই দুর্বল। ধারণাটা পরিবর্তন করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তারপরও এ কথার ভিত্তি আছে বলে মনে করি। কদিন আগে ঊনসত্তর  বছরে পা রাখলো দেশের বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দল। যাঁদের আছে বঙ্গবন্ধুর মত নেতা। ইতিহাসে আরো অনেক নেতা-কর্মী বা সংগঠকদের খবর না থাকলেও এরাই দলের প্রাণ। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল দেশের প্রতিটি কোনেই যাদের অন্তত এমন একজন কর্মী আছেন যিনি দলের জন্য প্রাণ দিতে পারেন। যেটা আর কারো বা কোন দলের নেই।

ঊনসত্তর বছর দীর্ঘ সময়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সে বিবেচনায় এখন বয়সী। কিন্তু মানতেই হবে শেখ হাসিনার গত দুই মেয়াদে এই দলকে দিয়েছেন নতুন জীবন। বলা উচিত নতুন প্রাণশক্তি। সে বিবেচনায় মাঝ বয়সে ঝুলে পড়া দলটি এখন চাঙ্গা। এই চাঙ্গা মনোভাব দলকে কি দিয়েছে কি দেয়নি সে হিসেব তারা করেন কিনা জানা মুশকিল। শুরুতেই বলি আমি আওয়ামী লীগ করি না। আওয়ামী লীগ করার মত মেধা বা শক্তি কোনটাই আমার নেই। বিদেশে বিশেষত প্রবাসে যারা এই দল করেন তাদের দেখে করার চাইতে না করার দিকেই ঝোঁক আমার। কারণ আদর্শ শক্তি বিশ্বাস এসব ধুয়ে মুছে নেতারা আছেন যার যার ধান্দা আর কাজে ব্যস্ত। কে না জানে জামাতের লেজে পা দেয়ার পর থেকে শেখ হাসিনার দুশমনের অভাব নেই। তিনি সাহস ও শক্তি দিয়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। শাস্তিও দিয়েছেন। এরপর তাদের বাহ্যিক কাজকর্ম স্তিমিত হলেও তাদের গোপন কাজ থামেনি। থামবে কেন? দেশে বিদেশে অসংখ্য সমর্থক ও ভক্ত আছে তাদের। তারা এই শাস্তি মানেনি। তাদের ভেতর এখন দু'ধরণের মনোভাব কাজ করে। এক, তাদের অনেকেই সময়ের জন্য সবুর করে আছেন। যাতে বদলা নেয়া যায়। দুই, তাদের অনেকেই মনে করেন যা হবার হয়েছে এবার নতুন ভাবে এগুতে হবে। শেষের দলে যারা তারা রাজনীতি করতেই পারেন। যদি তারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাকে মেনে নেন। বঙ্গবন্ধু, ইতিহাস ও প্রগতিশীলতাকে বরণ করতে শেখেন। কিন্তু অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি সে বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। বলাবাহুল্য এর টার্গেট আওয়ামী লীগের নেতারা এগুলো বুঝলেও মানে না। তারা আছে আপন আনন্দে বিভোর।

ঊনসত্তর বছরে দাঁড়ানো দলটিতে এখন নেতার অভাব নাই। নেতায় নেতায় সয়লাব দলটিতে আসলে কর্মী আর সংগঠকের অভাব। আমরা যে আওয়ামী লীগ দেখে বড় হয়েছি তার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামরা। এরপরও আমরা দেখেছি নেতাদের মাঠ আর মন দখল করার শক্তি। একসময় সামরিক শাসনে অতিষ্ঠ মানুষের মনে আশা জাগানিয়া আওয়ামী লীগ ছিলো গণতন্ত্রের প্রতীক। আজ কি তার কোন চিহ্ন আছে আসলে? দেশে বিদেশে এক বিশাল খাই খাই গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়া জনগণের দলটি ক্রমেই তার আসল চেহারা হারিবে ফেলছে। আমি কথা বলে দেখেছি মূলত উপায়হীন মানুষের এক বিশাল আশ্রয় আওয়ামী লীগ। যারা বিকল্প পেলে কি করবেন বোঝা মুশকিল।

সরকারে থাকার সুবিধা অসুবিধা দুটোই ভোগ করছে দল। নেতাদের কথা থাক। মানুষের মনে এখন একটাই প্রশ্ন দেশ ও জাতি আর্থিকভাবে উন্নয়নের চাকায়। ব্যবসা বাণিজ্য রুটি রুজিতে দেশের অবস্থা ভালো। কিন্তু নিরাপত্তা আর সমাজের জায়গায় মানুষ অসহায়। এখন এমন হাল সমালোচনা করলেও বিপদ। তবে একটা লাভ হয়েছে বৈকি। আগে আপনি দলের সমালোচনা করলে বিপদে পড়তেন কিন্তু নেতাদের সমালোচনা করতে পারতেন। এখন হয়েছে উল্টো। নেতাদের নিয়ে বলার সময় সাবধান থাকতে হয়। দলকে আপনি চাইলে ধোলাই করতে পারেন। এই প্রক্রিয়া দলের জন্য কোনদিনও সুখকর হতে পারে না। দল শক্তিশালী থাকলে আর আস্তে আস্তে দূর্বল হলে কি হয় বা হতে পারে ভারতের কংগ্রেস এবং পাকিস্তানের মুসলিম লীগ তার বড় উদাহরণ। পাশের বঙ্গে বামেরা ত্রিশ বছর গদীতে থাকতে থাকতে বল হারিয়ে আজ এমন হীনবল যে মমতার মতো পাগলাটে মহিলাকেও তারা সামাল দিতে পারে না। অধিক সময় গদী বা ক্ষমতা আসলেই বিষ।

আওয়ামী লীগের এখন অঙ্গসংগঠন আসলে কয়টা? আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা কী দেখি? দেশের কোথাও কিছু ঘটলেই তার পেছনে থাকে ছাত্রলীগের নাম। হয়তো সব কুকাজ বা মন্দ কাজগুলো তারা করে না। কিন্তু যেভাবেই হোক যারাই তা করছে তারা তাদের নাম জুড়ে দিচ্ছে। এই দিতে পারার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে ছাত্রলীগই। তারা এই দায় অস্বীকার করতে পারে না। বিশ্বজিত্‍ দর্জি কিংবা আরো নানা ঘটনায় নিজেদের কলংকিত করা ছাত্রলীগ আজ দলের বিপদ। একসময় নাম সুনামে উজ্জ্বল ছাত্রলীগ ছিলো আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি আজ তাদের সেই ইমেজ বিগত। যেভাবেই হোক এক আগ্রাসী চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসা এই ছাত্রলীগকে কে সাইজ করবে? কোথায় সেই নেতা? সবকিছু শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে দেয়া দলকে নিয়ে ভাবনার দরকার আছে। আজকাল দেশে গেলেই শুনি চাঁদা টেন্ডার বা জুলুমের গল্প। বলাবাহুল্য এসব কিছুর পেছনে আছে রাজনীতি ও রাজনীতির গডফাদারেরা। এই গডফাদারদের চক্র থেকে আওয়ামী লীগও বেরুতে পারেনি। সবচেয়ে মুশকিল হলো কে কোথায় কী বলছে কার কী ভাষ্য বা মত সেটাও বোঝা যায় না। সমন্বয় নেই কোথাও। দল বলছে প্রগতিশীলতার কথা আর ওলামা লীগ পরদিন মাঠে নেমে বলছে পুরো উল্টো। ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন কিনা সেটাও কেউ পরিষ্কার করে না। দলের সাধারণ সম্পাদক কর্মঠ। প্রায়ই তাঁকে রাস্তায় দেখি। কিন্তু অতিকথন তাঁর বড় সমস্যা। সবাই সবকিছু নিয়ে কথা বলছে। এটা যেমন স্পষ্ট আরেকটা বিষয় খালেদা জিয়া বা বিএনপি বিরোধিতা। কার্যত অদৃশ্য এই দল আওয়ামী লীগের ছায়া শত্রু। ছায়া দুশমন আসল দৃশ্যমান দুশমনের চাইতে বড় হয়ে উঠলে বিপদ বেশী। এতে বাতাসে তলোয়ার ঘোরাতে গিয়ে অনেকে নিজেকেও আহত করে ফেলেন। বিএনপি এদেশের রাজনীতির কি লোকসান করেছে বা কতটা বিপদে ফেলেছে সেটা মানুষ জানে বলেই আজ তাদের এই হাল। তাদের কথা বলা এবং তাদের অযথা গুরুত্ব দেয়া মানে কিন্তু নেগেটিভলি তাদের পপুলার করা। সে কাজ আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়া বামেরা এমনভাবে করেন মনে হয় মাছের মায়ের শোক।

এ আরেক সমস্যা। খাঁটি নিবেদিত আওয়ামী লীগারদের চাইতে মতিয়া চৌধুরী, ইনু সাহেবরা এখন বলেন বেশী। নাহিদ সাহেবের কথাও বলি। এই মানুষটি সৎ না অসৎ ভদ্রলোক বা প্রগলভ যাই হোন না কেন তিনি আমাদের লেখাপড়া ও রেজাল্ট বিষয়টিকে এমন জটিল করে তুলেছেন যা সারাদেশে আলোচনার খোরাক। কে না জানে বাচ্চা মানেই পেছনে থাকা অভিভাবক ও পরিবার। এতে প্রভাব গিয়ে পড়ছে তাদের ওপর। যা দলের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে করি না। আমাদের অর্থমন্ত্রীও একটা বিষয় বৈকি! কবে থেকে তিনি আওয়ামী লীগার জানি না। তবে গত দু'টার্মে তাঁর কথা বিশেষত বোগাস ও রাবিশ শব্দদ্বয় মানুষকে ব্যাপক বিনোদন যুগিয়ে চলেছে। যেকোন উন্নত ও সভ্যদেশে অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন সরকার ও দলের প্রতীক। আমাদের দেশে বাজেট বা অার্থিক বিষয়ে যত প্রশ্ন আর তর্ক সব কিছু উড়িয়ে দিয়ে তিনি মূলত দলের কোন লাভ করছেন বলে মনে হয় না। বিশাল দুর্নীতি আর অনিয়মে ভেঙে পড়া ব্যাংকিং ও রিজার্ভ নিয়েও হাসি তামাশা তাঁকে মানালেও দলকে মানায় না।

আওয়ামী লীগের বিকল্প এখনো নাই। যতদিন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা আর প্রগতিশীলতা বিপর্যয়ে ততদিন তাদের বিকল্প নাই। আমার কেন জানি মনে হয় গ্রামের সেই বটগাছটির কথা। যত পুরনো হয় মানুষ তত তাকে বিশ্বাস করে তার শেকড়ে তার গায়ে এসে সুতো পেঁচিয়ে যায়। সালাম করে। বিশ্বাস বা মানত জমা রাখে। কারো পূর্ণ হয় কারো হয় না। তবু বটগাছটিই আশ্রয়। আমরা চাই না আওয়ামী লীগ সেই বিশ্বাস হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ূুক। তবে সে দুর্ভাবনা নেই একথা বলা যাবে না। ঊনসত্তর বছরে দাঁড়ানো দলটি শেখ হাসিনার পর কী করবে বা কী রুপরেখা নিয়ে আসবে সেটা স্পষ্ট করা জরুরী। যতদিন বাংলাদেশ ততদিন আওয়ামী লীগ এটা মানার পরও এমন কথা বা এর উত্তর জানা জরুরী বৈকি।

প্রয়াত আহমদ ছফার উক্তিটি মনে করবো। আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু তারা জেতে আর হারলে সারাদেশ হেরে যায়, এই কথাটা যেন মনে রাখেন তারা। নাহলে আমরা সংকট ও বিপদ থেকে রেহাই পাবো না।