বিশ্বকাপ ফুটবল কী বিষ ঢালছে?

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 26 June 2018, 06:12 AM
Updated : 26 June 2018, 06:12 AM

সপ্তাহখানেক আগে আট বছরের এক কাজিন, টেলিফোনে আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, আমি কোন দল করি? প্রশ্নটা শুনে কিছু হতবিহ্বল হলেও পরক্ষণে তার কাছে জানতে চাইলাম, কিসের দল? উত্তরে সে বলে উঠলে, ভাইয়া আপনি আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল? এরপর বুঝলাম, সে সদ্য শুরু হওয়া বিশ্বকাপ ফুটবলে আমি কোন দেশকে সার্পোট করি তা জানতে চেয়েছে। আমি ওই কাজিনের উত্তরে একটা দেশের নাম বলার আগে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কোন দল ভাল লাগে? উত্তরে সে বললো, আর্জেন্টিনা। আমি তাকে ফের জিজ্ঞাসা করলাম, আর্জেন্টিনাকে কেন তোমার ভাল লাগে? এরপর আমার কাজিন উত্তরে বললো, ভাইয়া এই দলের মেসি অনেক ভাল খেলে। মেসির দাঁড়ি আছে, সে মুসলমান তাই একজন মুসলিম হিসেবে তাকে আমি ভালবাসি। সে অনায়াসে বেশ কিছু ফুটবলার নামে বলে ফেললো। দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া আমার এই কাজিনকে ফের বললাম, মেসির পুরো নাম জানো? সে বললো না। এরপর আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, বাংলাদেশের ফুটবল দলের অধিনায়কের নাম বলতে পারবা? উত্তরে সে বললো ভাইয়া, বাংলাদেশ তো বিশ্বকাপ খেলতেই যায়নি, ওদের নাম জেনে আমি কি করবো?

শুধু আমার এই কাজিন নয়, বাংলাদেশের অনেক শিশু কিশোর বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনায় জবুথবু হয়ে নিজেদেরকে ফুটবলের সার্পোটার হিসেবে জাহির করতে গিয়ে দিনের পর দিন বিষ গিলছে। কিছু বুঝে উঠার আগে বিদ্বেষের টোপে ফুটবল জ্বরে পারদ চড়িয়ে দিচ্ছে যা সত্যি ভাবনার বিষয় হয়ে গেছে। যে শিশু নিজ দেশের ফুটবলের খোঁজ খবর রাখে না, সে শিশু-কিশোর ভিনদেশী ফুটবলের মাদকতায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। যেসব তথ্য তাদের সার্পোট করা ফুটবল টিমই জানে না, সেইসব বিকৃত তথ্যে তাদের মস্তিষ্ক শীতল হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে আক্রমণাত্মক, কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল ভাষার যথেচ্ছা ব্যবহার। একের পর এক বিকৃত মানসিকতার ট্রল। উদ্ভট ভাষায় গালিগালাজ। ভিনদেশী ফুটবল টিমের জাতীয় পতাকা নিয়ে হাসাহাসি, কাঁদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত সবাই। কী শিক্ষিত, কী কম শিক্ষিত কিংবা অক্ষরজ্ঞানহীন সবার চিন্তাশীলতার পরিধি গিয়ে মিলেছে একই মোহনায়।

আমি সত্যি বিস্মিত হয়ে যাই, যখন শুনি 'ইসরাইল-ব্রাজিলে আযান নিষিদ্ধ' যারা করে ব্রাজিল তারা হলো নাস্তিক। এমন সব বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা চলছে ফেইসবুকে। শুধু তাই নয়, অনেকে আবার  আর্জেন্টিনার পতাকাকে সামিয়ানা কিংবা প্যান্ডেলের কাপড় আর ব্রাজিলের পতাকাকে মল-মূত্রের সাথে তুলনা করতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা করছে না। যারা এরকম করছে, তারা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিংবা পাঠ চুকিয়ে দিয়েছেন।

খেলোয়াড়দের নিয়ে যেমন আছে মাতামাতি তেমনি, নোংরা ছবিতে পুরো ফেইসবুক সয়লাব। গুজব তথ্যে ভরপুর ফুটবলের চিত্রগুলো হয়ে যাচ্ছে বিচিত্র প্রকাশ ভঙ্গি। বড়দের হাত গড়িয়ে স্কুল পড়ুয়া শিশুরাও এইসব দলবাজীর তর্কে জড়িয়ে পড়ছে। মারামারি থেকে শুরু করে খুনোখুনি পর্যন্ত গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। যে শিশু ফুটবল খেলার কিছু বুঝলো না, সেই শিশুর গায়ে বাবা-মায়ের পছন্দের ফুটবল দলের জার্সি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে, যে তাদের সন্তানরাও তাদের পক্ষে। এ কেমন ভালোবাসা? যে শিশুটি বড় হবে, খেলা বুঝবে তারপর তার পছন্দের দলকে সে ভালোবাসবে, কিন্তু সেটা না করে আমাদের বাবা-মায়েরা সন্তাদের উপর অনৈতিক চাপ তৈরি করছেন।

বাংলাদেশীদের ফুটবল প্রেমে আমি দোষের কিছু দেখছি না। তবে দোষটা তখনই হয়, যখন এই খেলাকে কেন্দ্র করে, সমাজে দুর্গন্ধ ছড়ানো হয়। সমস্যা হয় তখন, যখন ভিনদেশীদের ফুটবলার কিংবা দেশ নিয়ে গুজব রটানো হয়। বিদ্বেষের বিষ লালাকারে যত্রতত্র মিশানো হয়। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী নারায়নগঞ্জে আর্জেন্টিনার তারকা লিওনেল মেসি ও ব্রাজিলের তারকা নেইমারকে নিয়ে বাগবিতণ্ডায় ছুরির আঘাতে বাবার মৃত্যু ও ছেলে গুরুতর আহত হয়েছে। এছাড়া ১২ বছর বয়সী এক কিশোর ব্রাজিলের পতাকা রাস্তার পাশের খাম্বায় টানাতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় মারামারির খবর শিরোনাম হচ্ছে। আমাদের গণমাধ্যমও এই দায় এড়াতে পারে না। তারাও দিনের পর দিন উড়ো খবর দিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে তাদের সমর্থক গোষ্ঠীদের তথ্য পিয়াস মেটানোর চেষ্টা করে। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমে সচরাচর পরিলক্ষিত হয় না।

আপনি হয়তো ভাবছেন, কেন আমাদের এতো বাড়াবাড়ি? কেন আমরা  বিশ্বকাপ ফুটবলে বাংলাদেশে বিশ্বায়নের শিক্ষা না পেয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে বা কটুক্তি করে নিজেদের মধ্যে হানাহানি-দ্বন্দ্বের মিছিল দীর্ঘায়িত করছি? তা জানার জন্য কয়েকদিন ধরে আমি জাপানে যে শহরে থাকছি সেই ওসাকার ফাঁক ফোঁকরে জাপানের জাতীয় পতাকা খুঁজেছিলাম। শুধু জাপানের নয়, অন্য কোন দেশের পতাকা আছে কিনা তাও দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু না কোথাও কিছু পেলাম না। জাপানের নিয়মানুযায়ী এই দেশের বাড়িগুলোর ছাদে উঠা নিষিদ্ধ। তাই বাড়ির ছাদে পতাকা থাকার প্রশ্নই উঠে না। এরপর পতাকা খুঁজতে অলিগলিতে ঘুরলাম, কই কিছু নেই তো। যে দেশটি এবার বিশ্বকাপ ফুটবলে বেশ রোমাঞ্চকর পারফর্ম করে চলেছে, সেই দেশে সাপোর্টারদের উৎসাহ নেই কেন? তারা কি ফুটবল বিমুখ? নাকি তারা জয় উপভোগ করতে জানে না?

প্রশ্নগুলো আমার বেশ কিছু ল্যাবমেটকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু বিনিময়ে যা পেলাম তাতে চোখ উপরে ফেলার মত অবস্থা। এরা সবাই জাপান ফুটবলের ভক্ত। অন্যদেশগুলো সার্পোট করে এমন কাউকে পেলাম না। পত্রিকার পাতার খবর পড়ে তারা ফুটবলের আদ্যোপান্ত খোঁজ খবর রাখেন। রাত জেগে হলেও এরা পরিবারের সাথে ফুটবল খেলা দেখেন। তাহলে কি বলবো, তারা ফুটবল বিমুখ? তবে আপনার আমার মতো করে এরা এইসব খেলা নিয়ে তর্কে জড়ায় না। নিজ দেশের পতাকাকে এরা বেশি ভালোবাসে। তাই অন্য দেশের পতাকাকে এরা ঘরে রাখার সাহস রাখে না। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, বিশ্বকাপ ফুটবলে যখন জাপান বিদায় নেয়, এরপর থেকে তারা বিশ্বকাপ ফুটবলেরই আর খোঁজ খবর রাখে না। তারা মনে করে, তাদের দেশ যেখানে নেই সেখানে আমরা কেন সময় নষ্ট করবো?

গেল বছর ২১১টি দেশের মধ্যে ফিফা র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৪তম বলে জানা গেছে। এককালের যে ফুটবল সারাদিন কাজ-কর্ম সেরে কৃষক-তাঁতী শ্রমিক থেকে শুরু করে সবার প্রিয় বিনোদনের মাধ্যম ছিলো, সেই বাংলাদেশের ফুটবল এখন মৃতপ্রায়। বাংলাদেশে যে পরিমাণ ভিনদেশী পতাকা এই বিশ্বকাপের মৌসুমে শোভা পায় তা সারা বিশ্বে অদ্বিতীয়। আমরা ক্রিকেটে ভাল করছি। যে পতাকা আমাদের ছাদে টানিয়ে মাতামাতি করছি, কই তারা কি কখনো বাংলাদেশের পতাকা এইভাবে ছাদে বা কার্নিশে ঝুঁলিয়েছেন?

নিজ দেশের ফুটবলকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে দেশে এখন লাখ লাখ ফুটবল বোদ্ধার আর্বিভাব সত্যি সবাইকে চমকে দিচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অংক কষে প্রিয় দলগুলোর জয়-পরাজয়ের হিসেব কষছে। তারকা থেকে শুরু করে হালের নেতা পর্যন্ত ফুটবল উন্মদনায় কাঁপছে। এটা কিসের লক্ষণ? আমরা অবশ্যই আমাদের পছন্দের দলকে সার্পোট করবো। খেলা দেখবো। সামর্থ্য থাকলে মাঠে গিয়ে দেখবো। কিন্তু এই সার্পোটের নামে সমর্থক গোষ্ঠীর বিতর্ক কখনো সমর্থন যোগ্য নয়। যে মেসি-নেইমারে স্তুতি নিয়ে আমরা মুখে ফেনা তুলছি কিংবা বিদ্বেষী আলোচনা করছি, তারা প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন। তাদের সম্পর্কগুলো অনেক মজবুত। অথচ আমরা এই ফুটবলকেন্দ্রিক  নিজেদের সম্পর্কগুলো ‍দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে আগ্রাসী হয়ে উঠছি। রক্তের চাপ বাড়িয়ে, নিজেদের প্রতি হিংসাপরায়ণ করে তুলছি। যা বিশ্বকাপ ফুটবলের মোটো হতে সম্পূর্ণ আলাদা। যে বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্ব সংস্কৃতি কিংবা গ্লোবাল ভিলিজের ডাক দিচ্ছে, তা থেকে আমরা ছিঁটকে পড়ছি।

গঠনমূলক ও বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনার চেয়ে ব্যক্তি আক্রমণাত্বক কিংবা জাতিগত বিদ্বেষের বীজ মনে বপণ করে চলেছি, তা কখনো সুখকর হতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘন্টা তর্ক করে, নিজেদের দলকে বড় করার লিপ্সায় নিজেদের ডুবিয়ে ফেলছি, তা ফুটবল উন্মদনার মধ্যে কখনো পড়ে না। এটা সেফ হীনমন্যতা ছাড়া কিছু নয়। আমাদের এই কুচর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের যে চিন্তাশীলতার ক্ষমতা রয়েছে তাকে ভালভাবে প্রয়োগ করা শ্রেয়। আমাদের ফুটবল যে রুগ্ন দশায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তাকে সচল করার দায়িত্বও আপনার আমার। ভিনদেশী ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করার চেয়ে নিজ দেশী ফুটবলে ইনসিলেটরগুলো টেনে হিঁচড়ে খুলে ফেলাও আমাদের দায়িত্ব। তাই আসুন, বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে হিংসাত্মক মনোভাব পরিহার করি।

এই ধরনের চর্চা কখনো দেশের জন্য সুখকর হয় না। কৌতুক বা মজা করার ছলে আমরা ছোটদের মধ্যে ভুলভাল তথ্যে বিলিয়ে দিচ্ছি, এবং তারা না বুঝে সেটাকে গ্রহণ করছে। যা আমাদের ভবিষতের জন্য হুমকি। আসুন আমরা বিদ্বেষের বিষ না গিলে, গঠনমূলক সমালোচনায় নিজেদের ভালো লাগা তুলে ধরি।