অ্যালিস মুনরোর `দ্য প্রোগ্রেস অব লাভ’

Zulfiker_haider
Published : 14 Oct 2013, 02:51 PM
Updated : 14 Oct 2013, 02:51 PM

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় মার্কিন লেখক জয়েস ক্যারল ওটস আলোচনা করেছিলেন এবারের নোবেলজয়ী লেখক এলিস মুনরোর The Progress of Love বইটি নিয়ে। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। অনুবাদক জুলফিকার হায়দারের তর্জমায় গুরুত্বপূর্ণ এই লেখাটি বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য উপস্খাপিত হলো।

দুটি পরস্পর সাংঘর্ষিক অথচ সম্পূরক তাড়না থেকে গল্প কথনের একটি অবয়ব গড়ে ওঠে। সে যুগল তাড়নার একটি চায় শব্দের মিতব্যয়িতা, ভাবের ঠাঁসবুনন আর শৈল্পিক সংযম, অন্যটি চায় ভাবের বিস্তার, সম্প্রসারণ আর বর্ণনার ঐশ্বর্য। এর একটির শ্রমসাধ্য চর্চার মধ্যদিয়ে জন্ম হয় নাতিদীর্ঘ, অতি বিমূর্ত নীতিকথা-সদৃশ রচনা, আর অন্যটি থেকে জন্ম নেয় পরিপূর্ণ উপন্যাস অথবা মহাকাব্য। কোনো কোনো গল্পকার নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠেন, আবার কেউ কেউ শুরুতেই তার মোক্ষম কণ্ঠটি চিনে নিয়ে সে কণ্ঠস্বর উপযোগী একটি যুৎসই কাঠামো নির্মাণ করে আজীবন মোটামুটি একই ধারায় লিখে তুষ্ট থাকেন। সেই লেখাটি যখন ভালো হয়, নীরিক্ষার প্রতি লেখকের ঔদাসীন্য নিয়ে কেউ তখন আর হা-হুতাশ করেন বলে মনে হয় না। আর লেখাটি যখন অতি ভালো হয়, তখন বিষয়টি হয়তো আর কেউ আমলেও নেন না।


তার সমসাময়িক ও সমান প্রতিভাবান অন্যান্য লেখক যেমন পিটার টেইলর, উইলিয়াম ট্রেভর, এডনা ও'ব্রায়ান বা আরও দু-একজনের মতো কানাডীয় গল্পকার অ্যালিস মুনরোর ছোট গল্পগুলো অন্যান্য ঔপন্যাসিকদের গভীরতাকে ধারণ করে আছে– সে গভীরতা নৈতিক, আবেগী আর কখনও-বা ইতিহাসের। অধুনা 'মিনিম্যালিস্ট ফিকশন' নামে পরিচিত ধারাটির প্রকরণ ও অভিলাষ থেকে যতদুর সম্ভব দূরে থেকেও সেই একই ঘরানার টুঁটি চেপে ধরে এই লেখকেরা আমাদের উপহার দিয়েছেন সেসব কাল্পনিক জগত, যে জগত অতিশয় বাস্তব জগতের নিপুণ প্রতিরূপ অথচ এরপরেও সেসব কল্পনাশ্রয়ী রচনাশিল্পের এত নিশ্চিত এক সুষমায় মোড়ানো যে, একে শিল্পমূল্যবর্জিত বলে ভুল হতে পারে। বচন-বাচনের সহজাত ছন্দকে লেখকসুলভ কথনরীতির অতি বিশুদ্ধতার কষ্টিপাথরে ঘষে এরা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের কণ্ঠস্বরকে প্রতিধবনিত করেছেন। এরা নিজ নিজ এলাকার কিংবদন্তি, দীর্ঘ গাঁথা, কাহিনি, পারিবারিক স্মৃতিকথার জটিল রূপরেখার প্রতিও বিশ্বস্ত থাকেন, আর এদের লেখালেখির বিষয়বস্তু প্রায় সর্বদাই থাকে বাস্তব। এ যেন সেই বাস্তবতা, উনিশ শতকের মাঝামাঝি আর শেষভাগে এসে 'বাস্তববাদ'-এর যে ধারাটিকে তার প্রতিদ্বন্ধীরা ঝেড়ে বিদেয় করেছিল, আর এদের গল্পের চরিত্রগুলোর আচরণ স্বভাবত বাস্তবের মানুষজনের মতো। তার মানে এরা আমাদের ঘটনার বাঁকে বাঁকে চমৎকৃত করেন সম্ভাব্যতার সীমানাকে অতিক্রম না করে। এরা এতটাই আমাদের মত যে এদের সম্পর্কে পড়তে যাওয়া কখনও কখনও আমাদের আবেগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বটে। নান্দনিক বিবেচনায় নীরিক্ষামূলক সাহিত্য আমাদের মনে প্রশংসার উদ্রেক করলেও তা খুব কমই আমাদেরকে এতটা নাড়া দিয়ে যায় যেমনটা এ ধরনের সাহিত্যকর্ম পারে।

১৯৬৮ তে কানাডিয় প্রকাশনি থেকে ছোটগল্প সংকলন Dance of the Happy Shades-এর প্রকাশনা দিয়ে মুনরোর লেখক জীবনের সূচনা (এ বইটি ১৯৭৩ সালে আমেরিকা থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল)। সেই থেকে শুরু করে এর পর একে একে তিনি লিখে গেছেন Lives of Girls and Women, Something I've Been Meaning to Tell You, The Beggar Maid, The Moons of Jupiter আর নতুন সংকলন, The Progress of Love। প্রথম গল্পগ্রন্থ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত অ্যালিস মুনরো নাতিদীর্ঘ গদ্য রচনায় মনোনিবেশ করেন যাতে তিনি একেবারেই অখ্যাত নর নারীর জীবনকে – বিশেষত ওন্টারিওর দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের নারীকে চিত্রায়িত করেছেন। Miles City, Montana গল্পে দেখা সেই দম্পতির মতো তার চরিত্ররা যখন অন্যত্র বসবাস করে তখনো তাদের হৃদয়জুড়ে জেগে থাকে ওন্টারিও, তাদের ঘর। যদিও বিগত কুড়ি বছরে মুনরোর গল্পের ভাববৈচিত্র বেশ খানিকটা ধুসরতায় আক্রান্ত, তবে তার গদ্য বলার ধরনটি খুব একটা বদলায়নি, যেমন বদলায়নি তার চরিত্ররা। সময়ের হিসেবে নিশ্চই তারা পুরনো হয়ে গেছে। এদের বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে লেখকের প্রথমদিককার একটি গল্প "Walker Brothers Cowboy" (Dance of the Happy Shades) তে বর্ণিত অবশ্যম্ভাবি পরিণতি যেন পূর্ণতা খুঁজে পায়ঃ "আমি আমাদের গাড়ী থেকে সবশেষ বিকেলে পেছনের দিকে বয়ে আসা অন্ধকারে নিমজ্জমান আর অদ্ভুত অবয়বধারী আমার বাবার জীবনকে অনুভব করি, অনেকটা একখন্ড ভূমির মতে যার একটা জায়গা উঁচু হয়ে আছে, যতক্ষণ তুমি একে দেখেছ সে যেন করুণাভরে নিজেকে পরিচিত আর সাধারণ করে রেখেছে, কিন্তু যেইমাত্র তুমি ঘুরে দাঁড়িয়েছ, সে তাকে বদলে ফেলল এমন কিছু একটায় যে তুমি কখনো জানবে না, সব ধরনের আবহাওয়া আর দূরত্বের জন্য তুমি তা ভাবতেও পারবে না।"
The Progress of Love গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ১১টি গল্পের সবচে শক্তিশালী গল্পগুলোর সরাসরি উপজীব্য মূলত মরণশীলতা, আত্মপ্রতারণা আর নিয়তির ব্যাখ্যাতীত পরিহাসে সৃষ্ট চিত্ত-প্রহেলিকা ।

"A Queer Streak" শীর্ষক গল্পটি ভায়োলেট নামক এক উচ্চাভিলাশী তরুণীর এক বেদনাময় হাস্যরসাত্মক (অথবা হাস্যরসাত্মক বেদনাময়) উপাখ্যান। যৌবনে "হলি টেরর" হিসেবে খ্যাত এই নায়িকার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে তার এক মানসিক বিকারগ্রস্থ ছোট বোনের উদ্ভট আচরণে। ভায়োলেট এক পরিচিত লোভের ফাঁদে আটকে যায়, তার ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়, প্রেমিকের চলে যাওয়া তার জীবনের কোনো দুর্দশা নয় বরং সুবর্ন সুযোগ। সেই থেকে সে নিজের জীবন উৎসর্গ করে অন্যের জন্য বেঁচে থাকে। "এভাবেই ভায়োলেট তার বেদনাগুলোকে পেছনে পড়ে থাকতে দেখে। তার বুক থেকে একটা ভার নেমে যায়। যদি সে নত হতো আর তার আপন সত্বাকে আর তার জীবন কেমন হতে পারতো এসব ভাবনাকে আড়াল করে রাখত, সেই ভার, সেই কষ্ট, আর সেই অপমান সব জাদুর মতো মিলিয়ে যেত। আর তাকে এখনও কারো ভালো লাগতে পারে.. .. .. যদি সে যথেষ্ট প্রার্থনা করে, যদি সে যথেষ্ট চেষ্টা করে, সেটা সম্ভব হতেও পারে।" কিন্তু যেমনটি দেখা যায়- এই আত্মস্বীকারের মুহূর্তটিই ভায়োলেটের জীবনে সবচে তাৎপর্যময় হয়ে থাকে।