আব্বু তুমি কানতেছো যে

ওমর শেহাব
Published : 2 Dec 2011, 04:29 PM
Updated : 10 June 2018, 06:02 AM

আমি চট্টগ্রামের মানুষ। আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা একটু দুষ্টু প্রকৃতির তারা দাবী করে আমরা নাকি কথায় কথায় "যে" বলি। আমরাও নিয়ম করে সাথে সাথে এর তীব্র প্রতিবাদ করি। কিন্তু সমস্যা হল এই প্রতিবাদের ভাষাতেও টুক করে দুই একটি "যে" ঢুকে যায়। টেকনাফের যুবলীগ নেতা একরামুল হকের বাচ্চা মেয়েটি যখন ফোনে বলছিল "আব্বু তুমি কানতেছো যে" আমি কেন যেন তার সাথে এক অদ্ভুৎ আত্মীয়তা অনুভব করলাম। আমার আর ওর বাংলায় একই আঞ্চলিক টান! আমার পুরো রেকর্ডটি শোনার সাহস বা মানসিক শক্তি হয় নি, কিন্তু আমার স্ত্রী শুনেছে। খেয়াল করে দেখলাম ও এবং আরো অনেকে যারা শুনেছে তারা এরপর এক ধরনের বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। কোন ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, প্রতিবাদ নেই, কেবল বিষাদময় শূন্যতা। এই শূন্যতা বলে দেয় মৃত্যুর ঠিক আগে একরামুল হকের সাথে তার মেয়ের কথাগুলো যারাই পুরোপুরি শুনেছে এই সমাজ, এই দেশ, এই রাষ্ট্রের উপর থেকে তাদের আস্থা পুরোপুরি উঠে গেছে। কোনকিছুই আর কোনদিন ভালোর দিকে যাবে না।

আমি নিজে তাদের মধ্যে পড়ি না, কেন পড়ি না তাও জানি না। খুব সম্ভবত: নিজের বেঁচে থাকা একটু যৌক্তিক আর অর্থবহ করার জন্যই আশাটুকু কখনও ছাড়তে পারি না। এই আশাবাদ আসলে এক ধরনের স্বার্থপরতা। আমি দেশ নিয়ে আশাবাদী কেবল নিজের কারণে। কারণ এটি ছাড়া আর আমার একদম নিজের মত কোন জায়গা নেই। কিন্তু এই স্বার্থপর আশাবাদ নিয়ে আমার একরামুল হকের বাচ্চা মেয়ে বা ওর মত আর যারা আছে তাদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব না। তাই আমি ভাবছি কেন এমন হল, আর কতদিন এমন হতে থাকবে।

আমার প্রথম দুঃখ পত্রিকাগুলো নিয়ে। এরা এখনও এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ক্রসফায়ার বলে যাচ্ছে। এর কারণটি আমার মাথায় কখনই ঢুকে না। আমরা সবাই জানি "ক্রসফায়ারে" কোন বন্দুক যুদ্ধ হয় না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোন একটি অঙ্গ একজনকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর তাকে মেরে ফেলে। এরপর মৃতদেহের আশে পাশে অস্ত্র, গুলি এসব রেখে প্রমাণ সাজায়। তারপর পত্রিকায় তারা জানিয়ে দেয় ওঁত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তাদের আক্রমণ করেছিল। তাহলে আমরা সবাই যেটি জানি সেটি পত্রিকায় লিখতে সমস্যাটি কোথায়?

এর মানে কিন্তু এই নয় যে কখনই অভিযানে যাওয়া আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর আক্রমণ হয় না। গত কয়েক বছরে যখনই তারা জঙ্গীদের ধরতে গেছে তখনই তাদের উপর আক্রমণ হয়েছে। সবসময়ই, এমন কি গভীর রাতেও, আশাপাশের লোকজন বুঝতে পেরেছে সত্যিই কিছু একটা হচ্ছে। কখনই পুলিশের প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বুঝাতে হয়নি ওঁত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছে।

এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু হয়েছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের নামে। যেহেতু আমরা মাস্টারি করি একটি ব্যাপার আমরা খুব ভাল জানি। ছাত্রছাত্রীরা যদি বাড়ির কাজ জমা দেয়ার ঠিক আগের রাতে শুরু করে তাহলে তারা গোল্লা পায়। যে বাড়ির কাজ তিন দিনের পরিশ্রম হিসেব করে আমরা দিয়েছি কেউ সেটি আগের রাতে দুই ঘন্টায় করে ফেলবে এটি প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায়। নয় বছর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে নির্বাচনের আগে এসে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সেটি ঠিক মত হওয়ার কথাও নয়। এতো শুধু মাত্র একটি দিক। এর পরের কথা হল মাদক ব্যবসায়ীদের আইন অনুযায়ী ধরবে, তদন্ত করবে, শাস্তি দিবে, নিয়ম অনুযায়ী তো এটাই মাদক নিয়ন্ত্রণ হওয়ার কথা।

কিন্তু সেটি না করে তাদের অপহরণ করে মেরে ফেলে হবে কেন? আমরা তো গোলাম আজমকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছি। এতদিন ধরে শাহবাগ আন্দোলন চলল, পাশেই পিজি হাসপাতালে গোলাম আজম বন্দি, কই কেউ তো একবারও বলেনি হাসপাতালে গিয়ে তাকে মেরে ফেলি? একজন মাদক ব্যবসায়ী কি গোলাম আজমের চেয়েও খারাপ? সংবিধান সবাইকে ন্যায়বিচার চাওয়ার ও পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। যে সরকার আজকে একজন অপরাধীকে তার সংবিধানসম্মত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কালকে সে একজন ভাল মানুষকেও তার সংবিধানসম্মত অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলতে পারেন মাদক ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষমতাশালী, তাদের শেকড় অনেক গভীরে, নিয়ম মেনে ধরতে গেলে ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তাদের প্রতি আমার একটাই প্রশ্ন – গত নয় বছরে আপনারা তাহলে কি করলেন?

যখন মানুষ এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করল তখন প্রথমে প্রধান মন্ত্রী বললেন একটা ভাল কাজের কেন সমালোচনা করা হচ্ছে। আমি জানিনা এখানে ওনার ঠিক কোন জিনিসটি বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। কেউ একবারও বলেনি মাদকব্যবসায়ীরা ভাল মানুষ। সবাই যে বলছে সেটি হল সংবিধান লঙ্ঘন করা খারাপ। আমি আরো পরিষ্কার করে বলি –

সংবিধান লঙ্ঘন করা মাদকব্যবসার থেকেও খারাপ। একজন মাদক ব্যবসায়ী শুধুমাত্র মাদকসেবী আর তার পরিবারের ক্ষতি করে। একজন সংবিধান লংঘনকারী দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের ক্ষতি করে।

আমি এরপর আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা পুলিশ আছে তাদের একটু জিজ্ঞেস করেছি। শুনলাম র‌্যাবে নাকি প্রতিরক্ষাবাহিনী থেকে লোক নেয়া হয় যাদের আইন প্রয়োগের প্রশিক্ষণ নেই। সেটি অবশ্য আগে একবার কেন ডিবি অফিসের ছাদে মানুষের লাশ পাওয়া গিয়েছিল তার কোন ব্যাখ্যা দেয় না। যেহেতু সরকারের উপরের পর্যায় এভাবে মানুষ মেরে ফেলাকে খারাপ মনে করে না, দুই বড় রাজনৈতিক দলই এটিকে সমর্থন করে, এমনি এমনি এটি বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। আইনে যদি কোন ফাঁকফোকর থাকে সেটিও কোন সাংসদ বন্ধ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন বলে মনে হয় না কারণ তাদের মাথায় এখন নির্বাচন ছাড়া আর কিছু নেই। পুলিশের জন্য সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হল দুই দিন পরই ঈদের পাঞ্জাবীর বিজ্ঞাপন তাদের এসব অন্যায়কে পত্রিকার পাতা থেকে সরিয়ে দিবে।

আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে আইনশৃংখলা রক্ষাকারীর একজন সদস্যের ভুলে একরামুল হকের হত্যার প্রতিটি মুহূর্ত রেকর্ড হয়ে গেছে। যারাই শুনেছে তাদের গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেছে যখন দেখেছে ঠান্ডা মাথায় লাশের আশেপাশে বুলেট সাজানোর নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। আমি এখনও পুরো অডিওটি শুনিনি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কারো সাথে যদি আমার কোনদিন পরিচয় ও দেখা হয় তার সাথে  বসে প্রথমবারের মত এটি পুরোটা শুনার ইচ্ছে আছে।