মাদক অভিযান সম্পর্কে ইউএনওডিসির বিবৃতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ডা. মো. খায়রুল ইসলাম
Published : 5 June 2018, 08:04 AM
Updated : 5 June 2018, 08:04 AM

মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানের কথা প্রথম শুনি আমার এক সহকর্মীর কাছে প্রায় এক দশক আগে। এই প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর ভিয়েনাতে। সেখানে চাকুরী সুবাদে আফিমের বিশ্বব্যাপী উৎপাদন নিয়ে তাঁকে সমীক্ষা করতে হতো। আফগানিস্তানে আফিম উৎপাদন কমে গেলে নিউ ইয়র্ক জাতীয় বড় বড় শহরে আফিম ও তার উপজাত মাদকের দাম বেড়ে যায়; সাথে সাথে বেড়ে যায় অপরাধ। ধনী রাষ্ট্রগুলোর জন্য মাদক দুধারী তলোয়ার। অপরাধকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে হলে মাদকের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখতে হয়; আবার মাদক বিরোধী অভিযানের মাধ্যমে মাদকের উৎপাদন কমানোর চেষ্টাও তাঁকে করতে হয়। বিষচক্রের মতো দ্বিতীয়টিতে আবার মাদকের দাম বেড়ে যায়। তাই সরবরাহের উৎস নিধনের পাশাপাশি মাদকের চাহিদা কমানোর জন্য নানা ধরনের সামাজিক পদক্ষেপও নিতে হয়; তবে সেগুলোর ফল পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। কিছুকিছু দেশ কঠোর আইন, তাঁর নির্মম বাস্তবায়ন আর নজরদারীর মাধ্যমে মাদকের লাগাম টেনে ধরে রেখেছে সহনীয় পর্যায়ে; মালয়েশিয়া, চীন কিংবা সিঙ্গাপুরের উদাহরন এ ক্ষেত্রে দেয়া যেতে পারে।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে জাতিসংঘের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে অনানুষ্ঠানিক কথা বলার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। প্রাসঙ্গিকভাবেই কথোপকথনে মাদক বিরোধী অভিযানে মানবাধিকারের লংঘনের বিষয়টি এসেছে। আমি জানতে চেয়েছিলাম যে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত এই প্রতিষ্ঠানটি জীবিত আছে কিনা । পহেলা জুন ভিয়েনা থেকে ইস্যু করা বিবৃতি থেকে বোঝা গেল – তাঁরা জীবিত আছেন। খুব ছোট্ট এই বিবৃতিতে তাঁরা মাদক নিয়ন্ত্রনে মানবাধিকার ভিত্তিক পদক্ষেপ এবং মাদক নিয়ন্ত্রন সংক্রান্ত অন্যান্য তিনটি কনভেনশনের কথা সকল সদস্য রাষ্ট্রকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য বিবৃতির মুখবন্ধেই বলা হয়েছে যে বিবৃতিটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মাদক বিরোধী অভিযানের প্রেক্ষিতে দেয়া।

১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানটি আমার বন্ধুকে চাকুরি দেয়া ছাড়া বাংলাদেশের জন্য আর কি করেছে তা জানতে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়। গুগুল সার্চে পেলাম, গতবছর মার্চে এই প্রতিষ্ঠানের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে তাঁর আনুষ্ঠানিক পরিচয় জানিয়ে গেছেন; আর একটি সেমিনারে পররাষ্ট্র সচিবের সাথে ডায়াসে বসে বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। আমার খটকা বিবৃতির দ্বিতীয় বা শেষ অনুচ্ছেদ নিয়ে । ইউএনওডিসি সকল রাষ্ট্রের সাথেই সম্পৃক্ত হবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে – যাতে দোষী ব্যক্তিদেরকে আইনী সুরক্ষা দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের সাথে সঙ্গতি রেখে বিচার করা হয়; এবং পরীক্ষিত প্রতিরোধ, নিরাময়, পুনর্বাসন ও সমাজে আত্মীকরণের কাজ করা যায় । আমার মনে এলো পুরোনো প্রবচন – ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল মারার গোঁসাই।

ইউএনওডিসির মূল যে সব কাজ আছে – সেগুলোর তালিকা তাঁদের ওয়েবসাইটেই দেয়া আছে । বিবৃতির শেষ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত কাজটি অনেক কাজের একটি। কিন্তু ইউএনওডিসির অন্যতম মূল কাজ হলো সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে মাদক সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে বিচার বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রকে মাদক নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করা । যেমন, ইয়াবা বানাতে যে মূল উপাদান লাগে সেটি একটি দেশ কি পরিমাণ আমদানী করছে বা দেশজ উৎপাদন হচ্ছে তার তথ্য যোগাড় করা, আর সে ওষুধটি যদি সে দেশে আইনসিদ্ধ হয় – তাঁর অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য কি পরিমান কাচামাল লাগবে, রপ্তানীর জন্য কি পরিমাণ লাগবে; রপ্তানীর আদেশ আছে কিনা; প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আমদানী হচ্ছে কিনা, হলে সে ওষুধ কিভাবে বাজারজাত হচ্ছে সেসব তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রগুলোকে সাহায্য করা। একইভাবে এই উদাহরণ দেয়া যেতে পারে – ফেনসিডিল উৎপাদন নিয়ে । ইউএনওডিসির ওয়েবসাইটে এসকল তথ্য সংক্রান্ত সবশেষ প্রতিবেদনটি ২০১৪ সালের; প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। সেখানে মিয়ানমার সরকারের প্রশংসা আছে যে মাদকের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমানোর কাজে সরকার বেশ ভালো করেছে । কিন্তু সেদেশে যে অভ্যন্তরীণ চাহিদার কয়েকগুণ বেশী ইয়াবার কাচামাল আমদানী করা হচ্ছে তা নিয়ে কোন হিসাব নেই, উদ্বেগ নেই । একই ভাবে উদ্বেগ নেই বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে ভারতীয় ওষুধ কারখানা নিয়ে যেখানে মূলত ফেনসিডিল বানানো হয়। সেগুলো কোথায় বাজারজাত করা হয় – তা নিয়ে নেই কোন গবেষণা; তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ । এই প্রতিষ্ঠান উন্নত বিশ্বের প্রয়োজনে আফিমের উৎপাদন নিয়ে চিন্তিত । কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ সমাজ যে মাদকে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে কোন তথ্য উপাত্ত সরবরাহ করা, সরকারকে সাবধান করা, সামান্যতম উদ্বেগ বা বিবৃতি কিংবা কোন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ইউএনওডিসি আলাপ করেছে – তা আমরা শুনিনি । ওষুধ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজে সচরাচর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাহায্য করে । মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁদের অনেক উদ্বেগ আছে; কিন্তু মাদকের চাহিদা কমানোয় তেমন কোন কর্মসূচি নেই, সহায়তা নেই । বাংলাদেশের বড় বড় ওষুধ কোম্পানির সবচেয়ে বড় বা অন্যতম বড় বিক্রয়কেন্দ্র কেন কক্সবাজারে সেই বিশ্লেষণও আসেনি । ইউএনওডিসি বাংলাদেশের জন্য হয়তো এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু করেনি। তবে, আশার কথা, কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙেছে; আশা করি যুদ্ধে এবার সে সামিল হবে ।

এই প্রেক্ষিতে আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই । বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সশস্ত্র সন্ত্রাসকে নিয়ন্ত্রনে এনে ভারতকে স্বস্তি দিয়েছেন । তিনি তা অকপটে বলেছেন । আমরা মাদককে সন্ত্রাস বলছি; তাহলে ভারতের কাছে সীমান্ত এলাকায় ফেনসিডিল ও অন্যান্য মাদক উৎপাদন নিয়ন্ত্রন করার মাধ্যমে মাদক সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রনে ভারতের সহায়তা কেন চাইছি না? গরু নিয়ন্ত্রন করতে পারে, মাদক নিয়ন্ত্রন করতে পারবেনা কেন? কোন সাংবাদিক কি এই প্রশ্নটি প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সাংবাদিক সম্মেলনে করতে পারতেন না? মিয়ানমারের কাছেও এই নিয়ে দেনদরবার করা যায় । রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার কতদিন লাগাবে তা বলা মুশকিল । তবে ভারত চীনের সহযোগিতায় মাদক নিয়ন্ত্রনে মিয়ানমারের সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব। উৎপাদন কারখানা উচ্ছেদ না হলে সরবরাহ কোন না কোন ভাবে হবেই । এই প্রসঙ্গগুলো প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে উত্থাপন করা যেতে পারতো। অবশ্য, প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে যা হয় তাতে করে তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলন না বলে অন্য কোন উপযুক্ত সম্মানজনক নামে (যেমন প্রীতি সম্মিলন) অভিহিত করাই শ্রেয় । এতে করে মানীদের মানও রক্ষা পাবে; সাংবাদিকতার মানও বজায় থাকবে ।

ইউএনওডিসির কাজকর্মে কিঞ্চিত হতাশা ব্যক্ত করলেও মাদক নিয়ন্ত্রনে তাঁদের বাতলানো পথনির্দেশিকাগুলো বেশ সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ। আমরা যারা দেশ, জাতি ও সরকারকে মাদক নিয়ে প্রতিনিয়ত জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছি তাঁদের এগুলো পড়ে দেখা দরকার।