মাদক নির্মূল চাই তবে …

সৌরিন দত্ত
Published : 4 June 2018, 11:49 AM
Updated : 4 June 2018, 11:49 AM

এলিট ফোর্স র‍্যাবের আগমন আমাদের জন্য ছিল এক মহা আশীর্বাদ। যেসব আসামীর ভয়ে কেঊ সাক্ষী দিত না বলে অনেক মামলা থাকা সত্ত্বেও তারা খালাস পেত প্রমাণের অভাবে আর তারপর আবার নব উদ্যমে অপরাধ শুরু করত সে সব আসামীরা বুঝতে শিখল , সব অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। আমরা বুঝতে শিখি সন্ত্রাসী গডফাদাররাও ভয় পায়। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয় যখন দেখি সেই র‍্যাবই তালসরা দরবার শরীফের টাকা লুট করে, কিংবা নারায়নগঞ্জে সেভেন মার্ডারে জড়িয়ে পড়ে। আমরা ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলি আমাদের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা। যে র‍্যাব ভয়ংকর সব অপরাধীকে দমন করেছে, সেই রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায়। আমরা হঠাৎ সন্দেহ করে বসি,আচ্ছা কোনো নিরপরাধ লোককে নিয়ে র‍্যাব কোনদিন অস্ত্র উদ্ধারে যায়নি তো যেখানে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা কিছু লোক গুলি চালালে সেই নিরীহ লোকটি মারা গেছে ? এই সন্দেহ আমাদের মনে ক্রমশঃ ডালপালা ছড়াতে থাকে। আমরা হাজার অপরাধীকে শাস্তি দিতে গিয়ে যদি একজন নিরপরাধকে ভুল করে মেরে ফেলি, পৃথিবীর সব সম্পদ দিয়েও তাকে ফেরত আনতে পারব না। আর তাই আইন সবসময় চেষ্টা করে কোনো নিরপরাধ যাতে শাস্তি না পায় এমনকি তাতে কোন দোষী সুবিধা পায় পাক কিন্তু আমাদের নিশ্চিত করতে হবে নিরপরাধ যেন নিরাপদ থাকে।

সম্প্রতি শুরু হওয়া আইন শৃংখলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে দৃশ্যত সারা দেশে একটি মেরুকরণ হয়েছে। কেউ কেউ যখন এই অভিযানে খুশী তখন কেউ কেউ বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড নিয়ে বিচলিত। কেউ কথিত মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যুতে খুশী তো কেউ মানবাধিকার নিয়ে বিচলিত। মাদকের নীল ছোবলে যেসব পরিবার বিপর্যস্ত, তারা জানে সেই দংশনের জ্বালা । কিন্তু র‍্যাবের হাতে নারা্যনগঞ্জে নিহত হওয়া সাত জনের মধ্যে একজন ছিল ড্রাইভার যে শুধুমাত্র জীবিকার তাগিদে গাড়ি চালাত, যার কোন অপরাধ ছিল না। আজ পুরো সরকার, জনগন সবাই তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দিলেও আমরা সে ড্রাইভারকে এনে তার স্ত্রীর পাশে বসাতে পারব না। মাদকবিরোধী অভিযানে যারা মারা গেছে তারা সবাই কি সমপরিমানে অপরাধী? নিহত সবার অপরাধের উদ্দেশ্য, মাত্রা বা অপরাধের ইতিহাস কি এক ?  যদি তা না হয় তবে সবার শাস্তি কেন একই?

অপরাধ বা ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আরেকজনকে বলির পাঁঠা বানানো এক অতি পুরানো প্রবণতা। মাদক কোনো আকাশ থেকে পড়া বস্তু নয় – এটি অর্থনৈতিক কার্যাবলীর এক ক্লাসিক্যাল উদাহরণ যেখানে সম্পদের উৎপাদন, সরবরাহ এবং বন্টন চলে। অপরাধের প্রতিটি ধাপকে পাহারা দেয়ার জন্য রয়েছে সীমান্ত রক্ষী দল, আইন রক্ষাকারী সংস্থা এবং তাদের সহায়ক প্রতিষ্ঠান। মাদক গ্রহণকারীর হাত পর্যন্ত মাদক পৌঁছানোতে এনাদের অপারগতা , নিষ্ক্রিয়তা বা সহায়তা অবশ্যই আছে। এমনকি মাদকের ব্যবসা করে যে প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছে, তার সম্পদের তালিকা বা আয়ের উৎস তদন্ত না করার জন্য আয়কর বিভাগেরও কি দায় নেই? দুদক কি তাদের সম্পদ নিয়ে তদন্ত করে? অপরাধী শাস্তি পাক কিন্তু শুধু এক অপরাধী কেন শাস্তি পাবে? এক অপরাধীর লাশের উপর দিয়ে অন্য অপরাধীরা কেন সম্পদের পাহাড় গড়বে? মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন – injustice anywhere is a threat to justice everywhere.

বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড পৃথিবীতে আজ এক বাস্তবতা। আন্ডারওয়ার্ল্ড দমনে মুম্বাই পুলিশের এনকাঊন্টার বা খালিস্তান আন্দোলন দমনে পাঞ্জাব পুলিশের মডেল এখন অনেক দেশই অনুসরন করছে। মার্কিন পুলিশ বছরে গড়ে এক হাজার লোককে কোন বিচারকর্তার সামনে নেয়ার আগে হত্যা করে। শুধুমাত্র রিও ডি জেনিরো শহরে পুলিশের হাতে বছরে যে পরিমান লোক মারা যায় , তার সংখ্যা আবার পুরো আমেরিকার পুলিশের হাতে নিহতের সংখ্যারও বেশী। কিন্তু বিচার বহির্ভুত এই হত্যা কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারেনা। রাষ্ট্রযন্ত্র সাময়িক ভাবে কোন বিশেষ অপরাধী গোষ্ঠীকে দমনের জন্য একবার করতে পারে যেমনটি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সিভিল ওয়ারের সময় রেনিগেড বা স্পাই দমনের জন্য, পাঞ্জাব খালিস্তান আন্দোলন দম্নের জন্য বা মুম্বাই আন্ডার ওয়ার্ল্ড দমনের জন্য। কিন্তু যে কোন কিছুতেই এই ব্রক্ষাস্ত্র ব্যবহার শুধু তার কার্যকারিতা কমাবে তাই নয় বরং জনগনের মনে তৈরী করবে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতা। যে দেশে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরী হয় তার বিনাশ সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড মানেই যেন নিরীহ, নিরপরাধকে হত্যা  না হয়ে ওঠে। সেটি যেন হয় তালিকাবদ্ধ অপরাধী। অসৎ উদ্দেশ্যে পুলিশ যদি কোন নিরীহ লোককে ফাঁসায় তবে তাতে শুধু পুলিশই অভিযুক্ত হবে না , সে সাথে মৃত্যু ঘটবে মাদকমুক্ত সমাজে আমাদের সন্তানদের বেড়ে উঠার স্বপ্ন। বিচারিক হত্যাও যে সদা সর্বদা যথাযথ হয় তাও নয়। চীনের আদালত সাইকেল চুরির জন্য এক লোকের ফাঁসি দিয়েছিল। মহামতি সক্রেটিসের শাস্তি ছিল হেমলক পানে মৃত্যু। আর বিভিন্ন সামরিক সরকারের আমলে দেশের সংক্ষিপ্ত সামরিক বিচারে মুক্তি্যোদ্ধা সেনানীদের মৃত্যু আমরা এখনো ভুলিনি। বলাবাহুল্য এসব সাজা হয়েছিল বিচারিক আদালতে। আর বিচারিক আদালতে দেয়া অনেক মৃত্যুদন্ড যদি প্রশ্নের উদ্রেক করে তবে বিচার বহির্ভুত মৃত্যু তো করবেই। Two wrongs never make a thing right. কোন এক ভুলকে কেন আমরা অজুহাত হিসাবে খাড়া করব ? কাজেই হে মাদক নির্মুলের দায়িত্বপালনকারীরা, আপনারা আমাদের স্বপ্নকে হত্যা করবেন না। পৃথিবীর কোন আদালতই আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়া দণ্ড দেয় না। মাদক নির্মুল আমরাও চাই, তবে তা প্রকৃত অপরাধীর সাজাপ্রাপ্তিতে। নিরপরাধ বা কলা চোরের ফাঁসি দিয়ে আমাদের স্বপ্নকে হত্যা করবেন না।

মাদক হলো সেই জিনিস যা নেশা বা মত্ততা তৈরী করে। সে হিসেবে ইয়াবার চাইতে অনেক বড় মাদক ক্ষমতার নেশা। ইয়াবা কারবারীর যদি শাস্তি হয় তবে দাম্ভিক ,ক্ষমতার কারবারীদের শাস্তি হতে বাধা কোথায়? আমি আমার সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য নেশা মুক্ত পরিবেশ চাই , কিন্তু নেশামুক্ত মানে সেখানে শুধু ইয়াবা নেশা থাকবে না তা নয়, সেখানে যেন ক্ষমতার নেশাও না থাকে। সেখানে যেন অবৈধ সম্পদের নেশা না থাকে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল বা দেখানোর নেশা না থাকে।