মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর্মসূচী, ক্রসফায়ার ও মানবাধিকার ইস্যু

Published : 4 June 2018, 07:15 AM
Updated : 4 June 2018, 07:15 AM

গত কয়েকদিন ধরে মাদক নির্মূলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' সর্বাত্বক কর্মসূচী চলছে। মাদকের সাথে যুক্তদের শিকড় উপরে ফেলার অভিপ্রায় থেকে সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার সাথে যুক্ত বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন শাখা (নৌ, রেল, ট্রাফিক), কোষ্ট গার্ড, র‌্যাব, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একযোগে কাজ করছে। মাদকের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত গডফাদার, চোরাচালানকারী, মাদকাসক্তদের ধরার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি, পাহারা বৃদ্ধি, চেকিং, গ্রেপ্তারসহ বিভিন্নজনকে আইনের আওতায় আনার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত কর্মসূচী চলছে। মোটামুটিভাবে বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন পত্র-পত্রিকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিদিনকার কার্যক্রম, গ্রেপ্তারের সংখ্যা, ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারে হত্যার তথ্যপূর্ণ সংবাদ, ফিচার ও মতামত পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক দেখা যায়, কর্মসূচীর ১০ দিনে গোলাগুলি, প্রতিরোধ যুদ্ধ, ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারে মোট শতাধিক নিহত ও ৯০২০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
শুধুমাত্র জাতীয় পত্র-পত্রিকা কিংবা সংবাদ মাধ্যমই নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসব সংবাদের সাথে সম্পর্কিত কিছু খবরও প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, এমপি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে এই কর্মসূচীর অগ্রগতি, দৈনন্দিন কার্যক্রম ও লক্ষ্য-কর্মসূচী সম্পর্কে মতামত দিচ্ছেন। ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারে নিহতদের মানবাধিকার ইস্যু সামনে এনে মানবাধিকারের সাথে সম্পর্কিত সংগঠনগুলোর উচ্চতর পর্যায়ের দুয়েকজন বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কর্মসূচীর বিষয়ে অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। সরকারের প্রশংসা করছেন। আবার অনেকেই ক্রসফায়ার, এনকাউন্টারের নিহতদের বিষয়টি সামনে এনে গণহত্যা চলছে কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে মনে করে সরকারের এই কর্মসূচীর  বিপক্ষেও কথা বলছেন। একইভাবে  সমাজবিজ্ঞানী, নাগরিক সমাজ কিংবা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কিছু মতামতভিত্তিক আলাপ-আলোচনা ও লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছে। অপরাধবিজ্ঞান পাঠদানের সাথে যুক্ত বলে অপরাধবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ থেকেই এই লেখা। প্রসঙ্গক্রমেই আমি এই লেখাটিতে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরতে চাইব। যেমন প্রথমত, আমি এখানে অপরাধবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কর্মসূচীর জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করব। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে কর্মসূচীর এই বিষয়টিকে পর্যালোচনা করতে চাইব। তৃতীয়ত, মানবাধিকার রক্ষায় সরকারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে চাইব। চতুর্থত, রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাইব।
বিভিন্ন দেশে সরকারের কর্মসূচী হিসেবে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' 'অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ও 'দূর্নীতির বিপক্ষে যুদ্ধ' বহু কাল থেকে চলে আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে এই কর্মসূচী, কর্মসূচীর প্রয়োজনীয়তা এবং সফলতার দিক এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিতর্ক নিয়ে অনেক আলোচনা হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়। 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এই কর্মসূচী প্রথমে আসে ১৯৭১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে, বিশেষ করে কথিত মারিজুয়ানা গ্রহণ ও ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকাদের গ্রেপ্তারের সরকারী সিদ্ধান্ত হতে। আমেরিকার সরকারের ঐ সময়ের টার্গেট ছিলো ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের বামপন্থী ও ব্ল্যাক রাজনৈতিক কর্মী ও মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে আনা। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে ও সফলভাবে এই কর্মসূচী প্রয়োগের জন্য নিক্সন সরকার ঐ সময় দুটি পদ্ধতি প্রয়োগ করে যা অপরাধবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গূরুত্বপূর্ণ। কথিত মাদকের সাথে যুক্ত থাকা কর্মীদের আইনের ফাঁদে ফেলে শাস্তি প্রদানের জন্য সে সময় বাধ্যতামূলক শাস্তি (mandatory sentencing) ও গ্রেপ্তারি পড়োয়ানা ছাঁড়াই গ্রেপ্তার (no knock warrant) পদ্ধতি নেয়া হয়েছিল। কোন মানুষকেই শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেপ্তার করার অধিকার আইন আদালতের নাই সম্পর্কিত আমেরিকান জনগণের যে অধিকার ও সচেতনতাবোধ তা এই কর্মসূচী ভেঙে দিয়েছিল বলে জানা যায়। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তা ও মতাদর্শকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে থেকে যে ঐ সময়ে এই কর্মসূচী নেো হয়েছিল তা দিনের আলোর মতো পরিস্কার। কারণ গ্রেপ্তারকৃত জনগণকে কোনভাবেই সে সময় জামিন দেয়া হতো না। যা একধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে সে সময় অপরাধবিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেছিল।
একইভাবে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ক্র্যাক কোকেইনকে (হেরোইনের মত এক ধরণের মাদক) নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ও কালোদের রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য 'just say no Crack Cocaine' নামক স্লোগান ব্যবহার করে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কর্মসূচী চালু রেখেছিলো। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান তাঁর স্ত্রীকেও এই কর্মসূচীতে যুক্ত করেছিলেন। তবে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর্মসূচীর কিংবা তার পরবর্তী প্রভাব কালো অভিবাসীদের উপর কতটা পরেছিল তা আমরা কিছুটা দেখতে পাই ক্যামব্রিজের অধ্যাপক ও অপরাধবিজ্ঞানী ফিলিপ বুর্জোয়াস-এর গবেষণায়। 'ইন সার্চ অব রেসপেক্ট: সেলিং ক্রেক ইন এলবারিও' নামক বইয়ে তিনি বিশদভাবে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন, কেন এবং কি কারণে কালো অভিবাসীরা অল্প সময়ে ধনী হওয়ার জন্য ক্র্যাক কোকেইন ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়। তাঁর বইয়ের মুখবন্ধ ও গবেষণা পদ্ধতি বিষয়ক আলোচনা হতে দেখা যায় গবেষণা থেকে বই প্রকাশিত পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই অনেক তথ্যদাতাই সরকারের গুলি, খুন ও নির্যাতনের কারণে মারা যায়। আমেরিকাতে মাদকের বিপক্ষে যুদ্ধ কর্মসূচীর পিছনে আরেকটি রাজনীতি ছিলো, আর তা হলো ব্যক্তিমালিকানাধীন কারাগারের ব্যবসা। সামগ্রিকভাবে অপরাধ কমলেও শুধুমাত্র ব্যক্তিমালিকানাধীন কারাগারের লাভ ও মুনাফার কথা বিবেচনা করে এই ধরণের কর্মসূচী চালু ছিল বলে অনেক অপরাধবিজ্ঞানীই মত প্রকাশ করেন। আমেরিকান বিচারব্যবস্থায় এই বৈষম্যের নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ খতিয়ান পাওয়া যায় জেফরী রেইম্যানের The Rich Get Richer and the Poor Get Prison: Ideology, Class, and Criminal Justice নামক ক্ল্যাসিক বইটিতে। অন্যদিকে, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তের সময়কালে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কর্মসূচীতে মারা যাওয়া ২৫০০ কথিত মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ১৪০০ জনের সাথে বাস্তবে মাদকের কোন সম্পর্ক ছিল না বলে পরবর্তীতে গবেষকগণ বলেছেন। মেনিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হেলাল মহিউদ্দিন তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানাচ্ছেন, নিহতদের মাত্র ১% মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন, ৬০% ছিলেন দুতার্তের ক্ষমতাধারী পুত্র-কন্যা এবং তাঁর ব্যক্তিগত শত্রু কিংবা রাজনৈতিক বিরোধী এবং ৩৯% হলো কোলাট্যারল ড্যামেজে ক্ষতিগ্রস্থ কিংবা বন্দুকযুদ্ধে ফাঁদে পড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিরা। থাইল্যান্ডেও একইভাবে থাকসিন সিনাওয়াত্রা থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রেসিডেন্ট এবং মেক্সিকোতে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' নামক এই কর্মসূচীতে যারা কাজ করেছে তাদের বিরোধীদের শায়েস্তা করার জন্যই এটা ব্যবহার করা হয়েছিলো। কয়েকদিন আগেই পত্রিকায় দেখলাম একজনের সাথে জমি নিয়ে পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাকে ইয়াবা ও অস্ত্রমামলায় ফাঁসানোর ষড়যন্ত্রের খবর প্রকাশিত হয়েছে।  বাংলাদেশেও ভবিষ্যতে চলমান এই কর্মসূচীর অপ্রত্যাশিত নেতিবাচক ফলাফল আসতে পারে যা এখনই হয়তো সূর্নিদিষ্টভাবে পুরোপুরি বলা সম্ভব নয়। অপরাধবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আরেকটি বিষয় সামনে আনতে চাই তা হলো আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কর্মসূচীতে অনেকক্ষেত্রেই কথিত মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে বাধ্যতামূলক শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা হয়েছে ।  ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার এর মাধ্যমে মাদকব্যবসায়ীদের নিশ্চিহ্ন না করে  গ্রেপ্তার ও আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সরকারী চেষ্টাই ভবিষ্যতে ইতিবাচক হবে বলে মনে করি।

অপরাধবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কর্মসূচীতে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করা উচিত। আমি মনে করি পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মাদকের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার, আইন ও বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়াটি সচেতন নাগরিক হিসেবে বলব অবশ্যই ইতিবাচক। ইতিপূর্বেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে এই কর্মসূচী ছিল। বর্তমান কর্মসূচীর আওতায় পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যৌথভাবে কাজ করছে বলে পত্র-পত্রিকা মারফত আমরা জেনেছি। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত ও দৈনন্দিন কার্যক্রম হিসেবে মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া অবশ্যই ইতিবাচক হবে বলে মানুষ মনে করবে এবং এটাই করা উচিত। কিন্তু দেখতে হবে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কর্মসূচীর আওতায় একজন মানুষও যাতে বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। নিহত কিংবা মৃত্যুবরণ না করেন।  বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ এ বলা আছে, 'আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্যে অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।' একইভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩ ও ৩৫ এ ন্যায়বিচার ও দন্ড সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আশার কথা হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চিঠি দিয়েছেন অনুচ্ছেদ ৩৩ এর রেফারেন্স ব্যবহার করে। তিনি চলমান কর্মসূচীতে যারা ধরা পড়েছে কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীকারী বাহিনীর কারোরই যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন। আমি মনে করি কাউকে গ্রেপ্তার করে আইনি প্রক্রিয়ায় না আনতে পারলে কিংবা কেউ মিসিং হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদও একইভাবে লঙ্ঘিত হয়।
একইভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এর ধারা ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ তে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে জীবন, সম্মান, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার পাবার অধিকার দেয়া হয়েছে। যেমন ধরুন ধারা ৯ এ বলা হয়েছে, "কাউকেই খেয়ালখুশীমত গ্রেপ্তার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবেনা।" একইভাবে ধারা ১০ এ বলা হয়েছে, "নিজের অধিকার দায়িত্ব নির্ধারণ এবং নিজের বিরুদ্ধে আনীত ফৌজদারী অভিযোগ নিরুপণের জন্য প্রত্যেকেরই পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে প্রকাশ্য শুনানি লাভের অধিকার রয়েছে।" সংবিধান ও মানবাধিকার সনদের পাশাপাশি বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯৯ (সংশোধিত ২০০৪) এর বিভিন্ন ধারা বিশেষ করে মাদকের শ্রেণিভেদে অপরাধ ও শাস্তির বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধ ও শাস্তির বিধানাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। আমি মনে করি এর বিকল্প কোনভাবেই হওয়া উচিত নয় এবং তা রক্ষা করতে সরকারকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেবেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো জণগুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশে গত কয়েকদিনে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কর্মসূচীতে গ্রেপ্তারকৃত ৯০২০ জনের ব্যাপারে সঠিক আইনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গাইড করার জন্য বাংলাদেশে নিযুক্ত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আরো জোরালো ভূমিকা থাকা উচিত। জাতিসংঘ এর 'ডিক্লারেশন অন হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস' এর অনুচ্ছেদ ১ বলা হয়েছে "Everyone has the right, individually and in association with others, to promote and to strive for the protection and realization of human rights and fundamental freedoms at the national and international levels." সরকারের বাইরে থাকা বেসরকারী সংগঠন বিশেষ করে এনজিওগুলো মানবাধিকার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীর মাধ্যমে।
নব্যউদারতাবাদের সময়কালে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে আমেরিকাতে রোনাল্ড রিগ্যান ও বৃটেনে মার্গারেট থ্যাচারও একই ধরণের কঠোর কর্মসূচী নিয়েছিলেন। তো বর্তমান সরকারও সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এমন কর্মসূচী নিতে পারে। তবে তা প্রকৃতপক্ষেই মাদকমুক্ত ও অপরাধমুক্ত সমাজ বিণির্মাণের অঙ্গিকার থেকে হবে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে কর্মসূচী যদি শুধু 'নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি' হয় অথবা মানুষকে নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত করার আপাত ইচ্ছে থেকে হয় তবে তা সুফল আনবে বলে আমার মনে হয় না।
বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে মাদক নির্মূল কর্মসূচী সম্পর্কে বিভিন্ন রকম বক্তব্য পত্রপত্রিকায় আসছে।  সেই বক্তব্যর সংক্ষিপ্তসার এমন, 'মাদক নির্মূলে সরকারের অল-আউট কর্মসূচী চলছে, এ কর্মসূচীর আওতায় মাদকের সাথে যুক্ত কেউই রক্ষা পাবেনা…আমরা পরিকল্পিতভাবে কাউকে হত্যা করছিনা বা কাউকে হত্যা করা এ কর্মসূচীর আওতায় নয়।' এর পাশাপাশি কর্মসূচী সম্পর্কে পুলিশের আইজিপি, র‌্যাবের প্রধান, ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনারের বক্তব্যও পাওয়া যায়। আমি মনে করি বক্তব্যের পাশাপাশি বাস্তবে আইনি প্রক্রিয়া ও আইনগত দিক গ্রহণ করে মাদক সমস্যার সমাধান হতে পারে। কোনভাবে মাদক নির্মূলের নামে অসহনশীল নীতি ও কার্যক্রম বিশেষ করে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ চলমান রাখলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও সরকারের ভার্বমূর্তি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে।  বহির্বিশ্বে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, দাতাসংস্থা, কূটনৈতিক মহল এই ইস্যুগুলোকে সামনে আনবে। এক্ষেত্রে শুধু সরকারই ভাবমূর্তির সংকটে পড়বে এমন নয় বাংলাদেশই রাষ্ট্র হিসেবে প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানে পড়বে। তাই সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও ইতিবাচক ভূমিকা দরকার হবে।