মুখ খুললো বুদ্ধিবৃত্তি, জাগুক মানুষের বিবেক

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 5 June 2018, 05:56 AM
Updated : 5 June 2018, 05:56 AM

অবশেষে বুদ্ধিজীবীরা মুখ খুললেন। ধরে নেয়া হচ্ছিল বুদ্ধিবৃত্তি স্তাবকতার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। একটা সময় ছিলো যখন দেশে বিদেশে বুদ্ধিবৃত্তিই পথ দেখাতো। কোন ঘটনা ঘটার আগেই তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আমাদের যৌবনে বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার ধাক্কা সামলানোর পর বুদ্ধিজীবীরা আর কোনদিন থেমে থাকেননি। জিয়া থেকে এরশাদ আমল দেশের মানুষের আশা হতাশা মানুষের মন ও মননের প্রতিনিধি ছিলেন তাঁরা। এরশাদ আমল ছিলো নাটক গান কবিতা মিলে এক জমজমাট প্রতিবাদী বাংলাদেশ।  যৌবনে সেই প্রতিবাদের আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়েছি আমরা। কবিতা লিখে কবিতা পড়ে বাড়ীতে থাকতে পারিনি। সেই প্রতিবাদের মানুষজন ধীরে ধীরে কেমন জানি মিইয়ে পড়লো। খালেদা জিয়ার আমলেও বাদ প্রতিবাদ ছিলো নিত্য সঙ্গী। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে সরকারে চেয়েছিলাম মানে কি এই যে, আর কোনদিন প্রতিবাদ হবেনা? কেন জানি তেমনই হয়ে উঠলো পরিবেশ। শেখ হাসিনার সাথে থাকা মানে উন্নতির সাথে থাকা একথা যেমন সত্যি তেমনি আওয়ামী লীগের অপরাধ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া মানেও কিন্তু সমাজ ও জাতির সাথে বেঈমানী করা। কে না জানে এই দল আর বঙ্গবন্ধুর দল কোন ভাবেই এক না।  সরকারী দল বিশেষত কয়েকদফা গদীতে থাকা সরকারী দলে আসল মানুষরা কোথায় হারিয়ে গেছেন। সে জায়গায় সামনে চলে এসেছে ঢুকে পড়া চামচা আর স্বাধীনতা বিরোধীচক্র। তবে তার মানে এই না যে  এর দোহাই দিয়ে তারা পার পেয়ে যাবেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ও অন্য নেতারা আছেন কি করতে? নিয়মমাফিক খালেদা জিয়াকে গালমন্দ আর বিএনপি জামাতের গুষ্ঠী উদ্ধারই কি তাদের কাজ? কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমরা ধরে নিয়েছি আওয়ামী লীগ না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি এতিম হয়ে যাবে। যদিও শেখ হাসিনা বা সৈয়দ আশরাফের মত কয়েকজনকে বাদ দিলে এমন কিছু বোঝার উপায় নাই। বরং বর্তমান নেতাদের কান্ড দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে এই কি সেই আওয়ামী লীগ?

যে কথা বলছিলাম, সম্প্রতি মাদক বিরোধী যুদ্ধে নেমেছে দেশ।  এ যুদ্ধ মানুষ চেয়েছিল। কারণ মাদকের মরণ ছোবল আজ সমাজকে প্রায় ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই ছোবল একদিনে সমাজকে গ্রাস করেনি। ধীরে ধীরে  মাদক সমাজে  এমন ভাবে প্রভাব ফেলেছে মনে হতে পারে এটাই নিয়ম। এর কুফলে তারুণ্য এতটাই বিপথে– মা বাবাকে মেরে ফেলাও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে চাইছে। ফলে মাদকবিরোধী যুদ্ধ দরকারী। কিন্তু তার মানে এই না যে এই যুদ্ধকে পুঁজি করে একশ্রেণী আবার আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে আর যাকে খুশী তাকে টার্গেট করে মেরে ফেলবে। এদের সমর্থনে যদি সরকারী দল এসে দাঁড়ায় তখন তো পুরো বিষয়টাই গোলমেলে হয়ে ওঠে। উন্নতি অগ্রগতি এসব তখন তুচ্ছ হয়ে যায় । নিরীহ মানুষের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিলেই কি যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে? সমর বাবুকে দেখে কি মনে হয়েছে তিনি আসলে বন্দুকবাজ? হাতে ধরিয়ে দেয়া বন্দুকটা পরম আদরে আগলে রাখা বা ভার  বহনে অসমর্থ সমর বাবুকে দেখেই বোঝা যায় এটি বানোয়াট। সে ঘটনাকে ছাপিয়ে দেশের মানুষকে কাঁদিয়ে কলংকতিলক হবে উঠেছে একরামুল হত্যা।  এটি এমন ঘটনা যেসব বুদ্ধিজীবীরা মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন বা নানা কারণে কিছু বলতেন না তারাও বিবেকের তাড়নায় মুখ খুলেছেন।

দেশবরেণ্য দশ কবি সাহিত্যিক সংগঠক নাট্য ব্যক্তিত্ব এক বিবৃতিতে একরামুলের বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। অনেক বছর পর বিবেকের এই সাড়া দেশের মানুষের মনে একটু হলেও স্বস্তি দেবে। মনে হবে এখনো শুভবোধ শেষ হয়ে যায়নি। বিলম্বে হলেও তাঁদের বোধোদয় স্বস্তির। দেশের মানুষের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছে একারমুলের হত্যাকান্ড। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা যখন চোখে পড়ার মত তখন দেশের মানুষ এমন  একটি নৃশংস হত্যাকান্ড কিভাবে মেনে নেবেন? আমরা বিশ্বাস করি সব কিছুর ওপরে আইন । যেকোন সভ্য সমাজের আস্হা আর বিশ্বাসের জায়াগাটাই হলো আইন ও বিচার। সেটি নাথাকলে দেশ এগুলো না  পিছিয়ে থাকলো তা আসলেই কোন বিষয় না। একরামুল কে বা কি তাঁর অতীত আমি জানি না। বাংলাদেশে এমন হাজার হাজার কমিশনার আছেন। যে সমাজে রাজনীতি পচে গলে দূর্গন্ধময় সেখানে কমিশনারের মত পদটি নির্ভেজাল  তা ভাবিনা। আমরা সবাই জানি রাজনীতিতে এখন ভালো মানুষের অংশগ্রহণ নাই। যারা নির্বাচন করেন বা ভোটে জেতেন কিংবা হারেন তাদের সবার পেছনে সীল মারা থাকে। সে সীলগালা সুখকর কিছু না। ফলে আমি একথা বলবো না যে, একরাম ছিলেন ধোয়া তুলসীপাতা। কিন্তু তার মানে এই না যে কাউকে ইচ্ছেমত গুলি করে  বিনাবিচারে ক্রশফায়ারে মারা জায়েজ।

একরামুলকে যেভাবে মারা হয়েছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষত যে অডিও টেপটি বাজারে চলছে তার ভেতর যদি গলদ থাকতো তো কেন ইংরেজী কাগজ ডেইলী ষ্টারের অনলাইন সংস্করণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো? এই অডিও টেপ দেশের মানুষতো বটেই দেশের বাইরের বাঙালির মনকেও নাড়া দিয়ে গেছে। বলাবাহুল্য এর নেগেটিভ প্রভাব গিয়ে পড়েছে সরকারের ওপর। এবং এটাই স্বাভাবিক। এই টেপে মেয়েদের কথা মায়ের কান্না আর গুলীর শব্দ একাত্তরকে মনে করিয়ে দিয়েছে। কে জানে এমন কত ঘটনা অগোচরে ঘটছে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় মানুষের মনে এর জটিল প্রভাব। কে কোন দল করেন বা কাকে সমর্থন করেন এখানে সেটা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। এটা মানবিকতা ও সহজ অর্থে মানুষের বাঁচা মরার বিষয়। মানুষের এমন মরণের জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। সত্যি বলতে কি দেশ স্বাধীনের সময় আমরা ছিলাম বালক। সেই তের চৌদ্দ বয়সে ধরে নিয়েছিলাম পাকি পান্জাবীরা চলে যাবার পর আর কোনদিন ও আমরা নিজেদের বুকে গুলি চালাবো না। সে আশা কোথায় তলিয়ে গেছে কোন হতাশার গভীরে নিজেরাই জানিনা। বরং এখন এমন এক পরিবেশ এমন এক দেশ ও সমাজ যেখানে আমরাই আমাদের চরম দুশমন।

একারমুলের হত্যাকান্ড বাংলাদেশের ভোটারদের মনে কি বার্তা দিয়ে গেছে বা এর ফল কি হতে পারে রাজনীতি সেটাও বুঝতে পারছেনা। সরকারী দল মানে কি প্রশাসন , নিরাপত্তা বাহিনী , বা যে কোন অপঘটনার দায় নিজের কাঁধে নেয়া? ভুল যদি হয়ে থাকে তো তার দায় নেবে যারা ক্রশ ফায়ার করছে তারা। এই সহজ বিষয়টুকুও বুঝতে দিচ্ছেনা অপরাজনীতি।  দম্ভের  সরকারী দলের মন্ত্রী বলছেন, বড় কাজে ছোট ভুল হতেই পারে। প্রথমত এই ভুল কোনভাবেই ছোট কিছু না। তাছাড়া মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার চাইতে বড় আর কি ভুল থাকতে পারে? জনাব কাদের সেটাও ভুলে গেছেন। অথচ নির্বাচন সামনে। দেশ ও সমাজ তৈরী হোক বা না হোক নির্বাচনতো হবেই। একতরফা বলেই কি এমন দম্ভোক্তি করতে হবে? কোন রাজনৈতিক দলের জন্য কি সরকারে থাকা চিরকালীন? এসব সহজ কথা সবাই জানেন শুধু অন্ধ বর্বর রাজনীতি বোঝেনা।

প্রধানমন্ত্রী একা যতটা টেনে তোলেন ততটাই পিছিয়ে দেয় স্তাবক ও লুকিয়ে থাকা ঘাতকেরা। এই ঘাতকের দল থেকে ছদ্মবেশী রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধী সবাই এখন লীগার। এমনকি বিদেশেও। দেশের মত প্রবাসেও  আওয়ামী লীগের নামে এরা তৎপর।  এরা সবকিছু এমনকি  জান কেড়ে নেয়াটাও জায়েজ মনে করে। আর আমাদের দালালী করার জন্য চাপ দিতে থাকে। আরে বাবা তোদের না হয় আখের গোছানোর ধান্দা আছে, যাদের নাই তারা কেন স্তাবকতা করবে? মোদ্দা কথা এই, একরামুল হত্যাকান্ড একটি অশণি সংকেত। এর বিহিত বা বিচার না করে ইফতার পার্টি কিংবা বড় কথার রাজনীতিতে পতনের বাইরে কিছু নাই। এই সত্য  বা এর ফল আগে পরে ভোগ করা রাজনীতি কিছুতেই তা মানতে চায়না। যেকোন যুদ্ধের নামে নিরীহ হত্যাকান্ড বন্ধ হোক। সবার আগে দেশের মানুষ এবং তাদের জান। এর কোন বিকল্প নাই।

মাদকবিরোধী যুদ্ধে মানুষের সমর্থন থাকলেও এই অভিযান এখন তোপের মুখে। এর কারন আমাদের অজানা নয়। যখনই মানুষ আশায় বুক বাঁধে বা ভরসা রাখতে শুরু করে তখনই আমাদের সমাজে এমন কিছু ঘটে যায় যা আবার হতাশার কালো অন্ধকার ডেকে আনে। মাদক এমন এক সর্বনাশা বিষয় যা সমাজকে প্রায় খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এতকাল ধরে চলে আসা অনিয়ম জঞ্জাল রাতারাতি শেষ হবেনা। শেষ না হবার পেছনে অনেক কারণ। আছে রাজনৈতিক দলবাজী আছে সিন্ডিকেট আছে ইন্ধন আছে ব্যবসা। অথচ রাজনীতি তা স্বীকার করেনা। সেদিন এক টিভি শোতে এক নামকরা গায়িকা দেখলাম সমানে বলে যাচ্ছেন ফেনসিডিল দেয় ভারত। ইয়াবা দেয় মিয়ানমার। ভাবখানা এই ওরা গছিয়ে দেয় আমরা ভালো বা সুবোধের মত গিলি। এই এক দোষ সমাজের। মদের জন্য পাশ্চাত্য ইয়াবার জন্য মিয়ানমার, ফেনসিডিলের জন্য ভারত অস্ত্রের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেই আমাদের কাজ শেষ। কেউ সত্য বলেনা। কেউ জানতে চায়না কিভাবে এর বিস্তার আর কারা এর পেছনে। দেশের সুশীল বুদ্ধিজীবী এমনকি একটু অগ্রগামী মানুষেরাও পাশ ফিরে ঘুমায়। তবে এবার ক্রশফায়ারের ঘটনায় শেষতক হুঁশ ফিরেছে।