কড়াইলবাসীর বক্তব্য: দুর্ভোগ ও আকাঙ্খা

শাহাদাৎ হোসেন
Published : 29 May 2012, 09:49 AM
Updated : 29 May 2012, 09:49 AM

কড়াইলবাসীর বক্তব্য – দুর্ভোগ ও আকাঙ্খা
প্রায় দুই মাস হয় গেল অতর্কিত এক উচ্ছেদ অভিযানে কড়াইলের কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়। এর পরেই শুরু হয় কড়াইলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা এবং তাদের বিভিন্ন গুরুত্বের ও ব্যাপ্তির মিডিয়া প্রচারনা। এই সব আলোচনায় কিছু বস্তিবাসীকে তাদের নিজস্ব মতামত দিতে বলা হলেও সেসব মতামত পরবর্তীতে কড়াইলে উচ্ছেদের বিকল্প নির্ধারণের আলোচনায় তেমন কোন মূল্যায়ন পায় না। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই আমাদের এই লেখার প্রয়াস। এখানে কড়াইলে দৈনন্দিন জীবনের ভোগান্তি ও আকাঙ্ক্ষার কথা একজন কড়াইলবাসীর প্রতিবেদনের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রতিবেদনকারী অনেক দিন ধরে উন্নয়নকাজের সাথে জড়িত এবং বিভিন্ন আলোচনায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং সুশীল সমাজের কাছে বস্তিবাসীর একজন হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন।

আমরা আমাদের এখানে আমন্ত্রিত মনে করি না
শুধু নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই না, সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে দরিদ্র মানুষের শহরে বসবাস শুধুমাত্রই সাময়িক, গ্রামই তাদের একমাত্র আবাসস্থল। নগরের অন্যদের মত দরিদ্র মানুষরাও যে সুযোগ-সুবিধার সন্ধানে এই শহরে আসে এই বিষয়টা সবসময়ই থাকে আলোচনার বাহিরে। গরীব শহরবাসী ছাড়া এই শহর চলতে পারে না। নাগরিকের 'সম-অধিকার' বিষয়টিও 'সমাদৃত' এবং 'অসমাদৃত' ধারণা কখনই সমর্থন করে না। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও সকল মানুষের বসবাস, কাজ, উচ্চশিক্ষা বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য সকল শহর এবং গ্রাম উন্মুক্ত। দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর যে শহরে অনাকাঙ্ক্ষিত এই অনুভূতির মুল কারণটাই হল এই প্রচলিত ধারনা।
আমরা ঢাকাতে কেউ কিন্তু ইচ্ছা করে আসি নাই। আমরা মনে করি যে আমাদেরকে কেউ দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসছে। কারণ, মিল ইন্ডাস্ট্রি, কল-কারখানা সব যদি ঢাকায় করা হয় তো আমাকে গ্রামে থাকতে বললে তো সেটা সম্ভব না। আগে আমার জন্য কর্মসংস্থান গ্রামে নিয়ে যেতে হবে, তারপর আমাকে নেওয়ার কথা বলতে হবে। অথচ যারা কল-কারখানা, ইন্ডাস্ট্রি করছে, তাদেরকে কেউ দোষারোপও করে না, তাদেরকে কেউ প্রেসার ক্রিয়েটও করে না। যখন একটা মিল ইন্ডাস্ট্রি হয়, তখন কেন বলা হয় না যে তাঁদের শ্রমিকদের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে?

আমাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভই প্রমান করে যে আমরা কখনই অপকর্ম বা ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চাই না
উচ্ছেদের বৈধতা প্রসঙ্গে একটা জোরালো দাবী হল অপরাধকর্ম। আমরা বলছি না যে বস্তিগুলো অপরাধ কর্মকান্ড মুক্ত। তবে বস্তিই একমাত্র বেআইনি এবং অসামাজিক কার্যকলাপের উৎস না। সমগ্র শহর এমনকি বনানী-গুলশানের মত উচ্চবিত্ত এবং পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায়ও বেআইনি কর্মকান্ড এবং অসামাজিক কার্যকলাপ সমানভাবে বিরাজমান। তাই অপরাধমূলক কর্মকান্ড কখনই সরকারের এই ধরনের অমানবিক এবং অসংবিধানিক উচ্ছেদ অভিযানের কোন ভিত্তি হতে পারে না। উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট রোডের উপর ৫ এপিল, ২০১২ এর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ জনসাধারণের কাছে বস্তিবাসীর একটি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেঃ
আমরা যে মানববন্ধনটা করেছি সেটা কিন্তু কেউ আমাদেরকে বলে দেই নাই, আমরা আমাদের প্রয়োজনে করতে হইছে। আমরা সুশৃংখলভাবে প্রোগ্রামটা করেছি, কোন গাড়ি ভাংচুর করি নাই, কাউকে আহত করি নাই। অথচ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন কোন কিছু করে তারা কিন্তু গাড়ি ভাংচুর থেকে শুরু করে সবকিছু করে। সবসময় বলা হয় যে বস্তিবাসী লোকজন হচ্ছে গিয়ে জঙ্গি, তারা খারাপ কাজ করে। আমরা কিন্তু আমাদের এই কর্মসূচিতে এটা দেখিয়েছি যে আসলে আমরা কিন্তু এগুলা করতে চাই না। তারপর আরেকটা কথা, বস্তি মাদকদ্রব্য আর সন্ত্রাসের উৎস। হ্যাঁ, কিছু হয়ত মাদকদ্রব্য আসে, কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? যে বর্ডার দিয়ে এই মাদকদ্রব্যগুলো আসে সেখানেই যদি নিয়ন্ত্রন হয় তাহলে তো বস্তিতে মাদকদ্রব্য আসার কথা না। আবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানেও কিন্তু গোলাগুলি টেন্ডারবাজী সব হয়, তার জন্য কি আমরা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্ছেদ করে দিব? এটা কি সম্ভব? এটা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কেন আমাদের বস্তিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করা হবে? আমরা মনে করি যে আসলে বস্তি উচ্ছেদ কিন্তু কখনই কোন সমস্যার সমাধান না।

আমরা দৈনদিন বাস্তবতা ও আইনী বৈষম্যের শিকার
বনানী লেকের অবৈধ দখল এবং সরকারী জায়গায় অবৈধ স্থাপনার উপর ভিত্তি করে হাইকোর্টের ২৫ জানুয়ারী ২০১২ তারিখের বস্তি উচ্ছেদ সম্পর্কিত আদেশটি দেওয়া হয়। বাসস্থানসহ মানুষের অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরা যে রাষ্ট্রেই সাংবিধানিক দায়িত্ব (ধারা ১৫) এই কথাটা খুব সতর্কের সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয় হাইকোর্টের এই আদেশটিতে। একই সাথে হাইকোর্টের পূর্ববর্তী আর একটি রায় যেখানে উচ্ছেদ অভিযানের পূর্বে পুনর্বাসন নিশ্চিতকরণের কথা বলা আছে, সেটাও পুরোপুরি অস্বীকার করা হয় বর্তমান আদেশটিতে। আবার, রায়টিতে সরকারী জমি সহ লেকের উপেরর সমস্ত স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ থাকলেও শুধুমাত্র কড়াইলেই চলে ট্র্যাক্টরের চাকা। সুরক্ষিত থাকে মহাখালী, বনানী এবং গুলাশানের দিকে লাকের উপর গড়ে ওঠা ধনীদের অনেক অবৈধ বহুতল অট্টালিকা। উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে প্রশাসনের এই ধরনের পক্ষপাতিত্ব সরাসরি সংবিধান পরিপন্থী – সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও সমানভাবে আইনের সহায়তা লাভ করবে (ধারা ২৭)। কড়াইল বস্তিবাসীদের কাছেও প্রশাসনের এই বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়ঃ
শুধু শুধু বস্তিবাসীকে একপাক্ষিক ভাবে জায়গা দখলের জন্য দোষারোপ করা হয়। আপনি গুলশান বনানীতে যান, সেখানে যারা জায়গা দখল করে, লেক ভরাট করে বাড়ী করেছে তাঁদের কিন্তু কোন বিল্ডিংও উচ্ছেদ করা হয় না আর তাদেরকে কিছু বলাও হয় না। সরকারের হাতীঝিল প্রকল্প, ঝিলমিল প্রকল্প -এরকম প্রকল্পের শেষ নাই। বড়লোকদেরকে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ৯৯ বছরের জন্য জমি লিস দেওযা হয়। পয়ঃনিষ্কাশন থেকে রিক্সা চালনা যাই বা বলেন প্রতিটা কাজ আমরা বস্তিবাসী যারা দরিদ্র্য মানুষ তাঁরাই করছি। কিন্তু দরিদ্র্য মানুষের জন্য সহজ শর্তে কোন ধরনের প্রকল্প করা হয় না।

আমাদের বাসের জায়গা নেই, ছাগল পালন করব কোথায়?
বিগত কয়েক দশকে নগরদারিদ্র্য এবং বস্তিসমস্যা নিরসনে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কথা মোটামুটি সবাই জানেন। সবসময় উদ্দেশ্য থাকে বস্তিবাসীদের শহর থেকে সরিয়ে গ্রামে ফেরার ব্যবস্থা করা। এইসব সরকারি প্রকল্প সম্পর্কিত আলোচনায় দরিদ্র মানুষের মতামত ও আসল চাহিদার কোন প্রতিফলন ঘটে না। গুরুত্ব পায়না গরিব মানুষদের ঢাকামুখী হওয়ার পেছনের কারণগুলোর। সর্বোপরি বহিঃপ্রকাশ ঘটে বরং উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর স্বার্থের।
আমরা কেউ কিন্তু ঢাকায় বেড়াতে আসি নাই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সিডর, আইলা, জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য আমাদের যেটুকু থাকার জায়গা সেটা নষ্ট হয়ে গেছে, ঘর নাই। এখন আমি গ্রামে থাকতে পারলেও আমার কাজ নাই। আমাদের দেশের সরকাররা যে কর্মসূচি নেয়, সেটা কিন্তু না বুঝেই নেয়। যেমন বিগত সরকার যেখানে মানুষের থাকার জায়গা নাই, সেখানে ছাগল পালন প্রকল্প নেয়। আমার থাকার জায়গা নাই, আমি ছাগলটা পালব কই? তারপর আবার ঘরে ফেরা কর্মসূচি। আপনি আমাকে কর্মসংস্থান দিবেন না, আপনি আমাকে ঘরে ফিরায় দিতে চাইলেও তো আমি যাব না।

দরিদ্র মানুষের জন্য করা ভাষানটেক প্রকল্পটিতে একজন বস্তিবাসীও কোন ফ্ল্যাট পায় নাই
নগরের দরিদ্র জনগণের জন্য ঢাকাতে বাস্তবায়িত কোন আবাসন প্রকল্প এই পর্যন্ত সফল হয় নাই। গরীব শহরবাসীদের জন্য করা হলেও কোন বরাদ্দকৃত জমি বা ঘরবাড়ি গরিবদের কাছে পৌঁছে নাই। পক্ষান্তরে লাভবান হয়েছে সমাজের উচ্চবিত্ত ও রাজনৈতিক শক্তিধরেরা। সঠিক ভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে গরীব মানুষের কাছে তাদের ফলাফল পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ঠ স্বদ ইচ্ছারও অভাব লক্ষ্যনীয়। কড়াইলবাসীরা সরকারের এই ব্যর্থতা এবং এর পিছনের কারণগুলোর সম্পর্কে অবগত।

যেমন মনে করেন সহযোগিতা করতে গিয়ে আমার কর্মসংস্থান হচ্ছে যেখানে কড়াইল, আপনি আমাকে হিল-ট্র্যাক পাঠায় দিলেন। এই ধরনের সহযোগিতা চাই না। তারপর, ভাষান্টেক প্রকল্প, যদিও দরিদ্র্য মানুষের জন্য করা হইছে, আপনি গিয়ে দেখেন একটা কোন দরিদ্র্য মানুষ, বস্তিবাসী এই প্রকল্পে ফ্ল্যাট পাইছে? সবগুলাই হচ্ছে গিয়ে যারা রাজনীতি দলের নেতা কর্মী, তারা সেটাকে নিয়েছে। তাইলে এই ধরনের সহযোগিতা যদি করা হয়, তাহলে তো আমরা লাভবান হব না। এটা এরকম হতে পারে, সরকার যদি একটা জায়গার নিশ্চয়তার দেয়, তাইলে আমিও কিন্তু সেখানে আমার ১ হাজার টাকা বা ২ হাজার টাকা বা ১০ হাজার টাকা যা আছে সেখানে মাসে মাসে দিয়ে আশ্বস্ত হব যে এটা আমার নিজের। আমি নিজে ওখানে কন্ট্রিবিউট করতে পারব। কিন্তু যদি সেরকম তা না হয়ে, তাহলে আমরা শুধু স্বপ্নই দেখব যে পরিকল্পনা হবে, আর কল্পনা আমাদের জন্য কল্পনাই থেকে যাবে।

সুশীল সমাজের আন্তরিকতার অভাবই আমাদের পশ্চাৎপদতার একটি কারণ
ঢাকায় সুশীল সমাজ এবং এনজিও কার্যক্রম অনেক সীমিত এবং নির্বাচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকার এবং দাতাগোষ্ঠীগুলোর সাথে সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে তাদের কার্যক্রমের বিস্তার ও অংশগ্রহন। সুশীল সমাজ এবং এনজিও যারা দরিদ্র মানুষের আবাসন ও নিরাপদ বসবাস বিষয় নিয়ে কাজ করে তাদের সংখ্যা মাত্র হাতে গণা। সরকারের পদক্ষেপগুলোর মতই এসব সুশীল সমাজ ও এনজিও পরিচালিত আবাসন বিষয়ক প্রকল্পের কোন সফলতার ইতিহাস বাংলাদেশে নেই। বেসরকারি প্রতিস্থানের সম্পৃক্ততার পিছনে যখন নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও সুনাম গড়ার প্রাধান্যতা পায় তখন এইসব প্রকল্প ব্যর্থতো হবেই। এই সুনাম কামানোর প্রতিযোগিতা থেকে শুরু হয় দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ। ফলশ্রুতিতে কেউ আসে প্রকল্প থেকে সরে, আর সহযোগিতার অভাবে বাকিরা হয় সাফল্য বঞ্চিত। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যর্থ হয় মিরপুরের কালশি পুনর্বাসন প্রকল্প।

সুশীল সমাজের কথা যদি বলি তাইলে বেয়াদবি নিবেন না, মনে কষ্ট নিবেন না। কারও সাথে কারও মিল নাই। ভাল কোন কাজ করতে গেলে দেখা যায় কি, তারা গ্রুপিং করতে করতেই অনেকটা হয়রান। তাঁদের নিজেদের আন্তরিকতার জন্য আমরা অনেকটা পিছায় যাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মিরপুর-১২ কালশির ৫ একর জায়গা আমাদেরকে সুশীল সমাজের মাধমে দেওয়ার কথা ছিল। সুশীল সমাজের কেউ ডিজাইন করবে, কেউ টাকা সংগ্রহ করবে। পরবর্তীতে দেখা গেল কেউ ডিজাইন করতে পারল না, কাজ ওখানেই থেমে গেল; কেউ টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে চাইল তার মাধ্যমেই যেন কাজটা হয়, সেইটা হয় নাই দেখে সে পিছিয়ে গেল; আবার কেউ একাই সব করে ফেলতে চায়। ডোনাররাও কিন্তু টাকা দেয়ার জন্য রাজি ছিল। শুধু সুশীল সমাজের নাম সুনাম করার প্রতিযোগিতায় কাজটা আর পরে হলোনা – আমাদের গরিব মানুষদের ভাগ্য গরিবই রয়ে গেল। তারা যদি আন্তরিক হতো, তাহলে কিন্তু ওই মূহুর্তে সেই ৫ একর জমিটা নিয়ে আবাসনের কাজটা শুরু করে দেওয়া যেতো।

বসবাসের নিরাপত্তা পেলে আমরা নিজেরাই আমাদের উন্নয়ন করতে পারব
সরকার এবং সুশীল সমাজের ব্যর্থতার ইতিহাসের উপরই জম্মে ওঠে কড়াইলবাসীর নিজে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার প্রচেষ্টা। কড়াইলকে ঘিরে গড়ে ওঠা কর্মসংস্থান ও সামাজিক সম্পর্ক তাদের অন্য জায়গায় পুনবাসনের অন্তরায়। একই সাথে সুষ্ঠ বণ্টনের অনিশ্চতা এবং জায়গা স্বল্পতার কারনে এত অধিক সংখ্যক অধিবাসীকে কড়াইলের ক্ষুদ্রাংশের উপর পুর্নবাসনও বাস্তব সম্মত নয়। যে কড়াইল তাদের জীবন ও জীবিকার সন্ধান দেয় সেখানেই বর্তমান অধিবাসীরা গড়ে তুলতে চায় তাদের ভবিষ্যৎ বসতি।

সদিচ্ছা বা আন্তরিকতা থাকলে সরকার কিন্তু ঠিকই করতে পারে। আমাদের কড়াইলে যে ৯০ একর জায়গা আছে সেই জায়গাটা যদি সরকার আমাদের লিজ দিতে পারে, সেই ক্ষেত্রে আমরা নিজেই যারা এনজিও-র কাজ করে তাদের সাথে সহাযতার বিষয়ে কথা বলতে পারব এবং বৈধভাবে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস এর ব্যবস্থা করে আমরা ভাল ভাবে থাকতে পারব। আমরা নিজেই এইভাবে আমাদের জীবনের মান উন্নয়ন করতে পারব এবং ঢাকা সহ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাটাকে আরো শক্তিশালী করতে পারবো।

সরকার, সুশীল সমাজ বা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কাছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহযোগীতা কামনা করে। এর অর্থ এই নয় যে তারা সরকারি সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা বিনামূল্যে চায়। তারা ভালভাবেই জানে যে বিনামূল্যে প্রাপ্তি কখনোই টেকসই হয় না, উপরন্তু মালিকানা ও দায়বদ্ধতা হারায়। তাই তারা চায় তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষ প্রকল্প।
আমরা চাই আমাদের জন্যও আবাসন প্রকল্প করা হোক। আমরা সেটা ফ্রি চাই না। কারণ আমরা জানি, ফ্রি জিনিষ কখনই টেকসই হয় না। আমাদেরকে সহজ শর্তে দেয়া হোক আমরাও সেইটাকে সঠিকভাবে নিতে চাই। এর জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট পলিসি এবং নীতিমালার চাই।

আমরা চাই বনানী লেকটা সুন্দর হোক
দরিদ্র মানুষেরা যে বৃহৎ স্বার্থে সম্পদের স্বদব্যবহার করতে পারে নীতিনির্ধারকগণ অনেক সময়ই তা মনে করেন না। তাদের অনেকেরই অভিযোগ যে কড়াইলবাসীকে কড়াইলের জমি ইজারা দেওয়া হলে বনানী লেক সহজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সীমানা চিহ্নিত থাকলে কড়াইলবাসী নিজেরায় যে বনানী লেকের পরিবেশ রক্ষা এবং একে দখলমুক্ত রাখতে সহায়তা করতে পারে সেরকম চিন্তার গুরুত্ব কোন আলোচনায় থাকে না।

লেকের দরকার আমাদের চেযে কার বেশি? আমরা তো চাই যে এই লেকটা আরও ভাল হোক আরও সুন্দর হোক। লেকটা যদি সুন্দর হয়, তাইলে আমরা এ পানিটা ব্যবহার করতে পারব, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগাতে পারব। এখানে মাছ ছাড়া হলে আমাদের দেশে যে মাছের ঘাটতি আছে সেটা পূরণ করা যাবে। কিন্তু দেখা গেছে যে আমরা গরীব মানুষ দেখে বলে ধারণা করা হয় যে আমরা লেক নষ্ট করে ফেলছি। অথচ গুলশান বনানীর যে বর্জ্য পয়ঃনিষ্কাশনের অনেকাংশ কিন্তু লেকে ছাড়া হয়, তাঁদের কিন্তু কোন দোষ দেওয়া হয় না, কিছু বলা হয় না। তাদের কোন কথাই আলোচনায় নাই।

আমরাও মানুষ- আমরা জন্ম বস্তিবাসী হিসাবে না
উপরের আলোচনা থেকে যে বিষয়টা সুস্পষ্ট তা হলো, নগর পরিকল্পনায় বস্তিবাসীর মৌলিক চাহিদা এবং তাদের বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা কখনই গুরুত্ত্বের সাথে স্বীকৃতি পায় না। প্রচলিত সমাজে একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর পক্ষে সবসময় চেষ্টা থাকে দুর্বল বস্তিবাসীদের সন্ত্রাসী ও অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে সামাজিক বিভাজন তৈরি করা এবং তার মাধ্যমে যৌথ সম্পদের অসমান বিভাজন নিশ্চিত করা। সরকার ও সরকারি প্রশাসন বস্তিবাসীদের কেবলমাত্র সমস্যা হিসাবে দেখেন এবং তার ফলে তাদের নজর থাকে প্রকল্প তৈরির মাধ্যমে বসতি-সমস্যার সমাধান করা। বস্তিবাসীরা যে সমাজের অন্যান্যদের মত শহরে সমান অধিকার দাবি করে এবং সরকারি কার্যকর্মে যে সমান স্বীকৃতি পেতে পারে সরকার কখনোই তা উপলব্ধি করে না। একইভাবে বিভিন্ন সুশীল সমাজ ও এনজিও দের কাছে বস্তিবাসীরা অনেকাংশেই পরিণত হয় দাতা সংস্থার কাছে উপস্থাপনযোগ্য মাধ্যম হিসাবে। এই লেখার প্রতিবেদনকারীর কাছেও সরকার, সুশীল সমাজ ও এনজিওদের এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর ফলে সৃষ্ট জটিলতা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

আমরা বস্তিতে থাকি বলে আমাদেরকে বস্তিবাসী বলা হয়। আমরা কিন্তু বস্তিবাসী হিসাবে জন্মাই নাই। আমরা কোন না কোন জাতির বিবেক, রাজনীতিবিদ বা সুশীল সমাজের আত্মীয়স্বজন। হয়ত তারা আমাদের পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। এখনো আমাদের বাসায় যদি উনারা যান, আমরা কিন্তু না খাওয়া হইলেও আমাদের খাবারটা তাদেরকে দেই। কিন্তু তারা আমাদের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে।

গুলশান বনানীতে যারা থাকে তাঁদের কিন্তু মান-সন্মানে খুব আঘাত হয় আমাদের বস্তি দেখে। অথচ তাদের বাসাতেই কিন্তু আমরা কাজ করি। তারা কিন্তু আমাদের জন্য থাকার জায়গাও রাখে নাই, আর আমাদের চলার জায়গাটাও দেয় নাই।

এই দেশের যে পরিকল্পনাগুলো করা হয় সেখানে কিন্তু দরিদ্র্য মানুষের কথা ওইভাবে আন্তরিকতার সাথে উল্লেখ করা হয় না। দরিদ্র মানুষের কোন অংশ গ্রহণ থাকে না। ফলে এই দেশে পরিকল্পনার কোন সঠিক বাস্তবায়ন হয় না। পরিকল্পনার 'পরি' আর কোন আলোর মুখ দেখে না, সবকিছুই হয়ে যায় 'কল্পনা'।

এই দেশে আমাদের সত্যিকার অর্থে মানুষ মনে করা হয় না। আমাদের যদি মানুষ মনে করা হতো তাইলে কিন্তু অবশ্যই আমাদের মৌলিক প্রয়োজনের কথা পরিকল্পনাগুলোর ভিতর থাকাতো। এ দেশের ৮০ ভাগ লোকই হচ্ছে গরীব এবং ঢাকার ৫০% লোকই বস্তিতে বসবাস করে। অথচ তাঁদের সবকিছু প্রয়োজন বাদ দিয়ে যদি পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে কি এ দেশে কোন পরিবর্তন সম্ভব?

আর কত কাল বস্তিবাসীরা একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষাই থাকবে? কবে "পরিপূর্ণ শহর" কথাটি বাস্তবতায় হবে যেখানে বস্তিবাসী দাতাসংস্থার সহযোগিতা খোঁজার মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হবে না, বরং তারা শহরের অন্য সবার মতন নিশ্চয়তার সাথে বসবাসের অধিকার পাবে। কবে সুবিধাভোগী শহরবাসীরাও বলবে কড়াইল বসবাসকারী আমাদেরই আমাদের মতন মানুষ এবং আমরা তাদের অধিকারের জন্য ঠিক সেভাবেই লড়াই করব যতটুকু আমরা নিজেদের জন্যও করতাম?

এখনই সময় কড়াইল বাসীর পাশে দাঁড়ানোর, তাদের পক্ষে শহর ব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা। কড়াইল সহ ঢাকার বস্তি বিষয়ক তথ্য ও আলোচনার সুবিধার্থে শীঘ্রই উম্মক্ত হতে যাচ্ছে একটি ব্লগ। একটি অন-লাইন পিটিসন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।

(লেখাটির মুলে আছে এক কড়াইলবাসীর সযত্নে দেওয়া ১৯ এপ্রিল ২০১২ তারিখের একটি প্রতিবেদন। আমরা তার মনখোলা বক্তবের জন্য আন্তকির ধন্যবাদ জানাই। প্রতিবেদনকারীর নাম এই লিখাই গোপন রাখা হল। লিখাটির চূড়ান্ত সংস্করণটি প্রতিবেদনকারীর অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে।)

শাহাদত হোসেনকির্স্টেন হাকেনব্রোখ জার্মানির স্কুল অফ স্প্যাটিয়াল প্ল্যানিং, টিইউ ডর্টমুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর বিষয়ক গবেষণাবিদ হিসেবে কর্মরত। ২০০৭ থেকে তারা করাইল সহ ঢাকার বিভিন্ন অংশের উপর নগর গবেষণায় যুক্ত।