মহাকাশে বাংলাদেশ – বঙ্গবন্ধু-১

Published : 29 May 2018, 05:32 PM
Updated : 29 May 2018, 05:32 PM

১২ই মে, ২০১৮ বাংলাদেশের জন্য নিশ্চয় একটি স্মরণীয় দিন, বাংলাদেশের নাম ঐদিন সুনিশ্চিতভাবে মহাকাশে প্রতিষ্ঠিত হল। সেই দিনে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম যোগাযোগ উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১কে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। মহাকাশযানটি তৈরি করেছে একটি ইউরোপীয় বহুজাতিক কোম্পানি Thales-Alenia এবং সেটিকে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের SpaceX প্রতিষ্ঠানের Falcon-9 রকেট। প্রথমেই বলে রাখি এই মহাকাশযানটির কাজই হল বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদির সম্প্রচার। পৃথিবীর ছবি তোলার জন্য এতে কোনো ক্যামেরার ব্যবস্থা নেই, কাজেই এর কাজ আবহাওয়া বা পৃথিবীপৃষ্ঠের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা নয়।

চিত্র ১: ফ্লোরিডার কেপ কানাভেরাল থেকে ফ্যালকন-৯ রকেটের উৎক্ষেপণ। বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহটি রকেটের মাথায় অবস্থিত। (ফটো মাইক কিলিয়ান, আমেরিকাস্পেস)

বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহটিকে মহাকাশে নিয়ে গেল স্পেস-এক্সের যে ফ্যালকন রকেটটি সেটি একটি বিশেষ রকেট যার নাম দেয়া হয়েছে ব্লক-৫। ব্লক-৫ এর রকেটটিকে পুনরুদ্ধার করে অন্তত ১০ বার ব্যবহার করা যাবে। তাই এই উৎক্ষেপণটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ভবিষ্যতে মার্কিন নভোচারীদের আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (ISS), চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে নিয়ে যাবার জন্য স্পেস-এক্স তার রকেটগুলো নির্মাণ করছে। নভোচারী নিয়ে যাবার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই মুহূর্তে কোনো নিজস্ব রকেট নেই, স্পেস স্টেশনে যাবার জন্য মার্কিন নভোচারীদের রুশ দেশের সোয়ুজ রকেটের ওপর নির্ভর করতে হয়।

উপগ্রহটির ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার বাংলাদেশ কমুনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড নামে একটি সংস্থার সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া জয়দেবপুর ও বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করা হয়েছে উপগ্রহটিকে পরিচালনার জন্য। বেশ কিছু প্রকৌশলী ও যন্ত্রবিদ এই ব্যাপারে থ্যালেস-আলেনিয়ার মাধ্যমে ট্রেনিং পেয়েছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ প্রকল্পের ডিজাইন বা নির্মাণ সময়ে বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা সেরকমভাবে হয়তো যুক্ত হতে পারেন নি। তবে ভবিষ্যতে আরো কোনো মহাকাশযান নির্মিত হলে এই বঙ্গবন্ধু-১এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে।

চিত্র ২: Thales-Aleniaর পরীক্ষাগারে বঙ্গবন্ধু-১ এর টেস্টিং। দেয়াল ও মেঝের শঙ্কুগুলো তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ শোষণ করে নিতে পারে যাতে ঘরের মধ্যে অনন্ত মহাকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। (ফটো Thales-Alenia)

ব্র্যাক অন্বেষা: বঙ্গবন্ধু-১এর পূর্বে মহাকাশে বাংলাদেশের একটা ছোট পদক্ষেপ ছিল। সেটা হল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত ন্যানোউপগ্রহ অন্বেষা। জাপানের কিউসু টেকনলজি ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় নির্মিত এক কিলোগ্রাম ভরের এই ক্ষুদ্র ঘনক উপগ্রহটি (যার একটি দিকের দৈর্ঘ হল মাত্র ১০ সেন্টিমিটার), ২০১৭ সনে, স্পেস স্টেশন থেকে একটি নিম্ন উচ্চতার কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছে। শুনেছি অন্বেষার চিত্রগ্রহণের ব্যবস্থা আছে, তবে আমি কোনো ছবি এখনো দেখি নি। এই ছোট উপগ্রহের (যার অন্য নাম হিম BIRD BB) তাৎক্ষণিক অবস্থানটি বিভিন্ন উপগ্রহ ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট দিয়ে সহজেই পাওয়া সম্ভব।

ভূ-স্থির ক্রান্তীয় কক্ষপথ: বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশযান নির্মিত হয়েছে মূলত তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ মাধ্যমে যোগাযোগের জন্য। পৃথিবীর বক্রতার জন্য দূরবর্তী বিন্দু থেকে বেতার তরঙ্গ প্রেরিত হলে সেটা পৃথিবীর বক্রতা অনুসরণ করতে পারে না, বরং সরলরেখায় মহাশূন্যে চলে যায়। কৃত্রিম উপগ্রহর কাজই হল মহাশূন্যে প্রেরিত তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গকে গ্রহণ করে তাকে পুনঃপ্রচারিত করা। কিন্তু সেই উপগ্রহের অবস্থান যদি ক্রমশ পরিবর্তিত হয় তাহলে তার উপযোগিতা কমে যায়। ধরুণ আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (ISS)। এই স্টেশনটি পৃথিবীপৃষ্ঠের ৪৫০ কিলোমিটার ওপরে প্রতি ৯০ মিনিটে একবার করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। কোনো যোগাযোগ উপগ্রহকে যদি ঐ কক্ষপথে স্থাপন করা যায় তবে সেটার সঙ্গে বার্তা প্রেরণ ও গ্রহণের সময় কয়েক মিনিটের বেশী হবে না। কিন্তু ঐ উপগ্রহকে যদি পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬,০০০ কিলোমিটার দূরত্বে স্থাপন করা যায়, তবে ঐ কক্ষপথে সেটার পর্যায়কাল হবে ২৪ ঘন্টা, অর্থাৎ প্রতি ২৪ ঘন্টায় সেটি পৃথিবীর চারদিকে একবার করে ঘুরবে। যেহেতু পৃথিবীপৃষ্ঠে আমরাও ২৪ ঘন্টায় একবার করে ঘুরি সেজন্য ঐ মহাকাশযানটিকে যদি আমাদের দ্রাঘিমায় (longitude) স্থাপন করা হয়, তবে সেটি সবসময় ঐ জায়গাটিতেই অবস্থান করবে, অর্থাৎ আমরা তাকে আমাদের আকাশে একই জায়গায় সবসময় দেখতে পাব।

চিত্র ৩: ভূমি থেকে ভূমিতে বেতার, টেলিভিশন, ভিডিও, ইন্টারনেট ইত্যাদি সঙ্কেত প্রেরণের জন্য উপগ্রহের ভূমিকা অপূরণীয়।

তবে যানটিকে ঠিক একই জাগায় রাখতে হলে তাকে শুধু আমাদের দ্রাঘিমায় স্থাপন করলে চলবে না, সেটাকে বিষুবরেখার ঠিক ওপরে রাখতে হবে। এই কক্ষপথকে ভূ-স্থির বা ভূ-স্থির ক্রান্তীয় কক্ষপথ (geostationary) বলা হয়। বাংলাদেশের প্রায় মধ্য দিয়ে ৯০ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার রেখাটি গিয়েছে। ইংল্যান্ডের গ্রীনিচ মানমন্দির শূন্য ডিগ্রী দ্রাঘিমায় অবস্থিত। যেহেতু ঢাকা প্রায় ২৪ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশে (latitude) অবস্থিত, সেহেতু ঐ উপগ্রহটি আমাদের মাথার ওপর (সুবিন্দুতে) থাকবে না, বরং সুবিন্দু থেকে ২৪ ডিগ্রী দক্ষিণে অবস্থান করবে। ২৪ ঘন্টা পর্যায়কালের ভূ-স্থির কক্ষপথে যোগাযোগ উপগ্রহ স্থাপনের ধারণাটি প্রথম জনপ্রিয় করেন বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী লেখক প্রয়াত আর্থার ক্লার্ক – ১৯৪৫ সনে।

স্পুটনিক: ১৯৫৭ সনে সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর কক্ষপথে স্পুটনিক-১ নামে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করে। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ কারণ পৃথিবীর নিকটবর্তী কক্ষপথে কোনো বস্তুকে স্থাপন করতে হলে সেকেন্ডে ৮ কিলোমিটার গতি সঞ্চার করতে হবে। এর জন্য চাই প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন রকেট ইঞ্জিন।

চিত্র ৪: পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিকের স্থাপন উপলক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের দুটি ডাকটিকিট। প্রথমটি ১৯৫৭ সনের, দ্বিতীয়টি মহাকাশযাত্রার ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৭২এর। দ্বিতীয় ডাকটিকিটের ডান দিকে একটি কল্পিত ঘুরন্ত মহাকাশ স্টেশন দেখানো হয়েছে।

বলতে গেলে স্পুটনিক-১ই হচ্ছে প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ। স্পুটনিক-১এর একটি বেতার প্রেরক যন্ত্র ছিল যেটি কিনা ২০ ও ৪০ মেগাহার্টজ কম্পাঙ্কে সংকেত প্রেরণ করছিল। ছোটবেলায় আমরা সর্ট-ওয়েভে বিবিসি, ভয়েস অফ অ্যামেরিকা শুনতাম ২ থেকে ২০ মেগাহার্টজ কম্পাঙ্কে (যার তরঙ্গদৈর্ঘ হচ্ছে ১৫০ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত)। এই বেতার তরঙ্গরা ২৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় আয়নমণ্ডলে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। যেহেতু ঐ বেতার তরঙ্গগুলো পৃথিবীর বক্রতা অতিক্রম করে ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত আসতে পারত, কাজেই বলা যায় অতি-উচ্চতার আয়নমণ্ডল ঐ তরঙ্গদৈর্ঘে যোগাযোগ উপগ্রহের কাজ করে।

তবে প্রথম কার্যকরী যোগাযোগ উপগ্রহ হল ১৯৬২ সনে কক্ষপথে স্থাপিত টেলস্টার (Telstar) উপগ্রহ যা কিনা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে প্রথম টেলিভিশন বার্তা সম্প্রচার করে। কিন্তু টেলস্টারের কক্ষপথ ছিল এমন যে সে আড়াই ঘন্টায় পৃথিবী প্রদক্ষিণ করত যার ফলে প্রতিটি প্রদক্ষিণে মাত্র ২০ মিনিট সময় পাওয়া যেত অতলান্তিক মহাসাগরের দুটি পাড়ের মধ্যে টেলিভিশন সংকেত বিনিময়ের। ভূ-স্থির কক্ষপথে প্রথম প্রকৃত উপগ্রহ ছিল Hughes কোম্পানী দ্বারা নির্মিত Syncom-3 যেটা কিনা ১৯৬৪ সনে জাপান থেকে অলিমপিক্সের খেলা উত্তর আমেরিকায় প্রচার করে।

চিত্র ৫: ভূ-স্থির বদলি কক্ষপথ (Geostationary Transfer Orbit বা GTO)। মহাকাশযান নিজস্ব জ্বালানী ব্যবহার করে উপবৃত্তাকার পথ থেকে বড় ব্যাসার্ধের গোলাকার কক্ষপথে নিজেকে স্থাপন করে।

ভূ-স্থির বদলি কক্ষপথ: একটি মহাকাশযানকে ভূ-স্থির কক্ষপথে স্থাপন করা কারিগরীভাবে একটা জটিল প্রক্রিয়া। সাধারণতঃ মূল রকেট মহাকাশযানটিকে পৃথিবীর কাছাকাছি একটা উপবৃত্তাকার পথের অনুভূ বিন্দুতে ছেড়ে দেয়। অনুভূ হল পৃথিবী পৃষ্ঠের সবচেয়ে কাছের বিন্দু। চিত্র ৫এর 2 নম্বর দিয়ে চিহ্নিত হলুদ রেখাটি হল এই কক্ষপথ। একে হোমান বদলি (Hohmann Transfer Orbit)) কক্ষপথ বা ভূ-স্থির বদলি কক্ষপথ (Geostationary Transfer Orbit বা GTO) বলা হয়। যানটি যখন ঐ কক্ষপথের অপভূ (সবচেয়ে দূরবর্তী অবস্থান) বিন্দুতে পৌঁছায় তখন সেটি নিজস্ব জ্বালানী ব্যবহার করে গতি বাড়ায়। এর ফলে যানটি বড় ব্যাসার্ধের একটি বৃত্তাকার পথ গ্রহণ করে (চিত্র ৫এর 3 নম্বর দিয়ে চিহ্নিত লাল পথটি)। তবে উপগ্রহটিকে শুধু ব্যাসার্ধ বাড়িয়ে কক্ষপথকে গোলাকার করলেই চলবে না, তাকে বিষুবরেখার সমান্তরাল হতে হবে। উৎক্ষেপণকেন্দ্রের অক্ষাংশ যদি বেশি হয় তবে বিষুবরেখার সঙ্গে কোণের পরিমাণও (কৌণিক অবনতি) বেশী হবে। মহাকাশযানটিকে একবারেই যে তার চূড়ান্ত কক্ষপথে যেতে হবে এমন নয়, সেটি তার নিজস্ব ইঞ্জিন বেশ কয়েকবার ব্যবহার করে এই কাজটি সমাধা করতে পারে। গত ১২ ই মে SpaceX রকেট বঙ্গবন্ধু-১কে একটা GTO উপবৃত্তাকার পথে স্থাপন করে যার অনুভূ ছিল ৩০০ কিলোমিটার, অপভূ ছিল ৩৫,০০০ কিলোমিটার আর বিষুবরেখার সঙ্গে কৌণিক অবনতি ছিল ১৯.৩ ডিগ্রী। পরবর্তী দুসপ্তাহ ধরে এই উপবৃত্তাকার পথকে বঙ্গবন্ধু-১ নিজস্ব জ্বালানী ব্যবহার করে, বিষুবরেখার সমান্তরাল (কৌণিক অবনতি প্রায় শূন্য ডিগ্রী), পৃথিবী কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪২,০০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের (ভূমি থেকে ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার ঊর্ধে) একটা বৃত্তাকার কক্ষপথে পরিণত করে।

চিত্র ৬: চিত্রকরের চোখে এশিয়ার ওপরে, বিষুবরেখার সমান্তরাল ভু-স্থির কক্ষপথে বঙ্গবন্ধু-১। (Thales-Alenia)

ভূ-স্থির উপগ্রহের সময়কাল: কী ধরণের জ্বালানী আছে বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশযানে? মহাকাশযানটি ব্যবহার করে হাইড্রাজিন (N2H4) ও নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড যেগুলো কিনা একে অপরের সংস্পর্শে এলে জ্বলে ওঠে এবং মিথষ্ক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তি নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী যানটিকে ধাক্কা দেয়।

পৃথিবী একটি আদর্শ গোলক নয়, অর্থাৎ এর পৃষ্ঠের মাধ্যাকর্ষণ সব জায়গায় সমান নয়। ভূ-স্থির কক্ষপথে স্থাপিত হলেও সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ, চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ এই ভূ-স্থির উপগ্রহগুলোকে সেগুলোর শূন্য ডিগ্রী অক্ষাংশ থেকে বিচ্যুত করে। এর ফলে প্রায়ই নিজের জ্বালানী ব্যবহার করে তাদের কক্ষপথ ঠিক রাখতে হয়। ভূ-স্থির মহাকাশযানগুলোতে ১২ থেকে ১৫ বছরের মত জ্বালানী থাকে, জ্বালানী একেবারে ফুরোবার আগে যানগুলোকে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে একটা অন্তিম কক্ষপথে নিয়ে আসা হয় যে কক্ষপথ থেকে কয়েক মাসের মধ্যেই বায়ুমণ্ডলের কণিকার সাথে সংঘর্ষে উপগ্রহটি বায়ুমণ্ডলে আপতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। কাজেই ভূ-স্থির উপগ্রহগুলোর স্থায়িত্বকাল ১৫ বছরের বেশী হয় না।

ভূ-স্থির কক্ষপথের স্থান সঙ্কট: কাজেই বিষুবরেখার ওপরে মহাকাশযান স্থাপন কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ নয়। অনেকেই জানেন বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহ ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ৯০ দ্রাঘিমাংশ শ্রেয়, কারণ ৯০ দ্রাঘিমা প্রায় দেশের মধ্য দিয়ে গেছে। মনে করা যেতে পারে যে ৪২,০০০ কিলোমিটার ভূ-স্থির ব্যাসার্ধের চক্রের পরিধি প্রায় ২,৬৫,০০০ কিলোমিটার, কাজেই সেখানে অনেক জায়গা আছে বহু উপগ্রহ স্থাপন করার জন্য। কিন্তু যেভাবে বেতার সঙ্কেত আদান প্রদান করা হয় সেই বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে এই কক্ষপথে কয়েক হাজারের বেশী উপগ্রহ স্থাপন করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ হল উপগ্রহগুলোকে খুব কাছাকাছি স্থাপন করা হলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রেরিত একটি উপগ্রহের জন্য সঙ্কেত পার্শ্ববর্তী উপগ্রহের গ্রাহক যন্ত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষতঃ তারা যদি একই তরঙ্গদৈর্ঘে কাজ করে। বোঝাই যাচ্ছে এর জন্য চাই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা। যে সংগঠন ভূ-স্থির কক্ষপথের স্থান বিতরণ করে সেটির নাম হল আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (International Telecommunication Union বা ITU)। যেহেতু মহাকাশ কারুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় সে'জন্য এই কক্ষপথে স্থান সংরক্ষণের জন্য টাকা দিতে হয় না, ITU যে প্রথম একটা নির্দিষ্ট স্থানের জন্য আবেদন করবে তাকেই জায়গাটা দেবে। কিন্তু বাংলাদেশের কাছাকাছি ভু-স্থির কক্ষপথ বেশ ব্যস্ত – এখানে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির উপগ্রহ ইতিমধ্যে স্থান করে নিয়েছে।

চিত্র ৭: যদিও এখানে ভূ-স্থির উপগ্রহগুলোকে স্কেল অনুযায়ী দেখানো হয় নি, তবু ভূ-স্থির কক্ষপথ কেমন উপগ্রহ-আকীর্ণ সেটা এই চিত্র থেকে বোঝা যায়। (সূত্র: ল্যাবভোল্ট কম্পুটার সিমুলেশন)

কক্ষপথ সংরক্ষণ: কক্ষপথ সংরক্ষণ একটা বেশ পুরোনো সমস্যা। মহাকাশে যান প্রেরণের ঊষালগ্ন থেকেই এটা বর্তমান। উন্নত দেশ ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথম থেকেই কক্ষপথের ভাল জায়গাগুলো দখল করে নেবে এরকম একটা ভয় উন্নয়নশীল দেশগুলো করছিল। ITU ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও প্রথম দিকে এই সমস্যাটা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারে নি। অন্যদিকে সংস্থাটি ভূ-স্থির কক্ষপথের স্থান সংরক্ষণের ব্যাপারের অনেক সূক্ষ্ণ দিক ধরতে পারে নি। এর অন্যতম উদাহরণ হল টোঙ্গার ঘটনা। ১৯৮০র দশকে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ টোঙ্গা বেশ কয়েকটি ভূ-স্থির কক্ষপথের স্থান ITU থেকে সংরক্ষিত করতে সক্ষম হয় এবং পরবর্তীকালে সেগুলোকে প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলার করে ভাড়া দেয়। ITU এরপরে তার নীতি বদলায়, কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান যদি অনুমতি মিলবার পাঁচ বছরের মধ্যে (বিশেষ কারণ দেখালে সাত বছর) ঐ স্থানে মহাকাশযান স্থাপন না করতে পারে তাহলে সে সেটির মালিকানা হারাবে।

চিত্র ৮: ভূমি থেকে নেয়া তিন মিনিট এক্সপোজারের এই ফোটোতে ১১টি ভূ-স্থির উপগ্রহ দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর আবর্তনের সাথে সাথে তারাগুলি পূব থেকে পশ্চিমে সরে গেলেও উপগ্রহগুলি এক জায়াগায় স্থির হয়ে আছে। Nimiq-4 কানাডার ডিজিটাল টেলিভিশনের উপগ্রহ, XM-3 গাড়িতে সরাসরি ডিজিটাল অডিও প্রেরণ করে, TKSAT-1 বলিভিয়ার প্রথম উপগ্রহ। এই ছবি থেকে বোঝা যাচ্ছে ভূ-স্থির কক্ষপথ কেমন উপগ্রহাকীর্ণ। (ছবি: Bob King, Sky & Telescope)

সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানছি বাংলাদেশ নাকি ১০২ ডিগ্রী ও ৬৯ ডিগ্রী অক্ষাংশের স্থানের জন্য আবেদন করেছিল। প্রথমটির জন্য নাকি অনেকেরই আবেদনপত্র জমা ছিল, আর দ্বিতীয়টি নাকি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীনের আপত্তিতে পাওয়া যায় নি। তবে প্রকৃত কারণগুলো যে এগুলোই সেটা সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনো তথ্য আমার হাতে নেই। (কী ধরনের আপত্তিতে ITUর মত স্বাধীন সংগঠন বাংলাদেশের আবেদন খারিজ করে দিতে পারে সেটা সংবাদমাধ্যমে বলা হয় নি, নিচের প্যারাগ্রাফে এই নিয়ে আমার একটা জল্পনা দেখতে পারেন।) এরপরে বাংলাদেশ প্রায় ২৮ মিলিয়ন ডলার দিয়ে Intersputnik নামে একটি রুশ সংস্থার কাছ থেকে কক্ষপথের ১১৯.১ ডিগ্রী দ্রাঘিমায় একটি স্থান কেনে। সংবাদমাধ্যমে এটাকে লীজ নেয়া বলা হচ্ছে। কী কারণে এটাকে লীজ বলা হচ্ছে সেটা আমার কাছে পরিষ্কার নয় কারণ কক্ষপথের কোনো অবস্থানই কারুর মালিকানায় নয়।

ট্রান্সপন্ডার: বঙ্গবন্ধু-১ এ ২৪টি Ku ব্যান্ডে ও ১৬টি C ব্যান্ডের ট্রান্সপন্ডার আছে। Ku ব্যান্ডে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের ১২ থেকে ১৮ গিগাহার্টজে (১ গিগা হল ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি) এবং C ব্যান্ড ৪ থেকে ৮ গিগাহার্টজে কাজ করে। C ব্যান্ডের গ্রাহক অ্যানটেনাগুলো বড় হয় (৩ মিটারের মত), অন্যদিকে Ku ব্যান্ডের গ্রাহক অ্যানটেনাগুলো ছোট হয় (০.৫ মিটারের মত)। তাই Ku ব্যান্ড দিয়ে উপগ্রহ থেকে সরাসরি বাড়িতে টেলিভিশন সঙ্কেত সম্প্রচার করা সম্ভব, কিন্তু যখন বৃষ্টি হয় এই তরঙ্গে অসুবিধা হতে পারে কারণ জলের ফোঁটা Ku ব্যান্ডের মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ শোষণ করে নেয়। ভূ-স্থির কক্ষপথে দুটো Ku ব্যান্ডের উপগ্রহ একে অপরের থেকে ১ ডিগ্রী (কোনো কোনো হিসাব মতে ২ ডিগ্রী) বা প্রায় ৭০০ কিলোমিটার তফাতে রাখার কথা। হতে পারে অন্য দেশগুলো বঙ্গবন্ধু-১ এর Ku ব্যান্ডের সম্প্রচার তাদের উপগ্রহগুলোর কাজে ব্যাঘাত করতে পারে বলে আপত্তি জানিয়েছে। এর মধ্যে খবরে দেখলাম টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু-২ উপগ্রহের কথা ভাবছে এবং সেজন্য ১০০ ও ৭৪ দ্রাঘিমায় দুটো স্থানের জন্য আবেদন ইতিমধ্যে করা হয়েছে।

চিত্র ৯: বিষুবরেখার ওপর ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমায় পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫,৭৮৭ কিলোমিটার উচ্চতায় বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহের অবস্থান। ছবিতে হাল্কা গোলাপী রঙে উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর দৃশ্যমান অংশ বা ফুটপ্রিন্ট দেখানো হয়েছে। তবে ফুটপ্রিন্টের বহিরাংশে উপগ্রহ থেকে পাওয়া সংকেতের শক্তি খুবই কম। সূত্র: http://www.n2yo.com/

বাণিজ্য: বঙ্গবন্ধু-১এর প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার প্রায় ২০০টি ডিজিটাল টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার করতে পারে। এছাড়া ঐ ট্রান্সপন্ডারগুলো কোনো ব্যক্তি বা কর্পোরেশন ভাড়া করতে পারে ফোন, ইন্টারনেট বা ভিডিও সার্ভিসের জন্য। Thales-Aleniaয়ের সঙ্গে উপগ্রহটির ডিজাইন, নির্মাণ, টেস্টিং ও উৎক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রায় ২৪৮ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করে। আগেই উল্লেখ করেছি এছাড়াও Intersputnik সংস্থার কাছ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলার দিয়ে একটা কক্ষপথের একটা স্থান কিনতে হয়েছে। এর জন্য HSBC ব্যাঙ্ক ১.৫% সুদে ১৮৯ মিলিয়ন ডলারের ১২ বছর মেয়াদী একটি ঋণ দিয়েছে, বাকিটা বাংলাদেশের থেকে সরাসরি আসবে। বাংলাদেশ (এবং দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো) প্রতি বছর প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার দিয়ে বিদেশী উপগ্রহ থেকে ব্যান্ড ভাড়া করে থাকে, সরকার মনে করে দেশ এই টাকাটা সাশ্রয় করতে পারবে। সরকার আরও মনে করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স ইত্যাদি দেশের সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরা এই মহাকাশযানের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া করতে পারে। কিন্তু ঐ দেশগুলোর নিজস্ব উপগ্রহ রয়েছে, এছাড়া বঙ্গবন্ধু-১র অবস্থান বাংলাদেশ থেকে একটু দূরে এবং মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি অঞ্চল এর সম্প্রচারের বাইরে পড়বে, তাই এই মুহূর্তে এটা পরিষ্কার নয় বাণিজ্যিকভাবে বঙ্গবন্ধু-১ কতখানি সফল হবে।

লাওস ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার তুলনা: তবে এই সূত্রে লাওসের ভূ-স্থির উপগ্রহ স্থাপনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার তুলনা করা যেতে পারে। লাওস্যাট-১ চীন দেশের ঋণে, চৈনিক কোম্পানি দিয়ে নির্মিত ও চৈনিক রকেটে উৎক্ষিপ্ত। এতে খরচ পড়েছে ২৫৮ মিলিয়ন ডলার। কাজেই চীনা সাহায্যে তৈরি উপগ্রহের খরচ কম পড়ে নি। এছাড়া ঋণদাতা চায়না এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট ব্যাঙ্কের সঙ্গে ঋণের শর্ত নিয়ে মাঝপথে বনিবনা হয় না, সেজন্য চীন কিছুদিনের জন্য উপগ্রহের ওপর কাজ থামিয়ে দেয়। এরপর তরঙ্গের কম্পাঙ্ক নিয়ে পার্শ্ববর্তী উপগ্রহদের মালিকদের সঙ্গেও সমঝোতা হতে দেরি হয়। সব মিলিয়ে লাওস তার জন্য কক্ষপথের নির্দিষ্ট স্থানটি প্রায় হারাতে বসে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ২০১৫ সনে কক্ষপথে মহাকাশযানটিকে স্থাপন করা সম্ভব হয়। তবে লাওসও তার নিজের দেশের ওপরে স্থান পায় নি, ১২৮.৫ পূর্ব দ্রাঘিমায় তার উপগ্রহ স্থাপন করতে হয়েছে। এছাড়া লাওস্যাট-১র ট্রান্সপন্ডার সংখ্যা মাত্র  ২২টি ও লাওস সরকার  উপগ্রহটির শুধুমাত্র  ৪৫% অংশের মালিক। লাওসের জনসংখ্যা মাত্র ৭০ লক্ষ, সেই তুলনায় লাওসের এই পদক্ষেপ নিশ্চয় খুব সাহসের কাজ, কিন্তু লাওসের এই প্রচেষ্টার তুলনায় আমি বলব বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে ভাল। মনে হয় থালেস-আলেনিয়া, স্পেস-এক্স ও HSBC ব্যাঙ্কের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার মোটামুটি একটা ভাল বোঝাপড়ার মধ্যে কাজ করেছে।

ভবিষ্যৎ – একটি নিবেদিত বৈজ্ঞানিক উপগ্রহ: বলা যায় বঙ্গবন্ধু-১র সাথে ভূ-স্থির কক্ষপথের একজন দাবিদার হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। মহাকাশে এরকম একটা পদক্ষেপ ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মহাকাশযান নির্মাণ, উৎক্ষেপণ ও কক্ষপথ নির্বাচনে সাহায্য করবে। আশা করা যায় দেশের মধ্যে মানুষকে এটা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে উৎসাহিত করবে। আমার মতে বাংলাদেশের দরকার একটি নিবেদিত পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের উপগ্রহ। এই যানটিকে নিম্ন মেরু-কক্ষপথে স্থাপন করা যেতে পারে। মেরু-কক্ষপথে উপগ্রহগুলো উত্তর-দক্ষিণে, বিষুবরেখার সঙ্গে লম্ব অবস্থায়, পৃথিবীকে আবর্তন করে। এর ফলে এই ধরনের উপগ্রহ পুরো পৃথিবীরই চিত্র ধারণ করতে পারে। এই যানটি দেশের বাইরে নির্মাণ করা যেতে পারে, কিন্তু এর বিভিন্ন চিত্রগ্রাহকসহ অন্যান্য যন্ত্রের ডিজাইন দেশের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা করতে পারেন। সরাসরিভাবে বাণিজ্যে এই উপগ্রহের অবদান না থাকলেও, পরোক্ষভাবে দেশের বন্যা বা খরা পরিস্থিতি, কিংবা মেঘনা মোহনায় নতুন জমির উত্থান, চাষ জমির ব্যাবস্থাপনা ইত্যাদির মাধ্যমে এটি দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক অবদান রাখবে। এছাড়া এই যানটির নির্মাণে সরাসরি অংশগ্রহণে দেশীয় প্রকৌশলের মান বাড়বে।

পুনশ্চ: একজন উৎসাহী ডাকটিকিট সংগ্রহকারী হিসেবে আমি একটু হতাশ হয়েছি যে বঙ্গবন্ধু-১র উৎক্ষেপণ বা কক্ষপথে স্থাপনার জন্য বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত কোনো ডাকটিকিট প্রকাশ করে নি।