মাদুরোর নির্বাচন এবং ভেনিজুয়েলার রাজনীতি

হাসান তারিক চৌধুরী
Published : 27 May 2018, 11:15 AM
Updated : 27 May 2018, 11:15 AM

ভেনিজুয়েলা! আজকের যুগের তরুণদের বেশ দোলায়- নাচায়। কোন তরুণ নাচে বামপন্থি শাভিস্তা বিপ্লবের দোলে। আবার কোন তরুণ হয়তোবা দোলে স্প্যানিশ সংস্কৃতির উদ্দামতার তালে। ক্যারিবিয় সাগরের উত্তর পারের এই ভেনিজুয়েলায় ২০ মে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে গেলো। বিদেশী গমমাধ্যম জানালো, ৬৮ শতাংশ ভোটে জিতেছেন শাভিস্তা বাম নিকলাস মাদুরো। দ্বিতীয় মেয়াদে আরো ছয় বছর ভেনিজুয়েলায় থাকছে বামের শাসন। জারি থাকছে দেশটির প্রয়াত নেতা হুগো শ্যাভেজের চিন্তাধারা।

মাদুরোর এই বিরাট বিজয় পশ্চিমের অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকের হিসেবকে তছনছ করে দিয়েছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে একটা প্রচলিত কথা ছিলো। শ্যাভেজের মৃত্যু, সমাজতন্ত্রের মৃত্যু। মানে শ্যাভেজের মৃত্যুর পর ভেনিজুয়েলা হাঁটবে পুঁজিতন্ত্রের পথে। মাত্র কিছুদিন আগেও চারদিকের আক্রমণে টালমাটাল ছিল শাভিস্তারা। রাজধানী কারাকাসে দাঙ্গা, নাশকতা, মাদকের বেশুমার ছড়াছড়ি, দুর্নীতি আর খাদ্যাভাব। গোটা দেশের চেহারাটা ছিল এমনই। পশ্চিমের অনেক মিডিয়াতো দেশটিকে প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েই দেয়! বিপুল পরিমাণ তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদ আর তার লোভে আসা বিদেশী লুটেরারা একটা দেশের মানুষকে কতটা মূল্যহীন করে তুলতে পারে? ভেনিজুয়েলা সম্ভবত একুশ শতকে তার এক বড় উদাহরণ। প্রতিদিন ৩৫ লক্ষ ব্যারেল তেল, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সোনা, হীরা, লোহা, নিকেল, বক্সাইট, কয়লা আর সিমেন্ট। লুটের জন্য বাড়ীর কাছে এমন কচি ভেড়ার ছানা আর কোথায় পাবে আঙ্কেল স্যাম? তাই ভেনিজুয়েলার সুন্দরী থেকে শুরু করে যৌবনবতী প্রতিটি তেলের খনিতে স্যাম চাচা এবং তার চাটার দলের লোভী চোখে আটকে ছিল। দশকের পর দশক যার মুল্য দিয়েছে, দেশটির সহজ সরল হৈ হুল্লুড় প্রিয় সাধারন মানুষ। আন্দিজ পর্বতমালার চেয়েও দীর্ঘ হয়েছে তাদের বৈষম্যের পরিসংখ্যান। কারাকাসের দামী হোটেলে নাচের ঝঙ্কার আর মদের ফোয়ারার তলা দিয়ে কত অনাহারীর কান্না বয়ে গেছে। তার হিসেব শাভিস্তারা রাখতে চেয়েছে। মজুরের বস্তি থেকে অট্টালিকার দূরত্ব ঘোচাতে চেয়েছে। সিমন বলিভারের সাদা ঘোড়ার চেয়ে আরো দ্রুত, তাঁর তরবারীর চেয়ে আরো আরো ধারালো উপায়ে। ভেনিজুয়েলার সাধারণ তরুণেরা এ ধার আর এ গতি পছন্দ করেছিল। এ অসাধারণ উপাখ্যানের নেতা ছিলেন কমান্দান্তে হুগো শ্যাভেজ। পরিবর্তনের এ শক্তি জনতার ভেতর থেকে উঠে আসা। ফলে অনেক অব্যাবস্থাপনা আর আর্থিক দৈন্যের পরও তরুণরা পরিবর্তনের পথকে ছাড়ে নি। বামপন্থী মাদুরো তাঁর এই পঞ্চান্ন বছর বয়সেও সে তারুণ্যকেই প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। বিদেশী লুটেরাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছেন। মাতৃভূমির সন্মানকে স্থান দিয়েছেন সবার আগে। যুবক যুবতিরা তাই তাঁর মাঝে এবারও শ্যাভেজকেই খুঁজে পেয়েছে। শাভিস্তাদের ভোটের মিছিলগুলোতে তাই তরুণমুখই বেশী। এই উদ্ধত তারুণ্যকেই ভয় স্যাম চাচার। চে গেভারা এ উদ্ধত তারুণ্যেরই একজন। তাই নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর আর চুপ থাকতে পারে নি সাম্রাজ্যবাদ। সারা দুনিয়ায় গনতন্ত্র রপ্তানি আর শান্তি রপ্তানির সস্তা খেলায় ক্লান্ত আঙ্কেল স্যাম এবার ভেনিজুয়েলার নির্বাচনকে বলছে 'শ্যাম ইলেকশন' । যুক্তরাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রপতি মিঃ মাইক পেন্স এ নির্বাচনকে 'শ্যাম' বলে গালি দিলেও সারা দুনিয়া থেকে আসা ১৫০ জন নির্বাচন পর্যবেক্ষক কিন্তু তা বলেন নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সদস্য থেকে শুরু করে অনেক নির্বাচন পর্যবেক্ষকই বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। মজার বিষয় হলো, ভেনিজুয়েলার নির্বাচনের সামান্য ত্রুটি নিয়ে যারা ব্যস্ত তারা মধ্যপ্রাচ্যের গনতন্ত্রহীনতাকে একেবারেই চোখে দেখেন না।

এতো কিছুর পরেও ভেনিজুয়েলার এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনেক সংবাদমাধ্যমের নজর কেড়েছে। তার কারণ হলো, নির্বাচনী লড়াইটা এবার শ্যাভেজের বর্তমান ও প্রাক্তন অনুসারীদের মধ্যেই হয়েছে। ২০১২ এর নির্বাচনের প্রার্থী কট্টর মার্কিনপন্থী হেনরিক ক্যাপ্রিলেসের মতো কেউ এবার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে নি। এর বদলে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে সামনে এসেছেন শ্যাভেজের 'ফিফথ রিপাবলিক মুভমেন্টের' সহযোদ্ধা হেনরি ফ্যালকন। কিন্তু  আইএমএফ এর পক্ষে তার সরাসরি ওকালতি ভোটাররা পছন্দ করেন নি। নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিয়েও তিনি নির্বাচনে ছিলেন। পরে হেরে গিয়ে বলেছেন, কারচুপি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন কট্টর শ্যাভেজ অনুসারী রোনালদো কুইজাদা। তিনি তাঁর প্রচারনায় বলেছেন, মাদুরো শ্যাভেজের কর্মসূচী ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে অক্ষম। শ্যাভেজের বিপ্লবী কর্মসূচী একমাত্র কুইজাদার দলই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এবারের নির্বাচনেও প্রয়াত শ্যাভেজই ছিলেন আলোচনা ও গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষে। শাভিস্তাদের বড় বিজয়টা এখানেই। সে কারণেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত মুখচোরা চীনও নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর ভেনিজুয়েলার পক্ষে কথা বলেছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র মিঃ লু কাং ২১ মে বলেছেন, 'ভেনিজুয়েলার নির্বাচনের ফলাফলকে সবার মেনে নেয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার সাথে বিরোধটা মিটিয়ে ফেলা'।

এখন কথা হলো, এ বিজয়কে ধরে ভেনিজুয়েলার বামেরা এগুতে পারবে কি না? কারণ, নির্বাচনের ঠিক পর পরই দেশটির উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা এনেছে ট্রাম্প প্রশাসন। মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অবরোধের মুখে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিদেশী মুদ্রার বিরাট ঘাটতি, টাকা থাকলেও বাজারে খাদ্য নেই আর হাসপাতালে নেই প্রয়োজনীয় ঔষধ। এখনো পর্যন্ত কিউবার সাহায্যে দাঁড়িয়ে আছে ভেনিজুয়েলার চিকিৎসা সেবা। জিডিপির ৫০ শতাংশ এখনো তেল রপ্তানি থেকেই আসে। মোট রপ্তানি বানিজ্যের ৮০ শতাংশই তেল রপ্তানি। ওপেকের সদস্য হয়ে, বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ হয়েও দেশটিকে 'ডাচ ডিজিজে' অর্থাৎ অতি উৎপাদন সংকটে ভুগতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে তেজি ঘোড়া দৌড়ালেও ভেনিজুয়েলার তেলের বাজারের জন্য অন্তত একটা গাধাও জোটেনি। বিদেশী শক্তির চক্রান্তই ছিল এর জন্য প্রধানত দায়ী। ৪০ এর দশক পর্যন্ত যখন দেশটির তেলের উপর মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর রাজত্ব ছিল, তখন কোন অভিযোগ ছিলোনা। কিন্তু ভেনিজুয়েলার তেলের উপর যখন দেশটির সাধারণ জনগনের কর্তৃত্ব আনার চেষ্টা হয়েছে, তখনই বিপদ দেখা দিয়েছে। সুতরাং তার রাজনৈতিক অর্থনীতির হিসেবটা বেশ পরিস্কার। মজার বিষয় হলো, ৭০ এর দশকে ভেনিজুয়েলার নামকরা তেলমন্ত্রী পাবলো আলফনসোর সময়ে অনেক ছাড় দিয়েও দেশটির জ্বালানী খাত বিদেশী চক্রান্ত থেকে রেহাই পায় নি। সুতরাং এই তেলরাজস্ব যা কিনা দেশটির জনকল্যাণমূলক অর্থায়নের মূল উৎস, সেটিই যদি বেহাল থাকে তাহলে মাদুরো সরকার দেশ চালাবে কি করে? অন্যদিকে রাজনীতিতে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা এখনো চলছে। যার ফলে অনেক সাধারণ মানুষ রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এর প্রভাব পড়েছে ভোটের দিনে। দেশটির নির্বাচন কমিশনের প্রধান টিবিসে লুসেনা নির্বাচনের পর বলেছেন, ২০.৫ মিলিয়ন ভোটারের মধ্যে মাত্র ৮.৬ মিলিয়ন ভোটার ভোট দিয়েছে। লুসেনার দেয়া এ তথ্য থেকেই বুঝা যায়, মাদুরো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে অনেক বেশী ভোটের ব্যাবধানে জিতলেও এতো বিরাট সংখ্যক ভোটারের ভোটদানে বিরত থাকা দেশটির রাজনীতির জন্য মোটেও ভাল লক্ষণ নয়। এ বিরত ভোটাররাই হবে আগামী দিনে দেশটির রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক। যাদেরকে কাজে লাগাতে তৎপর হবে শাভিস্তাদের বিরোধী শক্তি। মার্কিন লবি এ জনগণকেই খুঁজে বেড়াবে। প্রণোদনা দেবে। মার্কিনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে ইতোমধ্যেই দুজন মার্কিন কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন মাদুরো। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা সেদেশের নির্বাচন এবং অভ্যন্তরিণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। তার মানে শুরুটাই বেশ তীব্র এবং টান টান। শাভিস্তাদের এ লড়াই তখনই বল পাবে যখন শ্রমিকের মজুরি আর দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ঠিকঠাক থাকবে। মাদুরোর সামনে এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে আইএমএফ বলছে, এবছর মুদ্রাস্ফীতি উচ্চহারে বাড়বে এবং এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেকারত্বও বাড়বে। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ এর এসব হুঙ্কারের পরও মানুষ বামেদের ভোট দিয়েছে। কারণ ল্যাটিনের মানুষ খুব কাছে থেকে বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফকে দেখেছে। এই পরিস্থিতিতে ভেনিজুয়েলার পাশে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ইরান এবং ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় সবকয়টি দেশ। আর রয়েছে ভেনিজুয়েলার বিশাল সামাজিক আন্দোলন আর যুব আন্দোলন। বিজয়ী হবার পর এ দুই শক্তিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মাদুরো। এই যুবরাই হয়তো স্যাম চাচার খবরদারী থেকে ভেনিজুয়েলাকে রক্ষা করবে। গড়ে তুলবে 'সবার আমেরিকা'। এ পথ বড়ই দুর্গম। তাই দুর্গম পথের যাত্রী হবার জন্যে শাভিস্তাদের অভিনন্দন।