সংখ্যালঘু স্বার্থ এবং ভোটের রাজনীতি

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 20 May 2018, 12:00 PM
Updated : 20 May 2018, 12:00 PM

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে গত ১৮ মে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য সংখ্যালঘুদের মনে খুব আশাবাদ তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বর্তমানে যে মানসিক চাপ ও অস্থিরতার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন, তাদের মধ্যে যে উদ্বেগ ও ভীতি কাজ করছে তা নিরসনের জন্য যে ধরনের আশা জাগানিয়া বক্তব্য শাসক দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তির কাছে প্রত্যাশিত ছিল, তিনি তা দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তার বক্তব্যে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, কিন্তু সেটা উপস্থিত কতোজনের মন ছুঁয়েছে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের সুযোগ আছে।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছোটখাটো ভুলত্রুটি নিয়ে বসে থাকলে বড় ভুলত্রুটি হবে। ২০০১-এর নির্বাচনের পরের কথা মনে নেই? ২০০১, ২০০৩-এর নির্যাতনের কথা ভুলে গেছেন? আপনাদের জন্য আমাদের চেয়ে বেটার কেউ না। আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। পাকিস্তানের বন্ধুরা আপনাদের বন্ধু হতে পারে না।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এসব বক্তব্যে সংখ্যালঘুরা খুব উৎফুল্ল বা উৎসাহিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা এক সময় আওয়ামী লীগকেই তাদের বড় বন্ধু এবং নির্ভরতার জায়গা বলে মনে করতো। নির্বাচন এলে দলবেধে কোনো অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে নৌকায় ভোট দিতো। ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে পরের সবগুলো নির্বাচন আমি নিজে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। দেখেছি সংখ্যালঘুদের সংঘবদ্ধভাবে নৌকায় ভোট দিতে। আমি নিজে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থক ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন-সিপিবির কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে পেরে গৌরব বোধ করতাম। আমরা মনে করতাম, বামপন্থীরাই সংখ্যালঘুদের প্রকৃত বন্ধু। কমিউনিস্টদেরই তখন সাচ্চা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাহারাদার বা হেফাজতকারী মনে করা হতো। অথচ ভোট এলে দেখতাম আমাদের পরিবারের সদস্যরাও আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার জন্য কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠতো। ১৯৭৩ অথবা ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে দিনাজপুর সদর আসনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে কুঁড়েঘর মার্কা নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন তেজেন নাগ। তিনি এতো কম ভোট পেয়েছিলেন যে আমরাও মজা করে বলতাম গুরুদাস তালুকদারও তাকে ভোট না দিয়ে নৌকায় ভোট দিয়েছেন! গুরুদাস তালুকদার ছিলেন দিনাজপুরের খ্যাতনামা ত্যাগী কমিউনিস্ট নেতা। অর্থাৎ সংখ্যালঘু ভোট আওয়ামী লীগের জন্য বাধা বলে ধরে নেওয়া হতো।

কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। গত কয়েকটি নির্বাচন থেকে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘুরা আর পাগলের মতো নৌকায় ভোট দেয় না। আবার নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-জুলুম একপ্রকার নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতির অসহায় শিকার এখন সংখ্যালঘুরা। তাদের কাছে সবাই ভোট চায় কিন্তু তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। সংখ্যালঘুরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এখন শুধুই 'ভোটার', মানুষ নয়।
যে সিপিবি বা বামপন্থীদের একসময় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিশ্বস্ত মিত্র বলে মনে করা হতো তারাও রাজনীতির জটিল সমীকরণে সংখ্যালঘুদের বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়ানোর গরজ বোধ করে না। তারা যাদের ভোট দেয়, তারাই তাদের রক্ষা করুক – এই হলো মনোভাব। তাছাড়া তাদের শক্তি-সক্ষমতাও এখন একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখন সংখ্যালঘুদের ঘরে আগুন লাগলে আগুন নেভানোর লোক পাওয়া না গেলও আলু পোড়া দেওয়ার লোক ঠিকই পাওয়া য়ায়।

ধর্ম রাজনীতির একটি বড় ফ্যাক্টর হওয়ায় আওয়ামী লীগও আর সংখ্যালঘুদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। সংখ্যালঘুরা দিন দিনই সংখ্যায় কমছে। ভোটের রাজনীতিতে সংখ্যা একটি বড় বিষয়। সংখ্যালঘু ভোট দেশে এখন সম্ভবত শতকরা দশ ভাগও নয়। তাই সবার মনোযোগ এখন শতকরা ৯০ ভাগ ভোটের দিকে। সংখ্যালঘু ভোট বিভক্ত হওয়ায় তাদের দরকষাকষির ক্ষমতাও এখন কমেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি শুরু হওয়া, সামরিক শাসক জিয়া, এরশাদের ইসলামপ্রীতি, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্র ধর্ম সংযোজন ইত্যাদি মিলিয়ে এক অদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সংখ্যালঘুরাও বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত হয়ে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছে বলে আমার মনে হয়।
সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গড়ে উঠেছে একাধিক সংগঠন, একাধিক রাজনৈতিক ধারায়। এই সংগঠনগুলোর যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা ব্যক্তিগতভাবে কিছু লাভবান হলেও হতে পারেন, কিন্তু সম্প্রদায়ের কল্যাণে তারা কতোটুকু কি করতে পারছেন, আমার কাছে অন্তত তা পরিষ্কার নয়।

পূজা উদযাপন পরিষদের সম্মেলনে সংখ্যালঘু নির্যাতনকে বিএনপির 'পলিসি' আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, নির্বাচন এলে সংখ্যালঘুদের জন্য মায়াকান্না দেখায় বিএনপি। ২০০১ সালের পর ক্ষমতায় থাকতে সংখ্যালঘুদের ওপর অনেক অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। এটা ছিল তাদের সরকারের পলিসি। তবে ভুলত্রুটি আমাদেরও আছে। আমাদের সরকারের সময় মাইনরিটিদের ওপর দু'একটি বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটেছে। এটা আওয়ামী লীগের পলিসি নয়। দুর্বৃত্তরা এটা ঘটিয়েছে। আর দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে সরকারের 'জিরো টলারেন্স' রয়েছে।
ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য শতভাগ সত্য বলে মেনে নিতে পারলে ব্যক্তিগতভাবে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হতো না। কিন্তু সারাদেশে সংখালঘু নিগ্রহের যে সব তথ্য ও চিত্র আমার সংগ্রহে আছে তাতে আমি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যকে খোলা মনে স্বাগত জানাতে পারছি না। সংখ্যালঘু নির্যাতনকে তিনি বিএনপির 'পলিসি' বলে উল্লেখ করেছেন। তার এই কথাটা ঠিক। বিএনপি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে না। মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির মিল বা সাদৃশ্য আছে। মুসলিম লীগ সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতো, বিএনপিও তাই করে। সংখ্যালঘুরা দেশে থাকবে, তবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। তারা সমান অধিকার পাবে না, সমান মর্যাদা পাবে না।

মুসলিম লীগ নেতা চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করেছিলেন এই কথা বলে যে, 'আপনারা তো আমাকেই ভোট দেবেন, তাই কষ্ট করে আর ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই'। বিএনপিও এই নীতিতে বিশ্বাসী। সংখ্যালঘুরা ভোট কেন্দ্রে গেলে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে – এই ভীতি থেকে তাদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়া থেকেই বিরত রাখতে চায়। ভয়ভীতি দেখায়। সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতেই তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন।
এখন সংখ্যালঘুরা এক মার্কায় ভোট না দেওয়ায় তাদের বিপদও বেড়েছে। ভোটের রাজনীতির সব পক্ষের 'সফট টার্গেট' এখন সংখ্যালঘুরা। আগে আওয়ামী লীগ যেভাবে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতো এখন তেমন দাঁড়ায় না। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তাদের সময় 'দু'একটি বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটেছে' তবে এটা 'আওয়ামী লীগের পলিসি নয়', ওটা 'দুর্বৃত্ত'রা করেছে এবং দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে সরকারের নীতি 'জিরো টলারেন্স'। তার এসব কথায় যথেষ্ট ফাঁকিজুকি আছে। প্রথমত আওয়ামী লীগের শাসনামলে দুচারটি নয়, অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে যাতে সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন হয়েছে। লুটপাট, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধও সংঘটিত হয়েছে। আর যে দুর্বৃত্তরা এসব করেছে তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তদের মধ্যে আওয়ামী লীগের পরিচয়ধারীদেরও দেখা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের খবর জানা যায়নি। মানুষ চোখে দেখা সত্যকে অস্বীকার করবে কীভাবে?

আওয়ামী লীগকে সংখ্যালঘুরা তাদের 'রক্ষক' বলে মনে করে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভক্ষকের ভূমিকায় দেখে তাদের অসহায়ত্ত্ব এখন চরমে। নিরাপত্তাহীনতা অথবা আত্মরক্ষার তাগিদ থেকে সংখ্যালঘুদের কেউ কেউ বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টিতে নাম লিখিয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের মূল বা বড় অংশই এখনও আওয়ামী লীগের ওপরই ভরসা রাখছেন। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কতোটুকু দলের অসাম্প্রদায়িক নীতি উর্ধ্বে তুলে ধরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে বিষয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে। আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো বিকল্প নেই – এটা ঠিক। কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট না দিয়ে ভোটদানে বিরত থাকার চিন্তাভাবনাও কারো কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা যাতে নিজেদের সংখ্যালঘু না ভাবেন, সে পরামর্শ দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়াসহ দলের বিভিন্ন কমিটিতে সংখ্যালঘুদের রাখা হয়েছে। সংখ্যালঘুরা কেউ স্বেচ্ছায় নিজেদের সংখ্যালঘু ভাবেন না। এটা তাদের ভাবতে বাধ্য করা হয়। এটা ঠিক যে, বিএনপি আমলে চাকরি, পদোন্নতি, পদায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা যেভাবে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, আওয়ামী লীগের আমলে তা হয়নি। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সরকারি চাকরিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রধান বিচারপতি পদেও একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যকে নিয়োগদানও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসাযোগ্য একটি অবদান।
দেশে আবার একটি নির্বাচন আসছে। সংখ্যালঘুরা উদ্বিগ্ন, ভীত। তাদের ওপর আবার কোনো কালো থাবা নেমে আসবে কি না তা নিয়ে তারা রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে যে ধরনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সরকার তথা আওয়ামী লীগের কাছে সংখ্যালঘুরা চান তা পাচ্ছেন বলে মনে হয়না। সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা ফরিয়ে আনতে হলে কি করতে হবে সেটা তাদের কাছ থেকে জেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কেবল 'এমন বন্ধু আর কে আছে' গান শুনিয়ে কাজ হওয়ার দিন ফুরিয়েছে।