নির্বাচন ভীতি ও নির্বাচন প্রীতি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 17 May 2018, 01:42 PM
Updated : 17 May 2018, 01:42 PM

এখন নির্বাচন মানেই প্রশ্ন। আগে নির্বাচন ছিলো যুগপৎ আনন্দ ও ভয়ের উৎস। সত্তরের নির্বাচনের কিছু স্মৃতি এখনো মনে আছে। সে কি উৎসাহ আর উদ্দীপনা। মায়েরা সবাই সকাল থেকে তৈরি। বাবারা ভাইয়েরা রাতে ঘুমাতে পারেননি। বাংলাদেশের ভিত্তি তৈরি করার সেই নির্বাচনের পর আজ অবদি এমন কোন নির্বাচন হয়নি যাকে এর সাথে তূলনা করা চলে। বঙ্গবন্ধুর আমলে যে নির্বাচন কেবল সেটি ই ছিলো সর্বজনস্বীকৃত। এরপর সামরিক শাসনে হাঁ না ভোটে জিয়াউর রহমান এর বারোটা বাজানোর চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে এরশাদ আমলে পরিণত হয় প্রহসনে। বিএনপি আমলে জোর জবরদস্তির নির্বাচন এখন তার জৌলুস হারিয়ে নির্জীব আর একতরফা। বাস্তবে কেউ আর এর পরোয়া করেননা।

এতে দেশের লাভ লোকসান নিয়েও মানুষের আর মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয়না। বলে রাখি পুরো দুনিয়ায় এখন নির্বাচন বিষয়টা বদলে গেছে। উন্নত ও সভ্য নামে পরিচিত সমাজে এটি কেবল সরকার পরিবর্তনের হাতিয়ার। আমি যে-দেশে বাস করি সেখানে রাজনীতির এমন দুর্দশা ভোট দিতে না গেলে জরিমানা দিতে হয়। আমার ধারণা ফাইন না থাকলে দশ ভাগ মানুষও ভোট কেন্দ্রে যেতো না। কারণ মানুষের অনেক কাজ। আর এই কাজগুলো নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার দায়িত্ব পালন করছে রাজনীতি। যার মানে, রাজনীতি মানুষকে তার নিরাপদ জীবন ও সুখ দুঃখ ভোগের ব্যবস্হা করে দিয়েছে বলেই আধুনিক দেশের মানুষ তার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তাদের জানা আছে যেই আসুক সরকারে তাকে কর দিতে হবে। নিজের বিল নিজে পরিশোধ করতে হবে আর উপার্জনও তার নিজের দায়। ফলে মিছিল মিটিং এগুলো অনেক আগে যাদুঘরে ঠাঁই করে নিয়েছে।

আমাদের বাস্তবতায় দুটো সত্য বিরাজমান। একটি হলো মানুষ এখন ভালো আছে। বিশেষত তারুণ্যের কাছে রাজনীতি মূলত পচা একটা বিষয়। তাদের চোখের সামনে খুলে যাওয়া বিশ্ব মিডিয়া হাতে হাতে সামাজিক মিডিয়ার বাটন তাদের এতটা ব্যস্ত রাখে যে সময়ই নেই এসব নিয়ে ভাবার। দেশ থেকে বেড়াতে  আসা তরুণ তরুণী বা এই বয়সের কাউকে পেলে আমি প্রশ্ন করে দেখেছি তারা এখনকার রাজনীতিবিদ কিংবা মন্ত্রী মিনিষ্টারদের চেনেই না। তারা শুধু চেনে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়া বড়জোর এরশাদকে। এই যেখানে হাল সেখানে রাজনীতি ও মিডিয়া এমন ভাব করে যে যেন তাদের ছাড়া দেশ চলেনা। দুটোই ফাঁপা।

তারপর ও আমাদের দেশ ও সমাজে রাজনীতির বিকল্প নাই। তার অনেকগুলো কারণ। দেশ এগুলেও সমাজ এগোয়নি। এর স্তরে স্তরে মৌলবাদ। জঙ্গী বা উগ্র রাজনীতি সক্রিয়। আছে দেশ ও ইতিহাস নিয়ে নানা কূট তর্ক। যতদিন মূল বিষয়গুলো ঠিক না হচ্ছে ততদিন রাজনীতি কেবল রাজনীতি হতে পারবেনা। কারণ এর সাথে এখনো বাংলাদেশ এবং তার অস্তিত্ব জড়িয়ে। আমাদের মত মানুষদের কষ্ট ও বেদনার কারণ সেটাই। যাদের আমরা উপায়হীন ভাবে সমর্থন করি সেই আওয়ামী লীগে বিএনপির চাইতে চোর ডাকাতের সংখ্যা বেশী। এদের আমলে দুর্নীতি ও জোর জবরদস্তি এতটা বাড়ে মানুষ ভয়ে আতংকে দিন কাটায়। জনগণের ইচ্ছে ও ভালোবাসাকে পায়ে দলার ব্যাপারে এদের আগ্রহ এত বেশী যা আর কোন দলে নাই। অথচ আমরা চোখ বুজে তাদের মুক্তিযুদ্ধের দল বলে সমর্থন দিয়ে থাকি। নির্বাচন নিয়ে আজকে বাংলাদেশে যত কুয়াশা যত ঝামেলা তার পেছনে এই কারণগুলো। দল যদি শেখ হাসিনার মত নিজেকে বড় করে তুলতে পারতো এবং তাদের ভালো কাজ ও অর্জনগুলো মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারতো তাহলে নির্বাচনভীতি দূর হতো। এটা বাচ্চাও জানে বোঝে আওয়ামী লীগ যতই বলুক আর যত করুক তাদের জনপ্রিয়তা নিয়ে সংশয় আছে।

যে জায়গাটা সমর্থন করতে পারিনা সেটা হলো এই অপ্রিয়তার নেপথ্য কারণ। মূলত  সাম্প্রদায়িকতা আর দেশকে পাকি কায়দায় চালানোর বিষয়গুলো যেহেতু আওয়ামী লীগ হটানোর নেগেটিভ কারণ সে জন্যে আমরা তাদের সমর্থন করতে পারিনা। আর এই সুযোগে আওয়ামী লীগও তাদের জোর চালিয়ে যায় । এখন প্রশ্ন হচ্ছে  দেশ কি এভাবেই চলবে? না  কোন সাধারণ সহজ নির্বাচনে মানুষ ফিরে যাবে স্বাভাবিক নিয়মে? কিন্তু যেটা দেখছি তাতে ভরসা কোথায়?  আজ নির্বাচনের তফসীল হলে কাল বন্ধ। বন্ধ নাহলে দলাদলি। না হলে জয় পরাজয় নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আর হতাশা। তাহলে কি মানুষ ধরে নেবে না  যে আওয়ামী লীগ আসলে ভয় পাচ্ছে?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নেতাদের কথা শুনলে মনে হয় তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করার মত কেউ নাই। অথচ নির্বাচন  এলেই দেখছি নানা ধরণের গুজব। নানা ধরণের বিভ্রান্তি আর ঝুট ঝামেলায় সরকারের ইমেজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তার হিসেব রাখছেন না নেতারা। চারদিকে এত আওয়ামী লীগ এত দল এত শাখা এত প্রশাখা তবু ভোট ভীতি। বিদেশেও শান্তিতে থাকতে পারছিনা  আমরা। চার পাঁচটা আওয়ামী লীগ। কোন নেতা এলে কে তাঁকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাবে কে দুপুরে ভোজ খাওয়াবে আর কে নৈশ ভোজ–এই প্রতিযোগিতায় বাঙালিরা মুখ লুকিয়ে হেসে হেসে এখন ক্লান্ত। তাদের চোখে মুখের বিরক্তি জানার চেষ্টা দূরে থাক অন্ধরা তাকিয়ে দেখেও বুঝতে পারেনা। এগুলো কেবল গদী আর সরকারে থাকার কুফল। আজ মাঠে ফিরে গেলে কাল কি হবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও বোঝেন বলে মনে হয়না। সব দায়দায়িত্ব তারা বঙ্গবন্ধু কন্যার কাঁধে চাপিয়ে আয়েশে রাজত্ব করে চলেছেন।

নির্বাচন প্রীতির আওয়ামী লীগে আজ যে নির্বাচন ভীতি তাকে অস্বীকার করা যাবেনা। নেই নেই করেও জাতীয়তাবাদীরা আছে। তাদের কোথাও নাথাকা এতটাই শক্তিশালী যে লীগের নেতারা স্বপ্নেও তাদের দেখে আর সে কথাই বলতে থাকে। তাই নির্বচান এলেই প্রশ্ন জাগে আসলে কারা জনপ্রিয়? শেখ হাসিনা বা সৈয়দ আশরাফের মত নেতাদের বাদ দিলে এটা যে কোনদিকে ঝুঁকবে বলা মুশকিল। নির্বাচনভীতি  কাটাতে হলে মাঠের রাজনীতি মাঠে ফেরা আর মানুষের মনস্পন্দন বোঝা জরুরী। বিচার ফাঁসী ঘটনা দুর্ঘটনার নাটকে ভরা রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ তা ভুলে বসে আছে। আর ধীরে ধীরে তারাই ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে বা উঠবে যাদের আমরা মুক্তিযুদ্ধের দোহাই ইতিহাসের দোহাই দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখছি। বঙ্গবন্ধুর দেশ জয় বাংলার দেশ আর শেখ হাসিনার উন্নয়নের সমাজে নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে না পারলে রাজনীতি এগুবে কিভাবে?

বাংলাদেশের স্বার্থে জনগণের জন্য এই জায়গাটা অচিরেই পরিষ্কার করতে হবে। দেশে ডান বাম সব শক্তিকে আমরা দেখছি নিস্ক্রিয়। আর তলে তলে সবাইকে আক্রমণ করেছে মৌলবাদের নীরব ঘাতক। খসে পড়ছে নৈতিকতা। নেই মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা। চারদিকে কেবল খাই খাই ভাব। এই খাই খাই থেকে মুক্তি আর দেশ ও সমাজে আলোময় করার জন্য শুদ্ধ নির্নাচনমুখি রাজনীতি আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকেই লাভবান করবে। কারণ বারবার প্রমাণিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা ও  মুক্তিযুদ্ধ  ঠুনকো নয়। তার আপন শক্তিই যথেষ্ট সমাজ ও দেশ বাঁচাতে। তাই এখনই সময়।