বাংলাদেশের জন্য চাই একশ জন প্রধানমন্ত্রী

আকতার হোসেন
Published : 12 May 2018, 04:48 PM
Updated : 12 May 2018, 04:48 PM

নয় বছর পর আবারো ভিজিটর হয়ে দেখে এলাম জন্মভূমি বাংলাদেশ। অনেকদিন পর বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে গিয়ে প্রবাসী বন্ধুদের যে অভিযোগ ও বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখেছি তার অন্যতম হল; যানজট, মশা, লোডশেডিং, অত্যধিক গরম, ধুলাবালি, যেখানে সেখানে থুথু ফেলা ইত্যাদি।
অভিযোগের তালিকা অনেক লম্বা ছিল তবে সময় পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে আস্তে আস্তে সেই তালিকা ছোট হয়ে অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। যোগ দিচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। এই সমস্ত সমস্যার কিছু ভোগাচ্ছে রাষ্ট্রকে আবার কিছুটা যাচ্ছে নাগরিকদের ওপর।
প্রথমে ভেবেছিলাম এগুলো নিয়ে কোন অভিযোগ করবো না। অভিযোগের খুব সুযোগ আছে তাও বলা মুশকিল। ধরুন যানজট নিয়ে যদি কিছু বলতে হয় তবে বলবো লক্ষ লক্ষ নাগরিক যেখানে প্রতিদিন অসহ্য কষ্ট সহ্য করছে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনরকম ভাবে মানিয়ে নিয়ে দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছে সেখানে কিছুদিনের অতিথি হয়ে আমি কেন উন্নত বিশ্বের যাতায়াত ব্যবস্থার সাথে তুলনা করে মন ভারী করবো।
দেশে যাবার আগে তো সব জেনেশুনেই গিয়েছিলাম। আফ্রিকার কোন দেশে গেলে যেমন আফ্রিকান পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়, ইউরোপে গেলে যে ভিন্নতা দেখা দেয় অথবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গিয়ে যে সুবিধা অসুবিধার সম্মুখীন হই, বাংলাদেশে গেলে তেমনি দেখবো, এতে অবাক হব কেন?

কিন্তু কথা হলো সবাই বড় গাছের সাথে নৌকা বাঁধতে চায় এবং সবাই আশা করে উন্নত জীবন ব্যবস্থা। বিশেষ করে আশপাশের কয়েকটি দেশের চকচকে নগর সভ্যতা দেখে বাংলাদেশের লোকজন বলতেই পারে ওরা পারলে আমরা পারবো না কেন?
বাস্তবতা হলো যিনি এই প্রশ্ন করেন তিনি হয়তো লক্ষ্য করেন না এই না পারার একটি কারণ হয়তো তিনি নিজে অথবা তারই আত্মীয়স্বজন। আকাশ থেকে দৈত্যদানব এসেতো যানজট তৈরি করে না। এর জন্য দায়ী আমাদের নিজস্ব লোকজন। পেছন থেকে একবার সামনে হেঁটে গেলেই দেখা যাবে যিনি গাড়িটা বাঁকা করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন কিংবা অবৈধ পার্ক করে বসে আছেন তিনি আমাদেরই চাচা খালা ফুপা ফুপুর কেউ।
খুশির খবর হলো কিছু অসুবিধা ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির ভেতর দিয়েও বাংলাদেশে উন্নয়নের কাজ জোর গতিতে এগিয়ে চলছে। অর্থনৈতিক মানদণ্ডের অনেক সুচকে বাংলাদেশ এখন অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে আছে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে বাংলাদেশের জিডিপি মাথাপিছু আয় ২০১৬ সালে ছিল ১৩৫৮.৭৮ মার্কিন ডলার (এই সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল ৯৫১.৮৯, ২০০০ সালে ৪০৫.৬ আর ১৯৭২ সালে ছিল ৯৩.০২)। দ্রুত গতিতে অগ্রসরমান একটি রাষ্ট্রে যা হয় তার অনেক কিছুই এখন বাংলাদেশে পরিলক্ষিত। সাইকোলজিক্যাল শকের মত সমাজ উত্তরণের শকের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশের অধিকাংশ মানুষ। বলা যায় অগ্রগতির প্রসব বেদনায় ভুগছে বাংলাদেশ। স্বভাবতই বিভিন্ন মাত্রার ওঠানামা করতে দেখা যাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন অংশে। যার হয়তো একটা সাইকেল কেনার সামর্থ্য ছিল না তার ঘরেও দুই তিনটা গাড়ি। হাতখোলা পুঁজি বাজারে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অর্থনৈতিক সচল মানুষগুলো চায় সমাজের উঁচু আসন ধরে রাখতে। এক অর্থে এই প্রবণতাকে বলা যেতে পারে ক্রয় করা সামাজিক মর্যাদা। তাই নিজস্ব সুবিধা আদায়ের জন্য নব্য ধনীরা দেশের ব্যবসায়ী আইন কানুন উপেক্ষার মতন ট্রাফিক আইনও অমান্য করে। এরা একা নয়, তাদের ঘরের অন্যরাও পথে নেমে তাই করছে। কাজেই জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে জ্যাম।
একবার লালমাটিয়া যাবার জন্য এক গলিতে ঢুকে দেখি আধা মাইল পর্যন্ত গাড়ির লাইন। জিজ্ঞেস করলাম এত গাড়ি পার্ক করে আছে কেন? উত্তর পেলাম এখানে একাধিক কোচিং সেন্টার। ছাত্রছাত্রীদের নামিয়ে ড্রাইভার অপেক্ষা করছে তাদের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। তা কতক্ষণ কোচিং হয়? দুই ঘণ্টা বা হয়তো তারও বেশি। তাহলে দাঁড়ালো কী? দুটি গাড়ি পাশাপাশি যাবার পথের এক পাশে লাইন করে গাড়ি দাঁড়ানো। অতএব, অন্যপাশের মাত্র একটি গাড়ি যাবার পথ দিয়ে আপ ডাউনের সব গাড়ি, রিক্সা, মটর সাইকেল ও পদযাত্রীদের যাবার ব্যবস্থা চলছে। জ্যাম হবে না তো কী হবে। মজার কথা হলো গলিতে অবৈধ গাড়ি পার্ক করে যারা জ্যাম সৃষ্টি করে তাদের বাড়িতেও দেখবেন জ্যামের অভিযোগ নিয়ে ঝড় বইছে। নিজের কোন দোষ নেই সব দোষ অন্যের – এমন অভিযোগ করে না তেমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
মশা, লোডশেডিং,প্রচুর গরম, ধুলাবালি, যেখানে সেখানে থুথু ফেলা এগুলোর চিত্রও একই রকম। এর বেশিরভাগের জন্য দেশের মানুষই দায়ী। মনে হতে পারে গরমের জন্য আবার মানুষ দায়ী হবে কেন। চিন্তা করে দেখুন আমরা দায়ী না হলে কে দায়ী? না না আমি প্রকৃতির কথা বলছি না। এমনকি প্রকৃতির মালিকের কথাও না। পরিবেশ বলে একটি কথা আছে। ভারসাম্য বলে আরও একটি কথা আছে। এগুলো সবই আমাদের হাতে ছিল। হয় পরিবেশ বলতে কি বলে আমরা তা বুঝি নাই কিংবা পরিবেশ রক্ষা করতে পারি নাই। সে জন্য অসহনীয় গরমের কারণও আমরা।
এবার কিছু উন্নয়নের কথা বলি। বাংলাদেশের শত্রুও এখন অস্বীকার করতে পারবে না যে বিভিন্ন দিক দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই উন্নয়নের কাজে জড়িত হয়েছে দেশের অগণিত মানুষ। তবে, এর পাশাপাশি দেশের কিছু মানুষের মন মানসিকতার যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। অসভ্য যুগের মত আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। যারা হয় স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ নয় অথবা তারা সাধারণ মানুষের ঊর্ধ্বে। এদের কর্মকাণ্ড মাঝে মাঝে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। এরা মানুষকে কাঁদাচ্ছে, মানুষকে ভোগাচ্ছে। তবুও বলবো, উন্নয়নের সার্বিক চিত্রে এরা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু এবড়োখেবড়ো দাগ মাত্র। সকলেই স্বীকার করছে গত এক যুগে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশে।
মজার ব্যাপার হল দেশ কতটা উন্নতি লাভ করেছে তা ঠিক করে অনেকেই বলতে পারে না। যেমন একজন রাজনীতিবিদকে বলতে শুনলাম বর্তমান সরকারের উন্নয়ন সাফল্যে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, রাস্তাঘাট উন্নয়নের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি কয়েকবার বি এন পি সরকারের সাথে তুলনা করে বর্তমান সরকারের সাফল্য তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। তাকে বললাম আপনি নিজেও জানেন না যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কি ভাবে বেড়েছে। বিদ্যুৎ সমস্যা শুধু বি এন পি কিংবা জাতীয় পার্টি সরকার আমলের সমস্যা না। পাকিস্তান আমলে সন্ধ্যা হতেই বিদ্যুৎ চলে যেত। আমরা তখন মহা খুশি হতাম। বলতাম, কারেন্ট নাই তো পড়ব কি করে? পড়ালেখা না করার জন্য মনে মনে দোয়া করতাম কারেন্ট যেন সহসা না আসে।
এই যে ফেব্রুয়ারি – মার্চ সময়ে দেড় মাস ঢাকায় ছিলাম। তারমধ্যে একদিনও বিদ্যুৎ যেতে দেখি নি। অথচ বর্তমান সমাজ সেই পূর্ব পাকিস্তান আমলে আটকে নেই। পূর্ব পাকিস্তান আমলে যে যায়গাতে চার থেকে ছয়জন মানুষ বসবাস করতো এখন সেই একই যায়গাতে হয়তো ত্রিশ চল্লিশ জনের বাস। তাদের বাড়িতে লিফট টেলিভিশন ফ্রিজ এয়ার কন্ডিশনার ফ্যান সেলফোন প্যাড ইত্যাদি চলছে বিদ্যুতের সাহায্যে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ ঘাটতি সনাতন কালের সমস্যা ছিল। যা সমাধান করে বর্তমান সরকার আধুনিক ও সময়োপযোগী করে তুলেছে। তাকে আরও বললাম আপনি যে দলই করেন না কেন বুঝাতে পারলেন না যে দেশ কতোটা উন্নত হয়েছে। আগে আমাদের বাপ চাচারা পাঁচ দশ মাইল পথ পায়ে হেঁটেই চলে যেত। মেয়েরাও দুই এক মাইল পথকে তেমন দূরত্ব মনে করতো না। বেশি দূরের পথ হলে পাল্কি কিংবা নৌকা বা গরুর গাড়িতে যেত। এখন হাত উঠিয়ে গ্রামের লোক রিক্সা কিংবা অটো থামায়। কাজেই উন্নয়নের মাপকাঠি এক একজনের কাছে এক এক রকম।

দেশের উন্নয়ন মাপার জন্য আমি দুটো ভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করছি।
এক: ছোট্ট একটি পরিবারের কথা বলছি। এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা মোট চারজন। স্বামী স্ত্রী এবং তাদের পুত্র কন্যা। এটাও অবাক করার বিষয়। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে নিয়ে গ্রামের কেউ সংসার করে খুশি আছে এটা আমার জন্য নতুন তথ্য। আমি আগের দিনের মানুষ। জন্ম পাকিস্তান আমলে। ১৯৭১ এর পর গ্রামে গেছি বলে মনে হয় না। তবে, আমরা ছোট বেলায় যখন গ্রামে যেতাম প্রতি ঘরে গাদাগাদা ছেলেমেয়ে দেখতাম। তাই মাত্র দুটি সন্তান নিয়ে একটি পরিবার তাও আবার গ্রামে সেটা আমাকে অবাক করেছিল বটে। যাইহোক পরিবারের পুরুষ সদস্য গ্রামে রিক্সা চালায়। আর মহিলা অন্যের বাড়িতে রান্নাবান্না সহ সবরকম দেখাশুনার কাজ করে। তাদের কন্যা ক্লাস নাইনে পড়ে এবং ছেলেটি ক্লাস এইটে। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম বিলকিসের মা, তোমার মেয়ে দেখতে সুন্দর, গায়ের রঙ দুধে আলতা, বিয়ে দিচ্ছ না কেন? উত্তরে বিলকিসের মা বলল, 'না মামা কলেজ পাশ না করাইয়া বিয়া দিমু না। অনেক প্রস্তাব আসে আমি সবাইরে ভাগাইয়া দেই। এখন ভয়ে কেউ আসে না'।
আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম– বলে কি মহিলা! মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কেউ এলে তাকে ভাগিয়ে দেয়। তাও অন্যের বাড়িতে কাজ করার মানুষ, যার স্বামী গ্রামে রিক্সা চালায়! এতোটা মানসিক উন্নতি!
দুই: এটিও গ্রামের উদাহরণ। ছবি তোলার জন্য একটা বট গাছ খুঁজছিলাম। একজন নিয়ে গেল বটগাছ দেখাতে। দূর থেকে দেখি অনেকগুলো বাচ্চা রঙিন জামা কাপড় পরে এগিয়ে আসছে। ওরা কাছে এলে দেখি সবার হাতে বই পেন্সিল ইরেজার, স্কেল, রোল করা খাতা। ওদের পায়ে জুতা স্যান্ডেল, গায়ে রঙিন জামা। কথা হলো পরশ নামের একটি ছেলের সাথে। সে বলল স্কুলে যাবার জন্য ওরা মাসে ভাতা পায়, বই পায় বিনে পয়সায়। কোন কোন স্কুলে আবার নাস্তাও খেতে দেয়। গ্রামের সবাই তাই স্কুলে যায়।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের একটি ঘটনা। আমার বড় ছেলেকে নিয়ে একদিন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তিন চার ঘণ্টার কাজ তাই ওর স্কুল থেকে ছুটি নিতে হয়েছিল সেদিন। ডাক্তার এবং বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম একটা শপিং প্লাজাতে। দোকানের সেলস গার্ল এক গাল হাসি দিয়ে প্রশ্ন করলো 'লক্ষ্মী সোনা তুমি আজ স্কুলে যাওনি? তাকে বললাম ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিল তাই আজ ওর ছুটি। আশ্চর্য, একই প্রশ্ন পর পর আরো দুজন জিজ্ঞেস করলো। চিন্তায় পড়ে গেলাম, সবাই কেন একই প্রশ্ন করছে?
তারপর চারিদিকে চেয়ে দেখি আশেপাশে আর কোনো বাচ্চা নেই। একমাত্র আমিই ছেলের হাত ধরে শপিং প্লাজাতে ঘুরছি। আসলে তখন ছিল স্কুলের সময়। কাজেই  স্কুলের বাইরে বাচ্চাদের না থাকাটাই স্বাভাবিক। এটাই কানাডার নিয়ম। চিত্রটি বাংলাদেশের সাথে মিলিয়ে দেখলাম। দেশে থাকাকালে দেখেছি দিনে দুপুরে বাচ্চারা পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াত। বিদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবার গ্রামে গিয়ে দেখি গ্রাম চলে এসেছে বিদেশের অবস্থানে। আগে বাবারা যখন জমিতে হাল চাষ করতে যেত তাদের পিছন পিছন বাচ্চারা যেত খাবারের বোঝা নিয়ে। অথবা তারাও ছিল খুদে কৃষক কিংবা বাড়িতে মায়ের কাজে সাহায্য করতো বা গরু ছাগল নিয়ে মাঠে যেত। এবার চারিদিকে চেয়ে দেখলাম স্কুলের বাচ্চাগুলো ছাড়া আর কোন বাচ্চা কোথাও নেই। যতদূর চোখ যায় কোথাও খুঁজে পেলাম না কাউকে। বলেন, দেশ কি পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না?

আগে বলেছিলাম উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে (Bangladesh has been ranked 34th in the World Economic Forum's Inclusive Development Index's (IDI) list of emerging economies, ahead of South Asian competitors India, Pakistan and Sri Lanka). IDI scores on 1-7 scale (source: WEF)
Bangladesh 3.98 / Sri Lanka 3.79 / Pakistan 3.55/ India 3.09
উন্নয়নের সাফল্য আছে তবুও দেশে রয়েছে রাজ্যের হতাশা। বলবো না ভেবেছিলাম তবুও কিছু কথা বলতেই হচ্ছে। বাংলাদেশের যত হতাশা তার বেশিরভাগ দুর্নীতিকে ঘিরে। অপর ভাগে রয়েছে সুশাসনের ব্যর্থতা। নিয়ম শৃঙ্খলাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে এক শ্রেণির সুবিধাবাদীদের আধিপত্য সরকার কিছুতেই ঠেকাতে পারছে না। অথবা প্রশাসনের উচ্চ আসনে বসে থেকে কেউ কেউ এদের মদদ দিচ্ছে বিধায় দুর্নীতি এবং সুশাসনের অভাব একই পাত্রে মিশে একাকার।
কাজেই দেশের যাবতীয় সুযোগ সুবিধার অগ্রভাগ দখল করে রেখেছে প্রতারক ঘুষখোর অসাধু চক্র। জমি নেই বাড়ি নেই সাদা কাগজের উপর মিথ্যে জমি বাড়ি দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বাস ট্রাকের লঞ্চের বহর আছে এমন পরিবহন মালিকও এখনো হয়তো সরকারী বেতনভোগী কর্মচারী। পাবলিক লাইব্রেরিতে তাক করা উঁচু উঁচু বইয়ের মত এদের ঘরে নগদ টাকার বান্ডিল থাকে। এরা আগে ঈদের ছুটিতে আমেরিকা কানাডাতে আসতো এখন যায় বাহামা কিউবার রিসোর্টে। এরা বছরে বিশ পঁচিশবার বাংলাদেশী পাসপোর্টে ভিসা লাগায়। বাপ-বেটার আলাদা হেলিকপ্টার আছে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ অফিসারেরা যেমন দেশের রাজা জমিদারদের বাড়িতে উপঢৌকন নিয়ে নিমন্ত্রণ খেতে যেত, বাংলাদেশের নব্য ধনীদের বাড়িতে এখন বিদেশী রাষ্ট্রদূত কিংবা ভ্রমণরত বিদেশী এম পি, মন্ত্রীরা নিমন্ত্রণ খায়। বাংলাদেশের নদী, মাটি, আকাশ, বাতাস সব কিছুকেই এরা লুট করছে। ধর্ম চর্চার নামে যা-ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। লাজ লজ্জা শব্দগুলো অনুচ্চারিত থাকে এদের পরিবারে। আইন শৃঙ্খলার নথিপত্রে পানি ঢেলে পরিষ্কার করে দিয়েছে। ময়না পাখীর মত প্রশাসনের লোকবল খাঁচায় ভরে আদার খাওয়াচ্ছে। অন্যায়কে দীর্ঘায়িত ও প্রক্রিয়াজাত করণে এদের রয়েছে কৌশল, লোকবল ও হাতিয়ার। এরা দাঁড়ালে দেশ দাঁড়ায়। এরা বসলে দেশ বসে। এরা সমাজের মাথা। অথবা এরাই এখন সমাজ। এদের বাড়ির ছোট শিশুটিও বলে 'তুমি জান আমি কে'?
ধরুন একটি কাল্পনিক হিসাব কষে বললাম দেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ অসৎ। তাহলে দাঁড়ালো কি? মাত্র দশ ভাগ মানুষের হাতে চলছে অগ্রগতি বা উন্নয়নের সঠিক কাজ। তাহলে বলুন, সবাই যদি ঠিক মত আচরণ করতো তবে দেশটা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? তবুও সৎ অসৎ লোকের সম্মিলিত কাজের নমুনা নিয়েই আমরা খুশিতে উল্লাস করছি। ভুলে যাচ্ছি কতটুকু অপ্রাপ্তি আমাদের।
যাইহোক, নব্বই ভাগ মানুষকে সাথে নিয়ে অথবা ক্ষেত্র বিশেষে এদের পাশ কাটিয়ে সরকার বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে যাতে উন্নয়নের গতিতে একটা জোয়ার তুলে দিতে পারে। তবে, শস্যের ভুতের মত কিছু কিছু মন্ত্রী এমপি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের পায়ের চাপেও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের বিরাট অংশ। যার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে হয়েছে 'শেখ হাসিনাকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সব নেতাকে কেনা যায়' (প্রথম আলো, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪)। একই কথা বলেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। তিনি লিখেছেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী সেনা গোয়েন্দাদের দল একদিন আমার সঙ্গে বৈঠক করে। পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে তারা আমাকে জানায়, 'একমাত্র শেখ হাসিনাকে ছাড়া সব রাজনীতিবিদকেই কেনা যায়' (BANGLA INSIDER, OCT 05, 2017)।
আর একটু খুলে বললে হয়তো ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝা যাবে। বাংলাদেশে অনেক ড্রাইভার আছে যারা লাইসেন্স বিহীন ট্রেনিং বিহীন কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে ট্রাক বাস চালায়। দেশে অনেক ধনী লোক আছে যারা আয়কর প্রদানে উদাসীন। অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা ঋণের টাকা পরিশোধ করে না। দেশের বড় বড় প্রজেক্ট, অর্থবরাদ্দ, উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিদের উল্লেখযোগ্য অংশ অনুরূপ এটা বিহীন, ওটা বিহীন, তলা বিহীন হয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। না হলে উন্নয়নের এই যুগেও কেন মানবিক স্খলন দেখতে হচ্ছে। আলী বাবা চল্লিশ চোরের কাহিনী আমরা পড়েছি। সেই আলি বাবা চল্লিশ চোরদের তো এখন মহা জোট। জোট বেঁধেই ওরা করছে লুটপাট। এখনকার চোরদের বলতে হয় না, 'খুল যা ছিম ছিম'। এখন ব্যাঙ্কের ভল্ট এদের জন্য খোলাই থাকে। চোর তো আর চল্লিশ জন না, ওরা জোট বেঁধেই আসে। কাজেই ভল্ট বন্ধ করার সময় কোথায়?
একবার এক দাওয়াতে বসে পাঁচজন লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম এতো অনিয়ম এবং দুর্নীতি কারা করছে? সবাই আঙ্গুল তুলল অদৃশ্য জনগোষ্ঠীর দিকে। আমি বললাম আচ্ছা বলেন তো গতকাল সকালে ঘর থেকে বের হবার পর রাতে ঘরে ফিরে আসা পর্যন্ত কে কে কোনো অন্যায় কাজে অংশগ্রহণ করেন নি, অন্যায় কাজে সাহায্য করেন নি, অন্যায় কাজে উৎসাহ দেননি, অন্যায়কে উদ্বুদ্ধ করেননি। মনে হল ঘরটির মধ্যে এটম বোম এসে আঘাত করলো। তাই মৃত বিবেকের কাছ থেকে কোন উত্তর পাইনি। শুধু একটাই মন্তব্য করলো একজন, দেশে থাকলে আপনিও অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে যেতেন।
হয়তো হতাম, কিন্তু যে কাজে গত ত্রিশ বছর আমার সরাসরি অংশগ্রহণ নেই সে কাজ করতে গিয়ে কী করতাম না করতাম তা কি করে বলি। আবার কোন ভরসায় বলি আমি দশ পার্সেন্টের দলে। আমিও কি তাদের মত নয় যারা দেশের দশ ভাগ সৎ নাগরিকের জন্য যেমন গর্ব অনুভব করে তেমনি নব্বই ভাগ দোষীদের জন্য লজ্জিত হয় না। মানবিক চারিত্র খোয়ানো লোকগুলোই আমাদেরই আত্মীয় স্বজন। এই লোকগুলো নিজেদের মধ্যে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। একের সাথে অন্যজন আত্মীয়তা গড়ে তুলছে। একজনের বাড়িতে অন্যজন দাওয়াত খাচ্ছে। এদের রয়েছে গভীর বন্ধুত্ব। যে বন্ধুত্ব ও বন্ধনের উৎস চৌর্যবৃত্তি। যে যত বড় দুর্নীতিবাজ তাকে ততো বেশি দাম দেই আমরা। বড় দুর্নীতিবাজ বলেই তার গাড়িটা বড়, বাড়িটাও বড়। তার ভিজিটিং কার্ডটাও দুই পৃষ্ঠার হয়। আমরাও হাসি মুখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি, উনি আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কাজেই লোকটা হয়তো ঠিকই বলেছে, দেশে থাকলে আমি কি করতাম না করতাম সে প্রশ্ন তোলাই যায়।
আশার কথা হলো দেশের সব মানুষই চিন্তা করছে কি করে নব্বই ভাগকে দশ ভাগের মত সাধু সৎ বানানো যায়। কি করে মানুষের মধ্যে আবারো স্বাভাবিক বোধশক্তি ফিরিয়ে আনা যায়। এই ভাবনা রয়েছে দেশের শতভাগ লোকের। ন্যায় অন্যায়ের সাথে জড়িত সকলেই চায় দেশে যেন সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে।
যে সম্পদ হালাল ভাবে উপার্জন করি নাই সে সম্পদের মালিক আমি নই, এই অনুভূতি জাগিয়ে তুলে দেশটাকে কি বাঁচানো যায় না? হা, তাও হয়তো সম্ভব। দেশের বেশিরভাগ মানুষের আয় রোজগার নষ্ট পথ দিয়ে আসছে ঠিকই কিন্তু সে পথ এখনো পচে যায়নি। হাতির ঝিলের পানির মত স্বচ্ছ হবার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। অসম্ভব বলে কিছু নেই। তবে এ কাজে কাউকে না কাউকে উঁচু গলায় আওয়াজ তুলতে হবে।
যা যা করতে হয়, যা যা বলতে হয় তাই বলুন। এই ঘোষণা যিনি বলিষ্ঠ ভাবে দিতে পারবেন এবং কঠোর ও অনমনীয় হয়ে দেশ পরিচালনা করতে পারবেন, দেশের মানুষের উচিৎ হবে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ানো। তিনিই হয়তো পচে যাবার আগে মানুষের উচ্চ বিলাস ও একপার্শ্বিক ভোগ দখল রুখে সুসম অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারেন। আশা করবো দেশের মানুষ সঠিক নেতৃত্ব বাছাই করতে ভুল করবে না। আর যদি ভুল হয়, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অচিরেই নব্বই ভাগের হাতে চলে যাবে দেশ। সত্যি সত্যি যদি তাই হয়, তবে দেশের উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য আগামীতে হয়তো দরকার হতে পারে একশো জন প্রধানমন্ত্রী, এক হাজার মন্ত্রী, দশ হাজার সংসদ সদস্য।
কেন বলছি একশো, এক হাজার, দশ হাজারের কথা? বলছি যদি কোন একক ব্যক্তির দ্বারা দেশে সমুদয় জঞ্জাল মেটানো সম্ভব না হয় তাহলে একাধিক ব্যক্তির দ্বারা দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার ব্যবস্থায় আনুপাতিক হারে ওই সমস্ত পদগুলোতেও দশ পার্সেন্ট লোক বসে থাকবে। তাঁরাই হয়তো উন্নয়নের গতি কিছুটা হলেও ধরে রাখতে পারবেন। বেশি বেশি সৎ ও যোগ্য লোকের হাতে উন্নয়নের দায়িত্ব তুলে দেওয়া মানে বেশি বেশি উন্নয়ন। ততদিনে বিলকিস আর পরশেরাও প্রস্তুত হয়ে চলে আসবে। বৈষয়িক সুখ নয়, চিন্তা ও মননে উন্নয়নের প্রস্তুতি নিয়ে ওরা আসছে। হয়তো এমন দিন আবারো ফিরে আসবে যেদিন ব্যাঙ্কের সেবার অঙ্গিকার করা চিঠি আসবে সাধারণ মানুষের ঘরে। নিরসন হবে যানজট। পথে ঘাটে থুথু ফেলবে না কেউ। অসহ্য গরমও থাকবে না বাংলাদেশে।