প্রবাসে দেশের রাজনীতি: যা হেরিলাম যা দেখিলাম

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 5 May 2018, 06:26 AM
Updated : 5 May 2018, 06:26 AM

প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে লেখার অনেক কিছু আছে এখন। এই যে তিনি সিডনি এলেন দেখলেন জয় করলেন তার ভেতর যে বার্তা সেটি আমাদের জন্য বড় আনন্দের। একসময় অবহেলা আর তুচ্ছতার শিকার দেশ এখন অনেক বড় আসনে।  এই উচ্চতায় নিয়ে যাবার কান্ডারী শেখ হাসিনা। এবার তিনি এসেছিলেন পদক নিতে। বিশ্বজোড়া নারী নেতৃত্বের দিশারী তিনি । এ কথা আমার নয়। এটা এখন বিশ্বস্বীকৃত। সবই ঠিক আছে। তাঁকে ঘিরে যে আনন্দ উন্মাদনা ও ভালোবাসা সেটা ও কম ছিলোনা। তাঁর দল যারা করেন তারা ফেটে পড়েছিলেন আনন্দে আবেগে। আমরাও দেখেছি, দেখে ভালোলাগায় মন ভরে গেছে। তিনি যখন মিলনায়তনে প্রবেশ করেছিলেন আমি দেখেছি বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল পরিবেশ। আমার মত ষাট ছুঁই ছুঁই মানুষ ও স্লোগানে সামিল হয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে দ্বিধা করিনি।

একথা লিখে দিতে পারি যেসব মানুষরা সেদিন টিকেট পেয়ে পাশ পেয়ে অনুষ্ঠানে যেতে পেরেছিলেন তাদের বাইরেও এক বিশাল জনগোষ্ঠী ছিলো এবং আছেন যারা তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। বরং বলবো তারাই তাঁর মূল শক্তি। আজকাল পরিবেশটা এমন সবাই কোন না কোন ভাবে রাজনীতি এড়িবে চলতে চায়। দেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা যত পপুলার হয়েছেন দল ততই নানাভাবে সংকটে পরেছে। এবং এজন্যে দায়ী কতিপয় নেতাদের কর্মকান্ড। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ ঘুষ রাহাজানি জোর জবরদস্তিহীন সমাজ চাইলেও মেলেনি। বরং এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে এরা মানুষ ক্রমেই উন্নয়নে অভ্যস্ত হয়ে রাজনীতি বিমুখ হয়ে উঠছে। সেই  জায়গায় নেত্রী একা লড়াই করছেন এবং সত্য জানা তাঁর জন্য জরুরী।

সিডনি আর দশটা বাঙালি  অধ্যুষিত  বিদেশী শহরের মত নানা বিষয়ে কলহ আনন্দ আর জীবনযাপনে ব্যস্ত। হিসেব করে দেখেছি বিগত একদশকে আওয়ামী লীগের যতগুলো শাখা গড়ে উঠেছে আর কোন দলের তা নাই। বিএনপি ভেতরে ভেতরে শক্তিশালী হলেও তাদের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল। শো ডাইনেও পিছিয়ে। অবশ্য এজন্যে তাদের ভ্রান্ত নেতৃত্বও দায়ী। গঠনমূলক যেকোন কিছুর পরিবর্তে তারা নামে দেশবিরোধী কর্মকান্ডে। রেগে যাবার পর থেকে খালেদা জিয়া যেমন হটতে হটতে জেলে তেমনি দলও আজ কোনঠাসা। তাদের প্রতিবাদ করার দরকার থাকলে তারা তা অন্যভাবে করতে পারতো। বা এমন প্রতিবাদ আসলে এখন আর দরকারও নাই। কারণ এতে বিদেশে দেশের অপমান আর ভাবমূর্তি বিনষ্ট ছাড়া আর কিছু হয়না। তারা যেভাবে মারমুখি  তাদের স্লোগান এবং আচরণ এতটাই নিম্মমানের যে রুচিবান মানুষ ভড়কে যেতে বাধ্য। যার প্রমাণ আমরা বিলেতে দেখেছি। আওয়ামী লীগের লোক্যাল পলিটিকস  আর এখানকার নেতৃত্ব অবশ্য তাদের এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা থাকতে লীগের আর কোন দুশমনের দরকার পড়েনা। শ্রুত যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও কাউকে কাউকে দলের নামে দোকান খোলার জন্য তিরষ্কার করতে ছাড়েননি।

যে কথা বলছিলাম, আমরা বড় আশা নিয়ে গিয়েছিলাম ্ প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা সভায়। আশা পূরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী । তাঁর মনে রাখার অসীম ইচ্ছা আর শক্তি আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। হতাশ করেছেন যথারীতি এখানকার নেতারা। তিন বা ততোধিক দলে বিভক্ত কেউই নিজেদের এজেন্ডার বাইরে পা রাখতে পারেননি। তাদের কেউ সভাপতিত্ব করার সুযোগও পায়নি। অনেকটা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের মত তারা এই দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের সুযোগ্য সভাপতি শেখ শামীমকে দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমি মনে করি এতে তাদের সম্মান বেঁচেছে। এবং আমরা অন্তত একটি বিবাদমুক্ত সন্ধ্যা পেয়েছি। কিন্তু ছাড় দেয়নি কেউ কাউকে। যেটা পরেরদিন দেখা গেছে। এটা তাদের কোন্দল । এতে সিডনি বা অষ্ট্রেলীয়া প্রবাসী বাঙালিদের কিছু যায় আসেনা।

আমরা হতাশ হয়েছি দুটো কারণে। বক্তাদের কেউ কেউ তাক লাগানো ভাষণের ফাঁকে নিজেদের কথা জাহির করলেও এদেশে চলমান রাজনৈতিক সমস্যা ঘরে ঘরে স্বাধীনতা বিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মনোভাব দমনের কথা বলেননি। বলেননি শেখ হাসিনা কেন এদের চোখের বালি। এবং কিভাবে এ থেকে বেরিয়ে আসা যায়। আর একটা কথা, আমরা জানি সিডনিতে বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন। শুধু আছেন নয় তাদের কর্মকান্ডও আছে। এমন মুক্তিযোদ্ধা আছেন যার সহোদরেরা প্রাণ দিয়েছেন যুদ্ধ করতে গিয়ে। এমন একজনের নাম জানি যিনি তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধুর বুকে আশ্রয় পেয়েছিলেন। আছেন নানা সেক্টরে কাজ করা মুক্তিযোদ্ধারা।  কই কেউতো তাদের কিছু বলতে দেয়নি। শুধু বলতে দেয়া না নয়, তাদের এমন কোন সুযোগও দেয়নি যাতে তারা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে সালাম জানিয়ে ভালোবাসা জানিয়ে নিজেদের মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন। এই কি তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের দায়? এরা যুদ্ধে না গেলে যুদ্ধ না করলে এ দেশ স্বাধীন হতো? এই পতাকা এই সম্মান এই পাসপোর্ট এই আনন্দ এর যারা মূলশক্তি সেই মুক্তিযোদ্ধারাই হলেন অবহেলিত। অথচ আওয়ামী লীগই একমাত্র বড় দল যারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি সে চেতনাকে লালন করে। আজ অবদি শেখ হাসিনাকে অপছন্দ করার কারণও ঐ একটাই। তিনি যে ইতিহাসকে শুদ্ধ করেছেন তিনি যে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করে দেশকে কলংকমুক্ত করেছেন সেটা যারা নিতে পারেনা তারাই তাঁর বিরোধিতা করে। আর সে জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই পাত্তা পেলেন না। নিজের পাতে ঝোলটানা নেতারা সেটা মাথায়ও রাখেননি। মাথায় ছিলোনা যুদ্ধ-শিশুদের বিষয়টা। আমার জানামতে এদেশে বেশকিছু যুদ্ধশিশু ও শহীদ পরিবারের সন্তান আছেন। এটা তাদের প্রাপ্য ছিলো। তারা যদি জাতির জনকের কন্যার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে না পারে কিসের রাজনীতি আর কিসের দল?  আওয়ামী লীগই যদি তা করতে না পারে তো তারা কার কাছে যাবে?

বলাবাহুল্য পেশাজীবী লেখক শিল্পীদের কাউকে ডাকেননি তারা। নাগরিক সংবর্ধনা কথাটার মানেই বদলে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে জানলাম নাগরিক সভার মানে তারা নাগরিকদের ডেকে নিয়ে নিজেরা কথা বলবেন বা তাদের দাপট দেখাবেন। মুশকিল হচ্ছে উপচে পড়া মিলনায়তন বা বাইরে ফিরে যাওয়া ও থেকে যাওয়া মানুষরা গিয়েছিল শুধু শেখ হাসিনার টানে। তাদের জানা আছে তিনি না থাকলে দেশে কি হতে পারে। আজ আমরা যখন গণতন্ত্র আর উন্নয়নকে সমান্তরাল করে দেখতে চাইছি বা একটির সাথে আরেকটি মিলিয়ে নিজেদের আধুনিক করতে চাইছে তখন এমন আয়োজন প্রশ্নবোধক বৈকি। জানি যারা আয়োজক তাদের যুক্তি আছে। সে যুক্তি যদি আমাদের বোঝাতে পারে তো ভালো। আর না পারলে এটাই ধরে নিতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতি দেশে যা বাইরেও তা।

অনেকে বলেন দেশের বাইরে দেশের রাজনীতির দরকার নাই। একথার সাথে পরিপূর্ণ একমত হতে পারিনা। একথা লেখার জোর জবরদস্তি ছিলো বলে দেশের সবচেয়ে চালু দৈনিকে কলাম লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ এটাও ভাবতে হচ্ছে যে-রাজনীতি মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধশিশু কিংবা দেশ মুক্ত করার সংগ্রামীদের বা শহীদদের স্মরণ করে না তার প্রয়োজন আদৌ কতটা? তবু বলি যতদিন দেশের বাইরে দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র, যতদিন স্বাধীনতা বিরোধীরা সক্রিয়,  যতদিন পাকি চক্রান্তের সহযোগীরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সক্রিয়, ততদিন এর দরকারা  আছে। সে দরকারটায় এখন পরিবর্তনের প্রয়োজন। অন্যথায় দেশের মত দেশের বাইরেও সাধারণ ও মেধাবী জনগণের সমর্থন ক্রমেই ফিকে হয়ে আসবে। মানুষ এত বোকা না যে কাউকে নেতা বানানো বা কারো বিরুদ্ধে কাউকে মদদ দেবার জন্য এসব বিষয়ে মাথা গলাবে। তাদের সে সন্ধ্যায় যাবার একমাত্র কারণ ছিলেন দেশকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়া নেত্রী শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানানো।

একটা ব্যাপার জানতে চেয়েই শেষ করবো। এই যে এত দল উপদল এবং এদের পেছনে দেশের নেতারা বা লবিং সেটা কি সবার অজানা? এবারতো কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউও নাকি চোখের পানি নিয়ে বিদায় নিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর ও শক্ত ভূমিকার কারণে তাদের কথা কাজে লাগেনি। এই যখন বাস্তবতা তখন কেন্দ্রীয় কমিটি বা দলের মূল নেতাদের কাজ কি এদের সীমানা ও কলহ সীমিত করা নয়? মেঘে মেঘে বেলা বাড়ছে। বহু কারণে দেশের ভেতর একধরণের অশান্তি বিরাজমান। কোটা আন্দোলনের নামে 'আমি রাজাকার' লিখে রাস্তায় নেমে আসা তরুণ প্রমাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধ এখনো কোথাও ঝুঁকির মুখে। আর প্রশান্তপাড়ে সেই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সন্তানরাই হলেন অবহেলিত। আশা একটাই এখন এখানে মর্মর মূর্তিতে জেগে আছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তাঁকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর বড় কন্যা শেখ হাসিনা যে শক্তির আভাস রেখে গেছেন হয়তো সেখানেই ঘুরে দাঁড়াবে আগামী দিনের কেউ। কারণ এটাই আমাদের ইতিহাস ও অতীতের অভিজ্ঞান।

শেখ হাসিনার আগমনধন্য সিডনি সেদিনের আশায় দিন গুনছে।