সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন: কয়েকটি পর্যবেক্ষণ

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 2 May 2018, 12:41 PM
Updated : 2 May 2018, 12:41 PM


বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দাবীদার দেশগুলোতে পুঁজিবাদ এখনো পাশ্চাত্যের মত বিকশিত হতে পারেনি যার ফলশ্রুতি হল বেসরকারী খাতের আশানুরূপ উন্নয়ন না হওয়া। এর পাশাপাশি জনগণের বড় একটি অংশের মাঝে এখনো ঔপনিবেশিক মানসিকতা থাকবার ফলে সরকারী চাকুরী এদেশে এখনো সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
১০-১৫ বছর আগের তুলনায় বেসরকারী খাতে ভালো বেতনে চাকুরীর সুযোগ অনেক বৃদ্ধি পেলেও সাবেকি ধ্যান ধারণা, সারা জীবন চাকুরী থাকবে কিনা এ অনিশ্চয়তা বোধ এবং আমজনতার উপর ক্ষমতা চর্চা করতে পারবার মানসিকতা ইত্যাদি নানা কারণে ছাত্র/ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারী চাকরিতে প্রবেশ করে আমলা হতে পারা এখনো সাফল্যের প্রধান মাপকাঠি।


বৃটিশ আমলাতন্ত্রের উত্তরাধিকার হল বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র। মাত্র কয়েক হাজার বৃটিশ ভারত উপমহাদেশে প্রায় দুইশ বছর তাদের ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখতে পেরেছিল তাদের সৃষ্ট বেসামরিক এবং সামরিক আমলাতন্ত্রের সহায়তায়।
ভারতবর্ষের কোটি কোটি জনগোষ্ঠী যেখানে নিরক্ষর এবং বৃটিশ শাসনে নিষ্পেষিত হয়ে চরম দরিদ্র অবস্থায় জীবন যাপন করতেন এমন একটি সমাজ থেকে আইসিএস (Indian Civil Service) পরীক্ষার মাধ্যমে হাতে গোণা কয়েক জনকে বেছে নেয়া হত শাসকগোষ্ঠীর কার্যকলাপে সহায়তা করবার জন্য।
ভারতীয় জনগোষ্ঠীর শোষণকারী বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর উচ্ছিষ্ট ভোগী এ শ্রেণীটি নিজেদেরকে এলিট মনে করত এবং শাসকগোষ্ঠীর অংশ হিসাবে ভেবে এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভুগত। বৃটিশ শাসকরাও এদেরকে তুলনামূলক বিচারে নানাবিধ সুবিধা দিয়ে এরা যে বাকি জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা, এ রকম ধারণা তাদের মনে বদ্ধমূল করেছিল।
বৃটিশ কর্তৃক জিইয়ে রাখা সামন্ত সংস্কৃতির চর্চাকারী এ আমলা গোষ্ঠীটির সম্পূর্ণ দায়বদ্ধতা এবং আনুগত্য ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুর প্রতি। "আদর" করে বৃটিশ প্রভুরা এদের নাম দিয়েছিল সিভিল সারভেন্ট বা "জনগণের ভৃত্য;" কিন্তু, বাস্তবে এরা সবাই পরিণত হয়েছিল জনগণের প্রভুতে।

পাকিস্তান আমলে আইসিএস পরীক্ষার নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় সিএসপি (Civil Service of Pakistan)। নাম পরিবর্তন হলেও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সামন্ত-ঔপনিবেশিক মানসিকতার চর্চা পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোতেও জেঁকে বসে।
সামরিক-বেসামরিক পাকিস্তানি শাসকরা ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই আচরণ করতে থাকেন এবং আমলাদের ক্ষেত্রে তাদের প্রবর্তিত নিয়মকানুন, সুবিধাসমূহ অক্ষুণ্ণ রাখেন। সিএসপি কর্মকর্তারা নিজেদেরকে এক একজন ছোট সামন্ত প্রভুর মত জনগণের প্রভু মনে করতেন।
আইসিএস বা সিএসপি কর্মকর্তারা তাদের চাকুরীর দায়বদ্ধতার জন্যই জনগণের সেবক হওয়া তো দূরের কথা জনগণকে আস্থায় রেখে বা তাদের কল্যাণের বিষয়টাকে মাথায় রেখে কোন সিদ্ধান্ত নেন নাই। বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমলে তাদের সমস্ত দায়বদ্ধতাই ছিল স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর প্রতি। অপরদিকে, সাধারণ জনগণের কাছেও উচ্চপদস্থ আমলারা  ছিলেন শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে।
পাকিস্তান আমলে অবস্থার কোন পরিবর্তনতো হয়ই নাই বরং সামরিক-বেসামরিক উভয় শাসকগোষ্ঠীই জনগণের উপর তাদের শোষণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের উপর তাদের শাসন এ আমলাতন্ত্রের সহায়তায় বজায় রেখেছিল। পাকিস্তান আমলে "অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক" শাসনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অনেকের কাছেই শাসক গোষ্ঠীর সেবা দাস এ আমলারা গণশত্রু হিসাবেই প্রতিভাত হয়েছিল।

১৯৭১ সালে গণমানুষ যখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার জন্য জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন তাদের মাঝে এ ধারণা জন্মেছিল যে, নিজেদের দেশে বৃটিশ-পাকিস্তানের উত্তরাধিকার ছিন্ন করে জনগণের সেবক না হলেও অন্ততঃ গণমুখী বা Pro-people আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে দেশ স্বাধীন হবার পর জনগণ অবাক বিস্ময়ে সেই সামন্ত মানসিকতার, ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের বাংলা সংস্করণ দেখতে পেল।
স্বাধীন বাংলাদেশে বেসামরিক-সামরিক উভয় সরকারই আমলাদের উপর অত্যধিক নির্ভরতার কারণে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমলাতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করবার চিন্তা বা সাহস কোনটাই করতে পারে নাই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত নির্মম বাস্তবতা হল শুধুমাত্র অবৈধ সামরিক শাসকবৃন্দই নয়, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ব্যর্থ হবার কারণে প্রতিটি ক্ষমতাসীন দলই তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখবার জন্য জনগণের উপর নির্ভর না করে বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্রের উপর অতিমাত্রায় নির্ভর করেছে। এর ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
এই অতিমাত্রায় নির্ভরতার ফল হল পাকিস্তানী বামপন্থী তাত্ত্বিক হামজা আলাভীর ভাষায় অতিবর্ধিত (Overdeveloped) রাষ্ট্রের জন্ম নেয়া, যেখানে সরকারের চেয়ে রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়। অন্য কথায়, সরকার রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ না করে রাষ্ট্র সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এ ধরণের ব্যবস্থায় আমলারা অতিরিক্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠবার ফলে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার সিংহভাগই ব্যয় হয় বেসামরিক এবং সামরিক আমলাদের পিছনে।

বাংলাদেশের মত একটি তুলনামূলক পশ্চাতপদ দেশে যেখানে পাশ্চাত্যের জীবন মানের মাপকাঠিতে দেশের অধিকাংশ মানুষই অতি দরিদ্র, সেখানে আমলাদের পিছনে রাষ্ট্রীয় ব্যয় চোখে পড়ার মত। যেকোন জেলা শহরে উচ্চ পদস্থ আমলাদের গাড়ী, বাংলো এবং তাঁদের সেবা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা দেখলে সেই পুরানো আমলের জমিদারী ব্যবস্থার কথাই মনে পড়ে।
এছাড়া রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে বিদেশ ভ্রমণসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি পদের অপব্যবহার করে অনেক আমলার বিরুদ্ধে বেআইনি আর্থিক এবং অন্যান্য সুবিধা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উচ্চপদস্থ আমলাই বৈধ আয়ের সাথে ব্যয়ের সঙ্গতিপূর্ণ জীবন যাপন করেন না।
বস্তুত, বাংলাদেশে আমলাদের পিছনে যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করা হয় এবং যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা তারা পেয়ে থাকেন–সে পরিমাণ ব্যয় এবং সুবিধা তারা পাশ্চাত্যের তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক যে সমস্ত দেশে প্রায়ই ঘুরতে যান–সে সমস্ত দেশের আমলারা ভোগ করতে পারেন না। পাশাপাশি, আইনকে পাশ কাটিয়ে টাকা উপার্জনের সুযোগও সে সমস্ত দেশের আমলাদের বাংলাদেশের তুলনায় অনেক সীমিত।


বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র/ছাত্রীদের একটা বড় অংশই আসেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে। তাঁদের অনেকেই শাসক শ্রেণীর পর্যায়ে নিজেদের উত্তীর্ণ করা বা ধনীক শ্রেণির অন্তর্গত হবার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ধনীক শ্রেণির  পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করতে পারাটা কঠিন হলেও বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হবার স্বপ্ন তাদের একটা বড় অংশের মাঝেই দানা বাঁধে।
আর বর্তমানে প্রচলিত ৫৬ শতাংশ কোটাকে দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্র/ছাত্রীরা তাদের এ স্বপ্ন পূরণের প্রধান অন্তরায় হিসাবে ভেবে আসছেন। দীর্ঘদিন ধরে একটা অসন্তোষ ধুমায়িত হচ্ছিল; যদিও স্বপ্ন পূরণের মূল অন্তরায় খুব অল্প সংখ্যক পদের জন্য বিপুল পরিমাণ পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণ। উদাহারণ স্বরূপ বলা যায় ৩৬তম বিসিএস এর প্রার্থী সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ৩২৬ জন। চূড়ান্ত ফলাফলে ২ হাজার ৩২৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।
স্বপ্ন পূরণ না হবার এ অসন্তোষ থেকে ছাত্র/ছাত্রীরা ধরে নিল এ কোটা ব্যবস্থা বাতিল বা সংস্কার হলেই হয়ত তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুলে যাবে। অনেকে কোটা ব্যবস্থা একেবারে তুলে দেবার পক্ষপাতি হলেও অনেকটা চক্ষু লজ্জার খাতিরেই যেন বলা হল কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। যদিও এ ১০ শতাংশের বন্টন কিভাবে হবে আন্দোলনকারীরা এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন রূপরেখা দিতে পারে নাই।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আন্দোলনকারীদের, যাদের পিছনে অধিকাংশ ছাত্র/ছাত্রীর সমর্থন রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, তাঁদের ক্ষোভটা গিয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/দৌহিত্রদের জন্য বরাদ্দ ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, আদিবাসী (সংবিধানে যাদের খুব অদ্ভুত কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলা হয়েছে) পাঁচ শতাংশ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ এক শতাংশ কোটার উপর। অর্থাৎ, এ আন্দোলনের লক্ষ্য হল উপরে উল্লেখিতরা যাতে কোন বিশেষ সুবিধা পেয়ে বিসিএস ক্যাডার হতে না পারেন। এ ব্যবস্থার নিরসনকে তারা বৈষম্যের অবসান বলতে চাচ্ছেন।
গুণগতভাবে দেখলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে যত আন্দোলন ছাত্ররা গড়ে তুলেছে তার সাথে এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আন্দোলন ছিল বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা দেশের স্বার্থে। যে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী–মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে যারা লুম্পেন বা সুবিধাবাদী শ্রেণি–সেই শ্রেণি থেকে উঠে আসা ছাত্র/ছাত্রীরাই কিন্তু নিজেদের কথা ভুলে গিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।
১৯৪৭ সাল থেকে ধরলে, এ দেশের প্রতিটি সফল আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীরা যে আন্দোলনই গড়ে তুলেছে তার কোনটাই ব্যর্থ হয় নাই।
তবে, অতীতের সব আন্দোলনগুলোর মাঝে নিবর্তনমূলক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, নিয়ম-কানুন এসবের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের দাঁড়াবার একটা বিষয় ছিল। যে যে রাজনৈতিক মতবাদেই বিশ্বাস করুক না কেন, এ দাঁড়াবার প্রশ্নে প্রায় সব ছাত্র/ছাত্রী অনেকটাই এক কাতারে ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে,অতীতে কখনোই সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন সেখানে জনপ্রিয় হতে পারে নাই। এটি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিক বৈশিষ্ট্য, যা এখন আর বজায় নেই। মূলগতভাবে, অতীতের সমস্ত আন্দোলন ছিল নিপীড়নমূলক আইন, প্রথা, বৈষম্য ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী এবং সে বিবেচনায় প্রগতিশীল।
কিন্তু অতীতের সবগুলো আন্দোলন যেখানে ছিল জাতি এবং দেশকে কিছু দেবার, সেখানে এ কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল নিজেরা কিছু পাবার, এবং তাও আবার কাউকে কাউকে বঞ্চিত করে। তাই, এ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল শুধু কোটা সংস্কারের দাবীতে, আমলাতন্ত্রের সংস্কারের প্রশ্ন সেখানে আসে নাই।
উপনিবেশিকতার সূত্রে প্রাপ্ত আমলাতন্ত্রকে কিভাবে গণমুখী করে আমলাদেরকে জনগনের সেবকে পরিণত করা যায় এ ধরনের কোন ভাবনা ছাত্রদের মাঝে গড়ে ওঠেনি। বিপুল সংখ্যক ছাত্র সমাজ একবারও প্রশ্ন তোলেনি গার্মেন্টস শ্রমিক, কৃষকসহ অন্যান্য শ্রমজীবি মানুষের রক্ত পানি করা উপার্জিত বৈদেশিক অর্থ সরকার কেন অসম বন্টনের মাধ্যমে আমলাদের বিলাস ব্যসন বা তাদের সামন্ততান্ত্রিক জীবন-যাপনের পিছনে ব্যয় করবে।
এ অসম বন্টনের মাঝে আন্দোলনকারীরা কোন বৈষম্য খুঁজে পাচ্ছেন না, কারণ তারা নিজেরাই স্বপ্ন দেখেন আমলাতন্ত্রের অংশ হয়ে একজন খুদে "সামন্ত প্রভু" হবার। তাই তারা চান না আমলাতন্ত্রের বর্তমান কাঠামোর কোন পরিবর্তন ঘটুক। তাদের একটাই লক্ষ্য আর তাহলো কোন না কোনভাবে এ কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হতে পারা। সে অর্থে এ আন্দোলনের চরিত্র হল প্রতিক্রিয়াশীল।

যেহেতু এ আন্দোলনের চরিত্র প্রতিক্রিয়াশীল, তাই তার মাঝে সুবিধাবাদী প্রবণতাও ছিল প্রবল। অতীতের যেকোন আন্দোলনের মূল সুরটা যেখানে ছিল সরকার বিরোধী, সেখানে আন্দোলনকারীরা শুরু থেকেই দেখাতে চাচ্ছিলেন তারা কতটা সরকার সমর্থক। এর বহিঃপ্রকাশ হিসাবে তারা অযাচিত ভাবেই বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে মিছিল, সমাবেশে এসেছেন। এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়,আজ যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকত তারা জিয়াউর রহমানের ছবি নিয়ে মাঠে নামতেন আর জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকলে এরশাদের ছবি।

৪ 
১৯৭২ সাল থেকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনকে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর তুলনায় একটা "অতিরিক্ত দায়িত্ব" পালন করতে হয় আর তাহলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর "সহায়ক," পেটোয়া বাহিনী হিসাবে ভূমিকা পালন। এরই ধারাবাহিকতায় কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে তার "ঐতিহাসিক" ভূমিকা পালন করেছে।
ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যেভাবে অবস্থান নিয়েছিল, পাকিস্তান আমলে আমরা এনএসএফকে সে অবস্থানে দেখেছি, বিএনপি আমলে ছাত্রদল আর জাতীয় পার্টির আমলে ছাত্রসমাজ।
আমরা যখন গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার কথা বলি, তখন আমাদেরকে এ কথাটাও মাথায় রাখতে হবে যে, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যক্তি, গোত্র বা দলের পক্ষে পুলিশের সহয়ায়ক শক্তি হিসাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা পালন করবার কোন অবকাশ নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শুধুমাত্র পোশাকধারী বাহিনীরই বৈধ পন্থায় ভূমিকা পালন করবার সুযোগ রয়েছে।
দেশ স্বাধীন হবার পর বিভিন্ন সময়ে পুলিশের সহযোগী পেটোয়া বাহিনী হিসাবে সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠন সমূহের যে ভূমিকা পালন করতে আমরা দেখি, এটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি যে এখনো গড়ে ওঠেনি তার প্রতি দিক নির্দেশ করে।


দীর্ঘ লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা দ্রুত উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বিপরীতে যাওয়া কোন শুভ পদক্ষেপ হবে না, বিশেষত যখন দেখতে পেলেন তার দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ থেকে কেউ কেউ পদত্যাগ করে আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন।
যদিও আন্দোলন ছিল কোটা সংস্কারের, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটা ক্ষোভের সাথেই যেন সংসদে পুরো কোটা বাতিল করে দেবার ঘোষণা দিলেন। যদিও, পরবর্তীতে সংসদীয় কমিটি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বিপরীতে গিয়ে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব করেছে।
কোটা বাতিলের ঘোষণার সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনরত ছাত্রদের অভিভাবকত্বের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।অর্থাৎ,বর্তমানে যারা সরকারে আছেন তারা বয়সের কারণেই ছাত্রদের অভিভাবক সমতুল্য। এ অর্থে ছাত্রদের ভালমন্দ দেখভাল করবার বিষয়টি তাদের এবং তারা ছাত্র/ছাত্রীদের চেয়েও তাদের সমস্যার বিষয়ে বেশি অবগত।
কিন্তু, একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হল অভিভাবকত্বের ধারণা গণতন্ত্রের ধারণার শুধু বিপরীতই নয়, সরাসরি সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রের মূল ধারণাই হচ্ছে দেশ ভেদে ১৮ বা ২১ বছর উর্ধে সকল নারী-পুরুষই সমান। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ কারো অভিভাবক হবার সুযোগ নেই। সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মতামতই এ ব্যবস্থায় সমান গুরুত্ব বহন করে।

অভিভাবকত্বের ধারণাটির সাথে সামন্ততান্ত্রিকতা, নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা, সামরিক শাসন, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি যুক্ত। এ সমস্ত ব্যবস্থায় কিছু মানুষ নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে বেশি জানেন বা বোঝেন এরকমটা ধরে নেন। জণগনের কিসে মঙ্গল হবে সেটা তারাই সবচেয়ে ভালো বোঝেন এটা ভেবে নিয়ে নিজেদেরকে জনগণের অভিভাবক বা গার্ডিয়ান ক্লাশ মনে করেন।


এ অভিভাবকত্বের ধারণা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বেগম সুফিয়া কামাল হল থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কয়েকজন ছাত্রীকে রাতের অন্ধকারে বের করে দিয়ে তাদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেন। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। আন্দোলনের সংখ্যাগুরু অংশটা ছাত্র হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন প্রকার তদন্ত প্রমাণ ছাড়াই বায়বীয় কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে শুধু কিছু ছাত্রীকে হল থেকে বের করে দেয়।
এ বের করে দেবার পিছনে একটা বিষয় পরিস্কার আর সেটি হল আর তিন বছর পর এ বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স একশ বছর হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো শতবর্ষ-পুরানো পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দ্বারা আছন্ন। তাই, ছাত্রদের রাতের অন্ধকারে বের না করে হল প্রশাসন "সফট টার্গেট" হিসাবে ছাত্রীদের টার্গেট করেছে।
সাবেকি পুরুষতান্ত্রিক ধারণার মতই বিশ্ববিদ্যালয়য় প্রশাসন মনে করে, মেয়েরা যে বয়সীই হোক না কেন তাদের অবশ্যই একজন অভিভাবক থাকতে হবে। মেয়েরা নিজেরা যে নিজেদের অভিভাবক হতে পারেন এ বোধ প্রায় শতবর্ষ-পুরানো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাঝে আজো গড়ে ওঠেনি।

হল প্রশাসনকে সাফাই গাইতে গিয়ে উপাচার্য মোঃ আখতারুজ্জামান ছাত্রীরা ফেইক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে হল সংক্রান্ত এবং সরকারবিরোধী অপতথ্য দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। জন্মলগ্ন থেকেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/শিক্ষকদের মূলধারাটাই সরকার বিরোধী ছিল তেমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য হয়ে আখতারুজ্জামান ছাত্রীদের সরকার বিরোধী ভূমিকাকে সমস্যা হিসাবে দেখছেন। তাহলে এখন থকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলে কি সরকারবিরোধী হওয়া যাবে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র/ছাত্রীর সরকার সমর্থক হতে হবে?
সরকারের তল্পীবাহক হওয়াটা অনেক দিন থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য হওয়ার মূল যোগ্যতা। ফলে, উপাচার্য মোঃ আখতারুজ্জামানের এ কথা মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক যে, একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা কতটা গণতান্ত্রিক সেটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হল সে ব্যবস্থা সরকার বিরোধিতাকে কতটা ধারন করতে পারে।


কোন সন্দেহ নেই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান/দৌহিত্রদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা ব্যবস্থায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির সুযোগ রয়েছে, বিশেষত যেখানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট অনেকের কাছেই রয়েছে। এছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশ সেদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের দৌহিত্রদের সরকারী বা বেসরকারী চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধা দেয় বলে আমার জানা নেই। কোন সন্দেহ নেই কোটা ব্যবস্থার এ অংশটি নিঃসন্দেহে সংস্কার করতে হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল ছাত্রীদের তাদের জন্য সংরক্ষিত ১০ শতাংশ কোটার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। এর মধ্যে দিয়ে ছাত্রী সমাজ নিজেদের মেধা আর যোগ্যতার প্রতি তাদের আস্থার জায়গাটা স্পষ্ট করেছে। তারা পরিস্কার জানান দিয়েছেন যে কোটা ব্যবস্থার সুবিধার উপর নির্ভর করে কোন প্রতিযোগিতায় তারা আর যেতে চান না। এটি নারী সমাজের অগ্রসরমানতার একটি ইতিবাচক দিক।
এর মধ্যে দিয়ে আবার একই সাথে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ত্যাগও স্বীকার করলেন এ দেশের ছাত্রী সমাজ। এর বিপরীতে পুরুষদের জন্য যদি কোন কোটা বরাদ্দ থাকত তাহলে তারা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন কিনা সন্দেহ।
এদেশের সবচেয়ে পশ্চাতপদ অংশ হল প্রতিবন্ধী এবং আদিবাসী ("ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী")। এদের জন্য ছয় শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রয়েছে। পৃথিবীর বহুদেশেই পশ্চাতপদ অংশের জন্য সংরক্ষিত কোটা থাকে। এ ছয় শতাংশ কোটা সংস্কারের কোন অবকাশ নেই। এ কোটা উঠিয়ে দেয়া হলে তা হবে সংবিধান এবং মানবাধিকার পরিপন্থী। তাছাড়া, আন্দোলনকারীরাও ১০ শতাংশ কোটা রাখার পক্ষে।


এটি নিঃসন্দেহ যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ন হল বৃটিশ-পাকিস্তান আমলের উত্তরাধিকার আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুরো সংস্কার, যাতে করে তা হয়ে উঠতে পারে পুরোপুরি গণমুখী। এ সংস্কার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কি করে আমলাদেরকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে জনগণের সেবকে পরিণত করা যায়।
জনগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে আমলাতন্ত্রের মৌলিক সংস্কারের জন্য ব্যাপক আন্দোলনও আশা করে। জনগণ এটা বিশ্বাস করে ছাত্র সমাজ, বিশেষতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সচল হলে এ পরিবর্তন আনাও সম্ভব। গণমুখী আমলাতন্ত্র গড়ে তুলবার দাবীতে ছাত্র/ছাত্রীরা এগিয়ে আসবেন কি?