পোশাক ও যৌনতা–নিকাবনামা

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 30 April 2018, 06:13 PM
Updated : 30 April 2018, 06:13 PM

ইসলাম এক, আল্লাহ এক, কোরান এক, রসুল এক। কিন্তু আলেমরা মুসলিম নারীর জন্য অন্তত ৩ রকমের বিভিন্ন পোশাককে দাবি করেছেন ইসলামী বলে।(ক) শুধু চোখ খোলা রেখে সারা শরীর ও চেহারা আবৃত যেমন আফগানিস্তানে তালেবানরা আইন করেছিল (নেকাব বা নিকাব), আমাদের অনেক মাওলানাও এ দাবী করে থাকেন, (খ) চেহারা ও হাতের কব্জি পর্য্যন্ত খোলা রেখে সারা শরীর আবৃত যেমন বহু মুসলিম দেশে আছে, এবং (গ) সংযত পোশাক, শুধু নামাজ-আজান ইত্যাদি ও গুরুজনের সামনে মাথায় কাপড় দেয়া যা ইসলাম প্রচারকেরা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং যা আমরা করতে দেখেছি নানী-দাদীদেরকে। যেখানে নেতারাই বিভক্ত সেখানে আমরা তো বিভক্ত হবই। সমস্যা হয় যখন সমর্থকদের তো বটেই, কোন কোন আলেম/মাওলানাদের ওয়াজ বক্তৃতায় উৎকট গালাগালি শুরু হয়ে যায়। প্রমাণ হয় যে আমরা এখনো পরস্পরের সম্মান বজায় রেখে সুস্থ বিতর্ক-আলোচনার যোগ্য হয়ে উঠিনি। প্রতিবাদের ভাষা আসলেই প্রতিবাদীর চরিত্র প্রমাণ করে। এবারে আমরা দেখব (১) কেতাব, (২) বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এবং (৩) বাস্তব।

(১) কেতাব
• কোরানে এ ব্যাপারে আয়াত আছে নুর ৩০, ৩১, ৬০ ও আহযাব ৫৩ ও ৫৯। সবার কাছেই কোরান আছে বলে উদ্ধৃতি দিচ্ছি না, লম্বা হয়ে যাবে তাই। অতীত বর্তমানের আলেমরা এই আয়াতগুলোকে পরস্পর-বিরোধী ভাবে ব্যাখ্যা করে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফলে মুসলিম বিশ্বও বিভক্ত হয়ে গেছে। আমাদের উচিত হবে সেটাই গ্রহণ করা যেটাতে আমাদের সময়ে সমাজের মঙ্গল হবে। এবারে আমরা কিছু সহি হাদিস দেখব।
(ক) নেকাবের সমর্থনে-
• পোশাকের আয়াত নাজিল হলে নারীরা তাদের চেহারা ঢাকা শুরু করল; তারা নবীজী'র (স) সামনে চেহারা ঢাকত না, অন্যান্যদের সামনে ঢাকত – বুখারী ৫-৩২ ও ৬-২৮২ ইত্যাদি, আরও আছে। নেকাবের পক্ষের আলেম দেশে অনেক, পত্রিকার ইসলামী পাতায় ক্রমাগত অজস্র নিবন্ধ ছাপা হচ্ছে, সে ব্যাখ্যা সবাই জানেন বলে বিস্তারিত দিচ্ছি না।
(খ) নেকাবের বিপক্ষে:-
• পুরুষের প্রতি কোরানের "দৃষ্টি নীচে কর" (নুর ৩০) প্রমাণ করে নেকাব নারীর পোশাক নয়।
• পোশাকের আয়াত নাজিল হলে নারীরা জানালার পর্দা কেটে মাথা-ঢাকার স্কার্ফ তৈরী করল – আবু দাউদ ৪০৮৯।
• এক সুন্দরী নারীর সৌন্দর্য্যে "আকৃষ্ট হইয়া" সাহাবী আল ফাদেল তার দিকে তাকিয়ে থাকলে নবীজী (স) ফাদেলের চিবুক ধরে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন, নারীকে মুখ ঢাকতে বললেন না – বুখারী ৮-২৪৭.
• নবীজী (স) বললেন মেয়েরা বড় হলে চেহারা ও হাত ছাড়া আর কিছু দেখানো উচিত নয় – আবু দাউদ ৪০৯২। এটা সুরা নুর আয়াত ৩১-এর সাথে যায়, নারীরা যেন সৌন্দর্য্য প্রকাশ না করে, "যা সাধারণত: প্রকাশমান তাহা ব্যতীত"।
• জাবির বিন আব্দুল্লাহ – নবীজী (স) বলেছেন কোন পুরুষ যদি কোন নারীকে বিয়ে করতে চায় তবে সে সেই নারীর সেটা দেখতে পারে যা তাকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। "আমি এক নারীকে বিয়ে করতে চাইলাম। আমি গোপনে তাকে দেখলাম…" ইত্যাদি – আবু দাউদ ২০৭৭।
• হজ্ব ও ওমরাতে নারীর চেহারা খোলা থাকলে অন্যত্র থাকবে না কেন।
• ড: জাকির নায়েক সহ অনেকে বলেন নিকাব শুধু নবীজীর (স) স্ত্রীদের জন্য, এটা আহযাব ৫৩ ও হাদিস দ্বারা সমর্থিত। সাফিয়ার সাথে নবীজীর (স) এক ভ্রমণে সাহাবী বলছেন যদি নবীজী (স) সাফিয়াকে নিকাব পড়ান তাহলেই বোঝা যাবে সাফিয়া তাঁর স্ত্রী, নাহলে নয় – বুখারী ৭-২২, মুসলিম ৮-৩৩২৮।
• নবীজীর (স) সময় অনেক যুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ, জামাল যুদ্ধে বিবি আয়েশার (রা) সেনাপতিত্ব (বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখিত) ইত্যাদি প্রমাণ করে নারীরা কখনোই নেকাব পরেন নি এবং গৃহবন্দীও ছিলেন না।

(২) বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য
এবারে দেখা যাক মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ বিশেষজ্ঞদের নেকাববিরোধী সিদ্ধান্ত। আমাদের নিকাবপন্থী আলেমরা তাঁদের সাথে কথা বললে ভালো হয়।
• আল আজহার বিশ্ব-বিদ্যালয়ের প্রাক্তন গ্র্যান্ড মুফতি ও গ্র্যান্ড ইমাম ড: তানতাওয়াঈ -" ইসলামের সাথে নেকাবের কোনো সম্পর্ক নেই- এটা সামাজিক প্রথা মাত্র" – বিবিসি নিউজ ০৫ অক্টোবর ২০০৯ ও বিশ্বব্যাপী অনেক সূত্র।
• ড: জাকির নায়েকের বক্তৃতা -"আমি সমর্থন করি যা শেখ নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেছেন, মুসলিম নারীর জন্য চেহারা ঢাকা আবশ্যিক নয়"। পাওয়া যাবে ইন্টারনেটে এই নামে – "কভারিং দি ফেস অফ উওম্যান অ্যানসার্ড বাই ড. জাকির নায়েক"।
• "নারীর ইসলামী পোশাকের ব্যাপারে আলেমরা একমত হইতে পারেন নাই" – মুসলিম ব্রাদারহুড-এর প্রতিষ্ঠাতা মিসরের হাসান আল বান্নার নাতি "ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম নেতা" হিসাবে বিখ্যাত ড: তারিক রামাদান।
• শেখ আহমদ কুট্টি, সিনিয়র শিক্ষক ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ – পাওয়া যাবে ইন্টারনেটে এই নামে – "রুলিংস রিগার্ডিং ওয়্যারিং হিজাব এন্ড নিকাব" – ইসলাম অন লাইন ডট নেট।
• পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ইসলামী সংগঠন কাউন্সিল অফ ইসলামিক আইডিওলজি- "নারীদের চেহারা, হাত ও পা ঢাকা জরুরী নয়" – দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন ১৫ অক্টোবর ২০১৫।
• সৌদি আরবের কমিশন ফর দি প্রমোশন অফ ভার্চু বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আহমেদ বিন কাসিম আল ঘামিদী – "নারীদের চেহারা ঢাকা জরুরী নয়" – মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ – ০৬ ডিএসম্বর ২০১৪।
• সম্প্রতি সৌদি ইমামেরাও বক্তব্য দিয়েছেন "নারীদের চেহারা ঢাকা জরুরী নয়", সরকারও সেটা মেনে নিয়েছে। সেখানে এবং সারা মধ্যপ্রাচ্যে নেকাবের বাধ্যবাধকতা নেই।

(৩) বাস্তব
এ তো গেল দলিলের কচকচি, পক্ষ বিপক্ষের মতামত। কে কি মানবে সেটা তার ব্যাপার কিন্তু "আমারটাই সত্য তোমরা সব মিথ্যে" এই হুংকারে গাত্রদাহ নিরসন হতে পারে কিন্তু হানাহানি বেড়ে যায়, শান্তি নষ্ট হয়। এবারে দেখা যাক বাস্তবে দুনিয়ায় কি ঘটছে কারণ জীবনের সবচেয়ে পরাক্রান্ত শক্তি হল বাস্তব যা কারো বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেনা।
• নিদারুন বাস্তব – নারীকে নেকাব-বন্দী করে ভেতর থেকে কি ধ্বংস হচ্ছে সৌদি সমাজ? তার প্রমাণ উঠে এসেছে ওই সৌদি সমীক্ষাতেই। সৌদি আরবের টিভিতে প্রচারিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৩% সৌদিরা শিশুকালে আত্মীয়, ভাই, শিক্ষক দ্বারা ধর্ষিত/ধর্ষিতা, রিয়াদ শহরে ৪৬% তরুণ তরুণী সমকামী। অনেক খুঁজেও এ ব্যাপারে সৌদি সরকারের কোনো প্রতিবাদ আমি পাইনি। ইন্টারনেটে এর বহু লিংক আছে, সার্চ করলেই পাবেন – Saudi Study: 23% of Arab Children Raped; 46% of Arab Students Homosexual
• সৌদি আরবের সর্বোচ্চ সুরা কাউন্সিলে ১৫০ জন সদস্যের মধ্যে নারী ৩০ জন, টিভি'র খবরে দেখা গেছে তাঁদের অনেকেই চেহারা ঢাকেন না – সেন্টার ফর ইসলামিক প্লুরালিজম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩। কাতার-এর রাজকন্যার ছবি – দৈনিক আমার দেশ ২৯শে অক্টোবর ২০১৩।


• মধ্যপ্রাচ্য, ইরাণ, মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া সহ প্রায় সব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ইমামেরা নারীর ওপরে নেকাব চাপিয়ে দেননি। তাঁরাও তো ইমাম, তাঁরা কেন দেননি? আমাদের নিকাব-পন্থীদের উচিত সেটা তাঁদের জিজ্ঞাসা করে খুঁজে বের করা।
• কিছু মুসলিম প্রধান দেশ সহ এসব দেশে/শহরে/অঞ্চলে আইন বানিয়ে কিছু শহরে/অঞ্চলে বা পুরো দেশে নেকাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে: চাদ রিপাবলিক, নিগার, ক্যামেরুন, কঙ্গো, তুর্কীস্থান, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ইতালীর নোভারা ও ভারালো সেশিয়া শহর, চায়না'র উরুমকি শহর, স্পেনের বার্সিলোনা, রিউস ও ক্যাটালোনিয়া'র কয়েকটি শহর, সুইজারল্যান্ডের তিসিন'র ক্যান্টন শহর, রাশিয়ার স্যাভর্পুল শহরের সরকারী স্কুলে, সৌদি আরবে হজ্ব ও ওমরার সময়, কায়রো বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের জন্য ইত্যাদি – ইজিপ্সিয়ান স্ট্রীট, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫, দি টেলিগ্রাফ, ১৭ আগষ্ট ২০১৭ ইত্যাদি।
• মুসলিম প্রধান দেশ শাদ-এর রাজধানী দেজামেনার এক মার্কেটে বোরকা পরিহিত নারীর ছদ্মবেশে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ১৫ জনকে নিহত ও ৮০ জনকে আহত করে। কাউকে বোরকা পরিহিত অবস্থায় দেখলেই গ্রেফতার করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ- দৈনিক সংগ্রাম ১৫ই জুলাই ২০১৫ ।


• বাংলাদেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিডিও ফুটেজ দেখে জহুরুল ইসলাম মিঠু (১৬) নামে এক চোর আটক হয়েছে – দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ অক্টোবর ২০১৫ । নেকাব থাকলে চোর ধরা যেত? যেত না।

• সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ভারতের আজমগড়ে নিকাব পরে মন্দিরে গরুর মাংস ছুঁড়ে পালানোর সময় ধরা পড়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কর্মী- দৈনিক সংগ্রাম ডেস্ক: ০৩ অক্টোবর ২০১৫।

• জুলাই ২১, ২০০৫-লণ্ডন বম্বিং-এর নিকাবী বোমাবাজ পালিয়ে গেছে।
• নিকাবী ডাকাতরা লণ্ডনের ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর সেলফ্রিজ-এ ডাকাতি করে পালিয়ে গেছে জুন ২০১৩ সালে।
• ইংল্যান্ডে পুরুষ খুনীরা নিকাবী-নারীর ছদ্মবেশে ফ্লোরেন্স ডিক্সি নামের এক মহিলাকে হত্যার চেষ্টা করে।
• ইংল্যাণ্ডে নারী-পুলিশ শ্যারন বেশেনিভিস্কি'র হত্যাকারী মুস্তাফ জুমা নিকাব পরে পালিয়ে গেছে মনে করা হয়।
• পাকিস্তানের রেড-মস্ক-এর কুখ্যাত মোল্লা ফয়জুল্লা আত্মঘাতী বোমা দিয়ে সরকার উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছিল -সেনাবাহিনীর গুঁতো খেয়ে সে নিকাব পরে পালাবার সময় ধরা পরে।
• এ ছাড়াও ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, নাগরিক কার্ড, হাসপাতাল বিমান-বন্দর সহ সর্বত্র নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এসব সমস্যা আছে। বাস্তবে নেকাব নারীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পেশা ও শখ বন্ধ বা ব্যাহত করে যেমন রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক উচ্চপদ, ট্রেন-জাহাজ-এরোপ্লেন চালানো, ডাক্তার, সার্জন, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সার্ফিং, পর্বতারোহন, ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার ইত্যাদি খেলাধুলা ও শখ। নারীর কি ওসব ইচ্ছে করে না? নিশ্চয়ই করে। নারীর কি ওসব অধিকার নেই? অবশ্যই আছে। এই সেদিনও বাংলার নারী এভারেস্ট জয় করেছেন, 'বেঙ্গল মেসি কন্যা' বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন নারী সাফ ফুটবল টুর্নামেন্টে হ্যাট্রিকসহ সাতটি গোল করেছেন। প্রথমবারের মত সাফে রানার্স আপ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবলাররা। আনাই মারমা, আনুচিং মারমা, মনিকা চাকমা অভাবী সংসারের মধ্যেও অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে এসে পায়ের জাদুতে এখন দেশের আলো ছড়াচ্ছে বিশ্বময়।

প্রথম দিকে আমিও দাবী করতাম পোশাক নির্ধারণ নারীর অধিকার, সেটা নেকাবই হোক না কেন কারণ সে তো আর কারো ক্ষতি করছে না। কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে অন্য চিন্তা করতে হচ্ছে কারণ নিকাব এখন হয়ে উঠেছে ক্রিমিন্যালদের রক্ষাকবচ। যে প্রথা খুনী ডাকাত অত্যাচারীদেরকে নিরাপত্তা দেয় তা অবশ্যই আইন করে বন্ধ করা দরকার। কোনো হিন্দু যদি সতীদাহ করতে চায় কারণ ওটা তার ধর্মে আছে, তবে যে কোনো ধর্মের হন না কেন এই আপনিই কি তাকে বাধা দেবেন না? অবশ্যই দেবেন। কারণ ধর্মীয় সংস্কৃতির বাহানায় কারো ওপর অত্যাচার করা যায় না, কারো অধিকার ক্ষুন্ন করা যায় না।
যদি বিশ্বাসও করি নেকাব কোরানের হুকুম তাহলে বিশেষজ্ঞদের একথাও মানতে হবে যে কোরানের কিছু হুকুম তাৎক্ষণিক এবং কিছু চিরকালের। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শারিয়া-সমর্থক বিশেষজ্ঞ ড: হাশিম কামালী তাঁর "প্রিন্সিপল্স অফ ইসলামিক জুরিস্প্রুডেন্স"-এ বহু উদাহরণ দিয়ে বলেছেন – "নবী (দঃ)-এর সময়েই কোরাণ ও সুন্নাহ-তে কিছু পরিবর্তন করা হয়। পরিস্থিতির পরিবর্তনই ইহার মূল কারণ…. মানুষের উপকারের জন্য সমাজের বিদ্যমান পটভূমি ও আইনের সমন্বয় করার প্রয়োজনে নসখ আসিয়াছে……কোরাণ ও হাদিসে নসখ-এর সর্বপ্রধান কারণ হইল স্থান-কালের বিষয়টি।" এমনকি মৌদুদীও সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন:- "বিভিন্ন পয়গম্বরের প্রচারিত ধর্মীয় আইনগুলিতে ভিন্নতা আছে কেন? (differ in matters of detail)…বিভিন্ন পয়গম্বরের প্রচারিত বেহেশতি কেতাবে নির্দেশিত ইবাদতের পদ্ধতিতে, হালাল-হারামের বিধানগুলিতে ও সামাজিক আইনগুলির বিস্তারিত কাঠামোতে (dtailed legal regulations) ভিন্নতা আছে কেন ?…(কারণ) স্বয়ং আলাহ বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন জাতির ও বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াইবার জন্য আইনের ধারা (legal prescriptions) বদলাইয়াছেন"− মায়েদা ৪৮-এর ব্যাখ্যা, মৌদুদীর বিশাল বই তাফহিমুল কুরাণ। অবশ্যই তাই, "মানুষের উপকারের জন্য সমাজের বিদ্যমান পটভূমি ও আইনের সমন্বয়" এটাই মূল কথা। আজ আপনি যদি ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান হন, ফিরিয়ে আনবেন অমুসলিমদের  উপর জিজিয়া ট্যাক্স? বন্দিনী ধর্ষণ? চালু করবেন দাসপ্রথা যেখানে হাট-বাজারে আলু-পটলের মত মানুষ কেনাবেচা হবে? করবেন না। কারণ পরিস্থিতি পালটে গেছে।

কালতামামী
নেকাবপন্থীদের মতে নেকাবের উদ্দেশ্য হলো নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করে ধর্ষণ ও যৌন উশৃঙ্খলতা বন্ধ করা। উদ্দেশ্যটা ভালো, কারণ বিশ্বময় ওটা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। কিভাবে তা বন্ধ করা বা কমানো যায় তা নিয়ে সমাজ-বিশেষজ্ঞরা মাথা ঘামাচ্ছেন, উপায় এখনো বের করতে পারেন নি। যৌবন এক পরাক্রান্ত শক্তি। ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক সংস্কৃতি ইত্যাদি দিয়ে এ শক্তিকে এতদিন মোটামুটি বশে রেখেছিল মানুষ। কিন্তু এখন মহাপরাক্রান্ত প্রযুক্তি এসে সবকিছু ভেঙ্গে চুরে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছেলেমেয়ের অবাধ যৌনতা এখন অপ্রতিরোধ্য। পোশাক নিয়ে হানাহানি করে, মুখ ঢেকে বা ফেসবুক, ইউটিউব ও ওয়াজ মহফিলে হুংকার দিয়ে বা গালাগালি করে এটা ঠেকানো তো দুরের কথা কমানোও যাবে না, অন্য পথ ধরতে হবে। সেটা সমাজগুরু, ধর্মগুরু, সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব। সমাজগুরু ও ধর্মগুরুরা জাতিকে শান্তভাবে হেদায়েত করুন (এখন ওটারই প্রচণ্ড অভাব), সরকার যৌন-অপরাধের বিরুদ্ধে শক্ত আইন করে কঠিন ভাবে তার প্রয়োগ করুন। দায়িত্ব আমাদের জনগণেরও আছে – আমরা জনগণ যেন যৌন-অপরাধের বিরুদ্ধে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারি।
এগুলো ছাড়া এই নিকষ অন্ধকার থেকে বের হবার আর কোন উপায় দেখছিনা। বিশ্বাসের "সত্য" কখনো সতীদাহের মতো মারাত্মকও হতে পারে –
"সত্য সত্য করিস নারে মন,
এমন সত্য আছে ভবে, হাত লাগাইলে বুঝবি তবে,
জ্বইলা যাবি অঙ্গারের মতন"…