পোশাকরীতিতে আওয়ামী লীগের সতর্কতা জরুরি!

সাব্বির খানসাব্বির খান
Published : 29 April 2018, 05:50 AM
Updated : 29 April 2018, 05:50 AM

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর চক্রান্তকারী খন্দকার মোস্তাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সদ্যস্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জাতির পিতাকে হত্যায় জাতি কেঁদেছিল, হাতেগোনা অল্প কয়েকজন মুজিবপ্রেমী এই হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য কেউ বুক চেতিয়ে এগিয়ে আসেননি রাস্তায়। প্রতিবাদে কেঁপে ওঠেনি রাজপথ। অনেকে পালিয়েছিলেন বিদেশে। অনেকেই রাতের আঁধারে হয়ে গিয়েছিলেন মুজিববিদ্বেষী। জেনারেল জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে তৎপর হয়েছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের অনেকেই!

২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল রাতে ঢাবির কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ইশরাত জাহান এষাকে পেটাতে পেটাতে নিচে নামিয়ে এনে তর পরিধেয় কাঁপড় ছিড়ে ফেলা হয়েছিল। তাকে জুতোর মালা পরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া হয়েছি। 'এষা এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে'- চক্রান্তকারীরা কথাটা রটিয়ে দিয়েছিল সারাদেশব্যাপী। ছাত্রলীগকতৃক বিভিন্ন হলের ছাত্রছাত্রীদের অত্যাচারের মুখরোচক কাহিনী খুব পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল চারিদিকে। এমনকি সরকার ছাত্রলীগকে কোটা সংস্কারবাদীদের আন্দোলন ঠেকাতে মাঠে নামিয়েছে বলেও রটানো হয়েছিল। পরে জানা গেল মূল চক্রান্তকারীরা দলের ভিতরে থেকেই বাইরের ইন্ধনে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলছিল। ছাত্রলীগের শীর্ষনেতারা এসব রটনার প্রতিবাদ না করে দায় এড়াতে এষাকে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে তাৎক্ষণিক বহিস্কার করেছিল। পক্ষান্তরে, এষাকে বহিস্কার করে চক্রান্তকারীদের রটনাকে সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠণ ছাত্রলীগ, যা চক্রান্তকারীদের পালে হাওয়া দিয়েছিল দ্বিগুণ বেগে। দলের ক্রান্তিকালে নেতারা নৈতিক দায় নেয়া থেকে বিরত থেকেছিলেন। অথচ তারপরেও কি সরকার এবং আওয়ামী লীগ বদনাম থেকে রক্ষা পেয়েছিল!

'৭৫ এর প্রায় ৩৪ বছর পর মুজিবহত্যার বিচার হয়েছে। এষাকে বহিস্কারের তিনদিনের মাথায় বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে পঞ্চম দিনে মূল চক্রান্তকারীদের বহিস্কার করা হয়েছে। তদন্তে চক্রান্তকারীদের পরিচয় জেনেছে জাতি। আওয়ামী লীগ ১৯৭৫এ ক্ষমতায় ছিল এবং ২০১৮তেও ক্ষমতায় আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর অনেক আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা অনৈতিকভাবে চুপ থেকেছিলেন, মোস্তাকদের বাঁধা দেননি কেউ। পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন অনেকে। ২০১৮ সালে এষাকে বহিস্কার করে দায় এড়িয়েছে ছাত্রলীগের নেতারা। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হয়েও আওয়ামী লীগ নেতারা চুপ থেকে অনৈতিকতাকে প্রশ্রয়ই শুধু দেননি, একই সাথে পরোক্ষভাবে নোংরা রটনাকে স্বীকার করেও নিয়েছিলেন সেদিন। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কেউই প্রথম ২৪ ঘন্টা এষার নাম উচ্চারণ করেননি ভয়ে, লজ্জায় অথবা গা বাঁচাতে। সেদিনের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রায় ছাত্রলীগশূন্য। দখল নিয়েছিল সরকারবিরোধী চক্রান্তকারীরা!

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নোংরা, বানোয়াট প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছিল বাঁধাহীনভাবে। মুজিবহত্যার চক্রান্তকারীরা জনসমর্থন আদায় করতে পেরেছিল মিথ্যার বেসাতী দিয়ে। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিলের পর তিনদিন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিরামহীম বিষোদ্গার এবং প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে সংঘবদ্ধ চক্রান্তকারীরা সাধারণের অনুভূতিতে নাড়া দিতে পেরেছিল এবং সরকারবিরোধী সমর্থণ আদায়েও অনেকাংশে সফল হয়েছিল।

১৯৭৫- এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ আকাশচুম্বী জনসমর্থণ নিয়ে ক্ষমতায় থাকা সত্বেও বিপদকালে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলের পাশে নৈতিক সমর্থন নিয়ে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। বরং তাদের দ্বিধাদ্বন্দ তৃণমূলকে বিভ্রান্ত করেছে অনেকাংশে। জননেত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশের আকাশচুম্বী উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আদর্শিক ও নৈতিক মননশীলতার কোন উন্নয়ন হয়েছে বলে প্রমাণ হয়নি! তুলনামূলক এই পর্যালোচনায় ১৯৭৫ এবং ২০১৮ সালের সুবিধাবাদী, অনাদর্শিক চরিত্রগুলোর মাঝে মৌলিক কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য শুধু এলার্মিংই নয়; একই সাথে ভয়াবহ! এ ব্যাপারে দলের নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হওয়া জরুরী!

দুই.

যেকোন ধরনের আচারঅনুষ্ঠানেরই নির্দিষ্ট কিছু Dress-code বা পোশাকরীতি থাকে। এ রীতি সার্বজনীন এবং আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। বিয়ে, জন্মদিন বা মৃত্যুদিবস, খেলার মাঠ বা জাতীয় কোন দিবসে দেশভেদে নির্দিষ্ট পোশাক পরার রেওয়াজ থাকে। কোন বিশেষ গোত্রের জন্যেও নির্দিষ্ট ধরণের পোশাক থাকে, যা ব্যক্তিকে অন্যগোত্র থেকে আলাদা করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়বহনকারী বিশেষ ধরনের পোশাকরীতিও আছে, যা একদলের কর্মীদের অন্য দল থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে পোশাকরীতির এ প্রবণতা অত্যন্ত জোরালো।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় যে দলগুলো আছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ অন্যতম। এদলের নেতা-কর্মীরা সাধারণত সাদা পাঞ্জাবীর উপর কালো মুজিবকোট পরে দলীয় পরিচয় প্রকাশ করেন। একইভাবে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিশেষ ধরণের সানগ্লাস এবং সাফারী টাইপের পোশাক পরেন। বামপন্থীরা কিছুটা অগোছালো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা পাজামা-পাঞ্জাবী ছাড়াও মাথায় 'টুপি' পরে থাকেন। টুপি পরে তারা একটি মৌলবাদী, ধর্মাশ্রয়ী দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটা গণমানুষের দল। এ দলে আছে সব ধর্মের মানুষ। জাতির পিতার জীবদ্দশায় তিনি বিদেশ সফর ছাড়া সব সময়ই সাদা পাঞ্জাবীর উপর কালো হাতাকাটা মুজিবকোট পরতেন এবং তা স্বাধীনতার আগে থেকেই। স্বভাবতই এই পোশাক কালেক্রমে হয়ে ওঠে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পোশাকরীতি। অথচ হালআমলে দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রায় ৯০% নেতারা কালো মুজিবকোট পরুক বা না পরুক, তারা মাথায় টুপি পরে অফিস করছেন এবং বিভিন্ন জনসভা ছাড়াও কর্মীসভাতেও একই পোশাকে নিজেদের উপস্থাপন করছেন। এ প্রবণতা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিদের বেলায় দেখা যায় প্রকটভাবে! তাঁরা টুপি পরে অফিস তো করছেনই, টুপি পরা ছবি দিয়ে অনলাইনের বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমেও নিজেদের ঢালাও প্রচার করছেন। অথচ এ দলের যিনি প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কখনোই দেখা যায়নি হিজাব-বোরখা পরে অফিস বা প্রেস কনফারেন্স করতে। আরব দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় সফরেও তিনি সনাতনী শাড়ি পরেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন!

সাম্প্রদায়িক জামায়াত-বিএনপি নতুন প্রজন্মকে যুগের পর যুগ বিভিন্নভাবে প্রতারিত করছে এবং সফলও হয়েছে। প্রজন্ম জেনেছে, টুপি পরা রাজনীতিবিদ মানেই জামায়াত-বিএনপির রাজনীতিবিদ। কিন্তু হালের আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন দুর্দশা কেন হবে যে তাদের দেখলে জামায়াত-বিএনপির নেতাদের পোশাকরীতির সাথে আলাদা করা যাবে না! পোষ্টারে, ব্যালটে, ব্যানারে, দেয়াল লিখনে সর্বত্রই আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের পোশাকরীতি একীভূত হচ্ছে। সম্ভবত এ কারণেই জামায়াত-বিএনপি থেকে অনুপ্রবেশকারীরা খুব সহজেই সর্বস্তরের আওয়ামী লীগের সাথে মিশে যেতে পারছেন, অনেকটা বাহ্যিক ও আদর্শিক দৃষ্টিতে! নিজেদের লুকোতে জামায়াত-বিএনপির অনুপ্রবেশকারীদের আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েও টুপি খুলতে হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই অনুপ্রবেশকারীদের আলাদা করা যাচ্ছে না মূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের থেকে। নির্বাচনে যদি এই প্রজন্মের ভোটাররা ছবি বা পোষ্টার দেখেও ভোট দেন, তাহলে সে ভোট কোন বাক্সে পড়বে, বোধকরি তা বোঝার জন্য কাউকে খুব বেশি জ্ঞানী হতে হবে না!

ধর্ম মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা বিষয়। ধর্মালয় বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় পোশাকরীতি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মন্ত্রনালয়, সচিবালয় বা দলীয় অফিসে কেন ধর্মীয় পোশাক পরতে হবে, তা আমার বোধগম্য নয়! এ চর্চায় আর যাই হোক প্রজন্মের ভোট পাওয়া যাবে না। বরং আওয়ামী লীগের এই ধর্মভিত্তিক পোশাকরীতির জন্য ভোটাররা বিভ্রান্ত হবেন এবং ধর্মীয় যুক্তিতে জামায়াত-বিএনপিকেই সঠিক মনে করবে। ধর্ম এবং ধর্মীয় পরিচয়বহনকারী পোশাকই যদি হবে ভোট দেয়ার আদর্শিক শর্ত, তাহলে কেন ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে, প্রজন্মের এ প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগ কিভাবে দেবে আমার জানা নেই!

ধর্মীয় পোশাকরীতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রবেশদ্বারকে উন্মুক্ত করেছে জামায়াত-বিএনপির জন্য। এ দরজা বন্ধ করতে হবে এবং শীঘ্রই। ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনতাউত্তর আওয়ামী লীগকে খেসারত দিতে হয়েছে একাধিকবার। আগামীতেও যে ইতিহাসের পূনরাবৃত্তি হবে না সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। ব্যক্তিগত এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মুজিববাদের পোশাকরীতিতে উৎসাহিত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে, জাতির জনকের 'জয় বাংলা' শ্লোগানের সঠিক অনুবাদ ধর্মীয় পোশাকে নেই। নির্বাচনের পূর্বেই আওয়ামী লীগকে এব্যাপারে নির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।