সব কথা কি শেখ হাসিনার কাছে যাচ্ছে?

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 22 April 2018, 04:01 AM
Updated : 22 April 2018, 04:01 AM

ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ছিলেন আবু জাফর চৌধুরী। বাবা ছিলেন প্রভাবশালী মানুষ। নাম নজমুুল হুদা চৌধুরী। দশ গ্রামের সবাই তাঁকে এক নামে চিনে। বিচার সালিশেও ডাক পড়ত তাঁর। চাকরি করতেন চট্টগ্রাম কোর্টে, অ্যাসিস্টেন্ট কালেক্টরেট ছিলেন। পরবর্তীতে চাকুরি ছেড়ে দেন তিনি।
আবু জাফর তখন রাউজানের আর্য্যমত্রৈ হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। হেড মাস্টার তার বাবার বন্ধু। ছাত্রদের খুব পেটাতেন তিনি। দুষ্ট হওয়ায় নিয়মিতই বেতের বাড়ি পরত আবু জাফরের শরীরেও। ফর্সা শরীর। বেতের বাড়ি লাল হয়ে ভেসে উঠত। বাবা দেখে বলতেন– 'বলে দিয়েছি, তোমাকে আরও পেঠাবে।' কিন্তু মা মর্জিনা চৌধুরী ছেলের কষ্টে কষ্ট পেতেন। বলতেন– 'আমার ছেলেকে কেন মারবে?'
একবার সিদ্ধান্ত হয় স্কুল পরিবর্তনের। কিন্তু হেড মাস্টার সাহেব কিছুতেই টিসি দিবেন না। একরাতে স্কুল অফিসের মাটির ঘরের চাল বেয়ে ভেতরে ঢুকে টিসি বইয়ে সীল মেরে নিয়ে আসে আবু জাফর। অতঃপর তাতে নিজেই প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর দিয়ে ভর্তি হন রাউজান হাই স্কুলে। দুরন্ত সেই দিনগুলির কথা তার আজও মনে পড়ে।
কিন্তু বাবার স্মৃতিতে অশ্রুসিক্ত হন আবু জাফর চৌধুরী। বলেন– 'বাবা খুব গরম লোক ছিলেন। কিন্তু সামনে গরম দেখালেও রাতে ওপুত ওপুত বলে ডাকতেন। আদরও করতেন ভীষণ। তাঁর হাতে একটা লাঠি থাকত। অনেক বড় হয়েও সে লাঠির বাড়ি খেয়েছি। বাবা অন্যায় সহ্য করতেন না। সম্পদশালী ছিলেন। কিন্তু মানুষের নানা কাজে তা দান করতেন। সাত নম্বর রাউজান ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন তিনি।

পাকিস্তানি আর্মি তখন রাউজান কলেজ মাঠে ক্যাম্প করেছে। আমি, হারুন আর সলিমুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাতে ঘরে মাদুর বিছিয়ে ভাত খাচ্ছি। সামনে বসা আমার মা আর বাবা। খাওয়া শেষে দেখি বাবার চোখে পানি। বাবা যে কাঁদতে পারেনÑ জীবনেও ভাবিনি। দুহাতে আমার হাত ধরে তিনি শুধু বললেন–'তুমি আমার একটা ছেলে মাত্র। একটা কথা মনে রাখবা: ঘুষ খাবে না, মদ খাবে না, গাজা খাবে না, দেখেশুনে কোনো মানুষকে মারবা না, অন্যায় করবা না, ওয়াদা করো বাবা। দেশের জন্য তোমাকে আল্লাহর হাতে সপে দিলাম।' বাবাকে ছুয়ে আমিও সেদিন ওয়াদা করেছিলাম। সেই ওয়াদা এখনও রক্ষা করে চলেছি।'
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতিকথা এভাবেই তুলে ধরছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরী। প্রায় ৩৬ বছর ধরে তিনি চট্টগ্রাম রাউজান উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমাণ্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বয়স সত্তরের উপরে। বাইপাস সার্জারীর পর এখন জীবন চলছে নানা নিয়মের আবর্তে। তবুও দেশ, মাটি ও মানুষের উন্নতির স্বপ্ন দেখেন এই সূর্যসন্তান।
আবু জাফরের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল প্রাইমারী স্কুলে। পরে তিনি ষষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হন রাউজান আর্য্যমত্রৈ হাই স্কুলে। ১৯৬৫ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন রাউজান হাই স্কুল থেকে। অতঃপর ভর্তি হন রাউজান কলেজে। ওই বছরই আবু জাফর কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হন। এইচএসসি পাসের পর তিনি ভর্তি হন ডিগ্রীতে। এ সময় রাউজান কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ওই কলেজেরই ডিগ্রী পরিক্ষার্থী।

১৯৬৯ সালের আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন আবু জাফর। মিছিল-মিটিং করে তারা দাবী জানায় শেখ মুজিবের মুক্তির। পাশাপাশি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তুলে ধরতেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি নানা বৈষম্যের বিষয়গুলো। কী সেই বৈষম্য?
আবু জাফর বলেন–'তখন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজস্ব ব্যয় ছিল ৫হাজার কোটি টাকা। আর পূর্ব পাকিস্তানে তা মাত্র দেড় হাজার কোটি। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরির কোটা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৮৫% আর পূর্ব পাকিস্তানে ১৫% মাত্র। সামরিক বাহিনীতে ওরা ছিল ৯০% আর আমরা মাত্র ১০%। এসব বৈষম্য তুলে ধরে আমরা জনমত গড়তাম। ছাত্রদের আন্দোলনের কারণেই শেখ মুজিবকে ওরা মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।'
আবু জাফরদের এলাকায় সত্তরের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে এমএনএ প্রার্থী ছিলেন যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী। সে সময় তার লোকেরা গুডস হিলের বাড়িতে তুলে নিয়ে যায় আবু জাফরসহ কয়েকজনকে। হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তবুও জীবনকে বাজি রেখে তারা বঙ্গবন্ধু আর নৌকার পক্ষে কাজ করেছে। সে ইতিহাস শুনি আবু জাফরের জবানিতে।
তাঁর ভাষায়– 'আমি তখন রাউজান কলেজের জিএস। ভিপি লোকমান হাকিম, নুরুল আমিন আর শাহজাহানসহ নিচতলায় অফিসে বসে আছি। হঠাৎ একটা লাল জিপে আসে সালাউদ্দিন কাদেরের ফুপাতো ভাই। সে আমাদের চারজনকে উঠিয়ে নিয়ে যায় গুডস হিলের বাড়িতে। যার বিরুদ্ধে প্রতিদিন মিছিল মিটিং আর স্লোগান দিচ্ছি তার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। তখন মুসলিমলীগ বিরোধীদের এভাবেই তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো।

পাহাড়ের ওপরে বাড়িটি। ঢুকতেই বাঘের অবয়বে গেইট। আমাদের নিয়ে আসার সংবাদে ভেতর থেকে হা হা হাসির শব্দ। মনে হচ্ছিল কোন দৈত্য হাসছে। আমার কাছে এসে ফজলুল কাদের বলে– 'হে ব্যাডা চৌধুরীর পোয়ারে বোয়া, তুই আমার এগেনিস্টে করো দোয়া।' সবাইরে নানা কথা বলে হুমকি দেওয়া হয় প্রথম। লাস্টে বলে– 'তোদের একটা জিপ গাড়ি দিমু। তোরা আমার জন্য কাজ করবি।' আমি বুদ্ধি করে বলি আগে বাড়ি গিয়ে বুঝি। মৃত্যুর হুমকিতেও তখন পিছপা হইনি। সত্তরের নির্বাচনে এমএনএ পদে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে ৪০হাজার ভোটে ডিফেট দিয়ে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে নির্বাচিত করেছিলাম। রাতদিন পরিশ্রম করেছি। ঘরে ঘরে গিয়ে মা বোনদের নিয়ে এসেছি।'


ভিডিও লিংক: যুদ্ধদিনের কথা বলছেন মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরী:

স্বাধীনতা লাভের পরে বিএনপির হাত ধরেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়িতে উড়েছে স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা। মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরীর মনে তখন ঝড় উঠতো। সে সময়কার অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলে–'
'লজ্জা আর অপমানের সময় ছিল সেটা। তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচিত কমান্ডার আমি। সাকার সময়ে বা তার উপস্থিতিতে কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি নাই। একবার ছেলেরা অস্ত্র নিয়ে এসেছিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিসকে বিএনপির অফিস বানানোর জন্য। দেই নি। হুমকি আসছে বহু। কিন্তু আপোস করি নাই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কখনও রাজাকারের কাছে সারেন্ডার করতে পারে না।
যুদ্ধের সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একটা ফিয়েট গাড়িতে করে আসে ফতেপুরে, এক আত্মীয় বাড়িতে। খবর পেয়ে আমরাও গাড়িতে গ্রেনেড থ্রো করেছিলাম। কিন্তু সে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পলিয়ে যায়। তার মতো যুদ্ধাপরাধীকে একাত্তরেই মেরে ফেলতে পারলে দেশটা আরও এগিয়ে যেত!'
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে আবু জাফররা যান ঢাকায়, রেসকোর্স ময়দানে।
তিনি বলেনÑ'আমাদের দাবী ছিল ছয় দফা না হয় এক দফা। স্বায়িত্বশাসন না মানলে দেশ স্বাধীন করতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আমাদের একমাত্র নেতৃত্ব। অপেক্ষায় ছিলাম কী বলেন নেতা। তিনি বললেন–'সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না……..মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ….।' ওই ভাষণই সবার মনে ঝড় তোলে। বঙ্গবন্ধুর ওই নির্দেশনা নিয়েই রাউজানে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারী হই আমি এবং সভাপতি ছিলেন লোকমান হাকিম।'
২৫ মার্চ ঢাকায় আর্মি নামার খবরে আবু জাফররা প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। রাউজান স্কুলের মাঠে চলে যুবকদের ট্রেনিং। এর দায়িত্বে ছিলেন আমিনুর রহমান, আব্দুল হাকিমসহ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও বিডিআর সদস্য। ওইসময় ওই ট্রেনিং তাদের মনোবল বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু বাঁশের লাঠি দিয়ে তো সামরিক বাহিনীকে ঠেকানো যায় না। ফলে ১৩ এপ্রিল সকাল থেকে সর্ত্তারঘাট হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাউজানের দিকে আসতে থাকে।'
আপনারা তখন কী করলেন?
আবু জাফরের উত্তর: 'বিএলএফ বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নামে একটা ছাত্র সংগঠন হয়েছিল। শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন এর প্রধান। চট্টগ্রাম জেলা কমিটিতে ছিলেন এস এম ইউসুফ, এম এ মান্নান, স্বপন চৌধুরী প্রমুখ। রাউজানে বিএলএফ সদস্য ছিল তিনজন–আমি, লোকমান হাকিম সিকদার, শওকত হাফেজ খান রুসদী। ১৩ এপ্রিলের পর এ সংগঠনের নেতারা একত্রিত হয় রামগড়ে। তখন অনেকেই ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে চলে গেলেও আমি চলে যাই রাঙ্গুনিয়ায়, বোনের বাড়িতে। সেখানে পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে দেখি কাপ্তাইয়ের দিকে পাকিস্তানি সেনাদের ট্যান্ক যাচ্ছে। তখন রাজহাট হয়ে গোপনে ফিরে আসি বাড়িতে। দাদীর দেওয়া একটি সোনার হার আর কিছু শুকনো খাবার নিয়ে দুইবন্ধুসহ দেশের জন্য ঘর ছাড়ি।'
আবু জাফররা পায়ে হেঁটে চলে যায় ফটিকছড়ি বর্ডারে। সেখান থেকে দুর্গম পাহাড় ও নদী পথে ভারতের সাবুরুম এলাকায়। এস এম ইউসুফের মাধ্যমে তিনি ট্রেনিংয়ের জন্য নাম লেখান। ৪৫ দিনের ট্রেনিং হয় আসামের লোয়ারবন হাফলং ক্যাম্পে। তারা ছিলেন বিএলএফ এর প্রথম ব্যাচের যোদ্ধা।
পাহাড়ের ওপরে ছিল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ক্যাম্পে ব্রিফিং করেছিলেন জেনারেল এস. এস উবান। দুই পাহাড়ের মাঝে কসম প্যারেড হয়। শেষের দিন তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক ও আফতাব উদ্দিন সাহেব আসেন। পরে অস্ত্র দিয়ে তাদের আনা হয় উদয়পুরে, জঙ্গলের ভেতর একটা প্রাইমারী স্কুলে।
যুদ্ধদিনের প্রসঙ্গ আসতেই মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফরের চোখ হয় ছলছল। কথার মাঝে দুএক ফোটা জলও গড়িয়ে পড়ে। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলতে থাকেন।
তাঁর ভাষায়–'৬ জুলাই ১৯৭১। ফেনীর বটতলী বাজার হয়ে আমরা ভেতরে ঢুকি। তখন তিন থানা মিলে ছিল একটা এলএমজি। প্রত্যেকের কাছে রাশিয়ার সেভেন টু টু রাইফেল আর দুইটা করে গ্রেনেড। জয় বাংলা স্লোগান ছিল আমাদের একমাত্র প্রেরণা। ওই স্লোগানে রক্ত টলমল করতো। নিজ এলাকায় আসাটা ছিল কঠিন। আশপাশের থানার সব মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে আসি। লাইনে লাইনে আমরা। পাহাড়ি পথ। জোকে ধরেছে অনেককে। পাহাড় থেকে পড়ে জখমও হয় কয়েকজনের। পানির জন্য কলাগাছের ছালও চিবিয়ে খেয়েছি। এভাবে আসি ফটিকছড়ি। এক এক থানা পাড় হই আর ওই থানার একেকটা দল রয়ে যায়। সীতাকুণ্ড মিরেরশরাই, হাটহাজারিতে রেখে আসি দলগুলোকে। রাউজানে ছিলাম আমরা দশজন– আমি, সালেহ আহমেদ, সীতাকুন্ডের হাবীব, ফটিকছড়ির দিদার, নোয়াখালির নারায়ন, ফরিদ প্রমুখ। আমাদের কমান্ড করতেন সালেহ আহমেদ। গেরিলা ছিলাম। নির্দেশ ছিল কিল করবা কিন্তু বেঁচে থাকতে হবে। যেখানে শক্রুকে মারবা, সেখান থেকে দুই মাইল দূরে লাশ ফেলে আসবা। সেভাবেই অপারেশন করি এক নম্বর সেক্টরের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায়।'

একাত্তরে কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সেটি যাচাই করাটাও ছিল কঠিন বিষয়। তেমনি একটি ঘটনার কথা জানান মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর। তিনি বলেন–'ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ছিলেন স্বপন চৌধুরী। তিনি বিএলএফ এর উত্তরের কমান্ডার হয়ে আসছেন। সূর্য নামে এক চাকমা আমাদের সঙ্গে ছিল। ও যে রাজাকার তা বুঝতে পারিনি। মাঝেরপাড়া এলাকার চাকমা পাড়ায় পাহাড়ের ওপর আমরা অ্যাম্বুস করে বসে আছি। স্বপন চৌধুরী আসলেই আমরা রিসিভ করব। রাত তখন তিনটা। হঠাৎ ফায়ারের শব্দ। ওপর থেকে দেখলাম স্বপন চৌধুরীকে আর্মিরা ধরে টর্চার করে নিয়ে যাচ্ছে। রাজাকার সূর্য সব খবর দিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনাদের।
আমরাও ক্ষিপ্ত হলাম। সে রাতেই এক্সপ্লোসিভ ফিট করে মানিকছড়ি ব্রিজের অর্ধেক ভেঙে দিই। ডেটনেটর ফিট করে দূরে গিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। ওদের একটা গাড়ি আসলেই বিস্ফোরণ ঘটাব। কিন্তু এক্সপ্লোসিভ কম থাকায় বিষ্ফোরণে ব্রিজের অর্ধেকটা ভেঙে যায়। ওরা তখন তক্তা বিছিয়ে চলাচল করে। এর একদিন পরেই আমরা রাণীরহাট ব্রিজটি উড়িয়ে দিই। ফলে চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙামাটির যোগযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
ওদের ঘুম আমরা হারাম করে দিয়েছিলাম। ডিসেম্বরে এফএফরা (ফ্রিডম ফাইটার) চলে আসলে আমরা আরও শক্তিশালী হই। তখন রাঙ্গুনিয়া থানা অপারেশন করি এবং সাতদিন আগেই রাঙ্গুনিয়া স্বাধীন করে মোগলেরহাটে ফ্ল্যাগ উড়াই।'
স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের ভূমিকাও কম ছিল না। মোগলেরহাট এলাকায় মালতি দাস নামে অসম সাহসী এক বিধবা ছিলেন। তার পরিবারের সবাই পালিয়ে গিয়েছিল ইন্ডিয়াতে। ঘরে ছিল মাঝ বয়সী আরও দুই নারী। তাদের একটা মাটির গুদাম ঘরে আশ্রয় নেয় আবু জাফরের দল। পরিচয় জানতেই চোখের দিকে তাকিয়ে ওই বিধবা বলেন– 'তোমরা এখানেই থাক। এমনিতেই তো মরছি আমার। তোমাদের সাথেই না হয় মরব।' খাবার দিয়ে নানা খবর দিয়ে ওই বিধবা অনেকদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন।'
একাত্তরে রাজাকারদের কাজ কী ছিল?
আবু জাফর বলেন–'ওরা নারীদের পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসত। বাড়ি বাড়ি লুটপাট করত। আর্মিদের রাস্তাঘাট চিনিয়ে নিত। আমাদের এখানে সব রাজাকাররা ছিল সাকা চৌধুরীর প্রডাকশন। আমরাতো ওদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছি।'
কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়– '১৯৭২-১৯৭৩ সালে এ তালিকা চূড়ান্ত করলে ভাল হতো। ভারতের তালিকাসহ অনেক তালিকাই তখন ছিল। থানায় থানায় ছিল রাজাকারদের তালিকাও। জিয়ার আমলে ম্যাকসিমাম তালিকা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ওই সময় অনেক অমুক্তিযোদ্ধাও ঢুকেছে। ওরা ঢাকা থেকে ভুয়া তালিকা নিয়ে আসছে। রাউজানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে ১১৩জন। আমরা তাদের বাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু হাইকোর্ট তাদের বহাল রেখেছে। জিয়া ও বিএনপি-জামায়াতের আমলে আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্যই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বির্তকিত করা হয়েছে।'
সাত চল্লিশ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?
তিনি বলেন–এর জন্য শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই দায়ী নন। সুবিধাপন্থী আওয়ামী লীগের নেতারাও দায়ী। তবে এ উপজেলার এমপি সাহেব সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি এ বিষয়ে ইন্টাফেয়ার করেন নি। তাই নতুন মুক্তিযোদ্ধা এখানে বেড়েছে মাত্র ৫জন। আল্লাহকে হাজির নাজির করে বলতে পারি এককাপ চাও খাই নাই কারো কাছ থেকে। অথচ সারা দেশে চলেছে টাকার ছড়াছড়ি। এগুলো নিয়ে যত বাড়াবাড়ি করবেন, তত বাড়বে। আমরা চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি। মুক্তিযোদ্ধারা তো মরেই যাচ্ছে। তাদের যাওয়ার পালা চলছে। কিন্তু এখনও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লোভ-লালসা থাকবে? তাদের বিচারও আল্লাহ করবে।'
ক্লাস টেন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এই বীর যোদ্ধা। বর্তমান আওয়ামী লীগ নিয়ে তাঁর মূল্যায়নটি এমন– 'আগে শুধু দেশ, জাতি, আদর্শ, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি বিশ্বাস করে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি আমরা। এখন মানুষ বেড়েছে। একেক মানুষের একেক চরিত্র। ভুরি ভুরি নেতা। কাকে ঠেকাবেন। ছাত্র সংগঠনে হাইব্রিড ঢুকেছে। তারা চরিত্রহীন। এখন আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগই ঠেকাচ্ছে। আমি যদি একবার এমপি হয়ে যাই তবে আপনি হতে পারবেন না। তাই আপনাকে ঠেকাতে হবে। এটা কি দলের প্রতি ভালবাসা হলো? যদি নিজেদের গ্রুপিং না থাকে। সবাই যদি ঠিকভাবে ভোট দেয় তবে আর কোন দল লাগবে না। দলের মধ্যে আত্মশুদ্ধির খুব দরকার। শেখ হাসিনা আছে বলেই আওয়ামী লীগ টিকে আছে। কিন্তু তিনি তো একা একজন। নিচের দিকের নেতাদের কোটি টাকা দিলেই সততা রাখতে পারেন না। রাজাকারের ছেলেও এখন নমিনেশন পায়। সাতকানিয়ায় নমিনেশন যাকে দিল সে সরাসারি জামায়াতের লোক। কীভাবে হলো? সব কথা কি শেখ হাসিনার কাছে যাচ্ছে?'
হেফাজতে ইসলামকে সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরী। তাঁর ভাষায়– 'এটা মানে কিন্তু রাজাকারের সাথে সম্পর্ক থাকা না। আমার যদি পড়ার অধিকার থাকে তাহলে হেফাজতের ছেলেমেয়েদেরও পড়ার অধিকার থাকবে। সরকার তাদের পড়াশোনার সুযোগ আর চাকরির ব্যবস্থা করেছে। এটা তো অন্যায় কিছু না। বরং সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলো। সময় দেন। দেখবেন হেফাজতও ভাল হবে। তা না হলে সরকারই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।'
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাললাগা অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই যোদ্ধা বলেন–'যেদিন যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হয়েছে সেদিন বুকের ভেতর থেকে যেন একটা কষ্টের পাথর নেমে গিয়েছে। এখন মরেও শান্তি পাব।'
খারাপ লাগে কখন?
যখন দুর্নীতি, অসততা আর স্বার্থপরতা দেখি। তখন খুব খারাপ লাগে। এর জন্য তো দেশ স্বাধীন করিনি। দেশের জন্য, মাটির জন্য, মায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হবে। কেউ খাবে কেউ খাবে না–এটা না হোক। সবার জন্য সুন্দর বাংলা, সবার জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি, সবার অধিকার বাস্তবায়ন হবে। তবে শেখ হাসিনা থাকলে আমরা একদিন অবশ্যই সে দেশ পাব।
পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরেই দেশটা একদিন সোনার বাংলা হবে–এমনটাই বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরীর। চোখে মুখে আশার আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন–'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর অর্জনগুলোকে তোমরা ধরে রেখ। ভালভাবে পড়ালেখা করো। যদি অসুন্দর মানুষ হও তবে তো সুন্দরকে চিনবে না। তাই নিজেকে সৎ ও সুন্দর করে গড়ে তোল। তোমরা আদর্শবান হলেই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে। আমরা তখন থাকব না। কিন্তু আমাদের আত্মা তোমাদের জন্য দোয়া করবে।'
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরী।
ট্রেনিং নেন : ৪৫ দিনের ট্রেনিং নেন আসামের লোয়ারবন হাফলং ক্যাম্পে। বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) এর প্রথম ব্যাচের যোদ্ধা ছিলেন।
যুদ্ধ করেছেন : এক নম্বর সেক্টরের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায়। কমান্ডার ছিলেন সালেহ আহমেদ।
ছবি ও ভিডিও : মনিরুল আলম