নারীর প্রতি সহযোগিতার হাত

স্বদেশ রায়
Published : 1 Dec 2011, 06:49 PM
Updated : 20 April 2018, 10:19 AM

এ মুহূর্তে আমেরিকার অনেক পত্রপত্রিকার মতে ট্রাম্পের পরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন, ওপরা উইনফ্রে। আর তিনিই হবেন আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। উইনফ্রে ব্লাক কি হোয়াইট সেটা বড় কথা নয়, বড় হলো তিনি হবেন আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। উইনফ্রে যদি প্রেসিডেন্ট হন তখনও তাকে সেই আমেরিকা চালাতে হবে, যে আমেরিকার বেশ কয়েকটি স্টেট তখনও থাকবে নারীর বেশ কিছু ক্ষেত্রে সমঅধিকারের বাইরে- যা তারা এখনও সাংবিধানিকভাবে স্বাক্ষর করেনি।
ঠিক এই সময়ে যদি আমরা আমাদের দেশের রাজনীতির দিকে তাকাই সেখানেও কি নারীদের একই অবস্থা নয়? আমাদের সব থেকে উদার স্থান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছিল শব্দটি ব্যবহার করছি এ কারণে যে, সেখানে সম্প্রতি যে কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়েছে এই আন্দোলনের অন্যতম মূল নেতা রাশেদ খান মেয়েদের পোশাক ও মেয়েদের বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে তার ফেসবুকে যে অশ্লীল মন্তব্য করেছে তাতে এখন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আগের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাবব কীভাবে? যাহোক, স্বাধীনতার এই ৪৭ বছরে এসে আমরা একবার একটু হিসাব মিলিয়ে দেখি, এই ৪৭ বছরে কি একজনও ডাকসু ভিপি নারী হয়েছেন? হননি। সত্যি অর্থে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কতটুকু? শেখ হাসিনা বাধ্যতামূলক আইন করে লোকাল গভর্মেন্টের ইউনিয়ন পরিষদে নারী মেম্বার কোটা ও উপজেলাতে ভাইস চেয়ারম্যান কোটা করেছেন বলে লোকাল গভর্মেন্টে ওই কোটার ভেতরই নারীর অংশগ্রহণ। এর বাইরে সারাদেশে লোকাল গভর্মেন্টে শতকরা পাঁচ ভাগ চেয়ারম্যান নারী নয়। এ ছাড়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দিকে আমরা যদি তাকাই- সেখানে বাস্তবতা কী? জনগোষ্ঠীর সংখ্যানুপাতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অর্ধেক সদস্য নারী হওয়ার কথা সেখানে কি পাঁচ পার্সেন্ট নারী আছে? নেই। জাতীয় সংসদে সংসদীয় নারী আসনের বাইরে ক'জন নারী নির্বাচিত এমপি? অথচ জনসংখ্যার অনুপাতে নির্বাচিত তিন শ' আসনের ভেতর দেড় শ' আসনে নারী সংসদ সদস্য থাকার কথা? অথচ এই সংখ্যানুপাতে পৃথিবীর কোন দেশে কি আছে? একবারই শুধু এই সংখ্যানুপাতটি কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটেনে টনী ব্লেয়ার। এ ছাড়া সব দেশের পার্লামেন্টের ইতিহাসের দিকে তাকালে কী অবস্থা? এমনকি যে পূর্ব এশীয় দেশগুলো, যেখানে পথে ঘাটে সব খানে দেখা যায় নারীরা কাজ করছে সেখানে জাপানের ডায়েটে কী অবস্থা? কতজন নারী সেখানে? না কোথাও সংখ্যানুপাতের ধারে কাছে নেই। চীনে যেখানে কমিউনিজম এখনও টিকে আছে, সেখানে কি তাদের পার্টিতে নারী নেতৃত্ব সংখ্যানুপাতে আছে? নেই।

আমাদের প্রশাসনে এই মাসখানেক হলো শতাধিক এডিশনাল সেক্রেটারি হয়েছেন। তার ভেতর ক'জন নারী? দশ জনও নেই। অথচ সচিবালয়ে তো দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে অর্ধেক নারী কর্মকর্তা থাকার কথা ছিল? আছে কি? ষোলো সতের ভাগও নেই। বিচার বিভাগে নারী বিচারপতির সংখ্যানুপাত কত? হাইকোর্টে কেন মাত্র হাতেগোনা পাঁচ থেকে সাত জন নারী বিচারপতি। তারপরেও শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পুরুষদের চাপে পড়ে শেখ হাসিনা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি। তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিল তাঁর দেশেই প্রথম প্রধান বিচারপতি একজন নারী হবেন, তিনি তা পারেননি। সবার মন রক্ষা করতে গিয়ে তাঁর নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে আমাদের চিরাচরিত মানসিকতার কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল।

এই মানসিকতার কারণে আমাদের এই স্বল্প শিক্ষিতের দেশে কত সংখ্যক শিক্ষিত নারী শক্তি যে নষ্ট হচ্ছে তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। মনে হয় কোন গ্রহে বাস করি আমরা! ঢাকার প্রতিটি স্কুলের সামনে যান, খোঁজ নিন, দেখতে পাবেন কতসংখ্যক শিক্ষিত নারী কেবল সন্তান লালন পালনের কাজ করছেন। স্বামী সরকারের বড় আমলা বা ভাল ব্যবসায়ী তাই তাদের আর নিজস্ব কোন পেশা বেছে নিতে দেয়া হয়নি। এমনকি অনেককে তার ছোটবেলার শখও জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। ছোটবেলায় যাদের দেখেছি ভাল নাচত, বিটিভিতেও নাচের অনুষ্ঠানে চান্স পেয়েছে, ভাল গাইত তারা এখন আর কেউ গানের চর্চা করে না, নাচে না। অর্থাৎ শখগুলোকে বড় করার স্বাধীনতাও যেন কোন এক অদৃশ্য অস্ত্র দিয়ে কেড়ে নেয়া হয়। আবার একটু ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রসঙ্গে যাই। এটা আমার একান্ত নিজস্ব একটি ধারণার কথা বলি। আরেফিন সিদ্দিকী পর পর দুই টার্ম ভিসি থাকার পরে আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, শেখ হাসিনার সরকার বা রাষ্ট্রপতি এবার দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠটির ভিসি একজন নারীকে করবেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি কোন দিন কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষ শিক্ষকদের কোন্দলের কারণে এমনটি ভাবার সুযোগ তিনি পাননি। অথচ সমাজটি স্বাভাবিকভাবে চললে, শেখ হাসিনার নারী ক্ষমতায়নের প্রতি যে ঝোঁক তাতে হয়ত এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একজন নারী ভিসি পেতেন। এখানেও কি আরও প্রশ্ন আসে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কেন অর্ধেক শিক্ষক নারী নয়?

এই লেখা লিখতে বসেছি রাত দুটোর সময় যেহেতু রাত বারোটায় ক্যালেন্ডারে নতুন তারিখ এসেছে তাই তার আগের দিন অর্থাৎ রাত ৮টার দিকে আমি পত্রিকার লিড নিউজ করেছি যার শিরোনাম 'থেমে নেই বাল্য বিয়ে'। অর্থাৎ এখনও গ্রামে গ্রামে বাল্য বিয়ে। একটি মেয়ে যে একজন মানুষ–এ কথা বুঝতে পারার আগেই তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কেন দেবে না, যে দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রের নেতৃত্বে চলে আসে রাশেদ খানের মতো চরম নারী স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী কূপমণ্ডুকরা সে দেশে বাল্য বিয়ে থামবে কোন্ পথে? আর এখানেই সব থেকে বড় প্রশ্ন–নারী এগিয়ে যাবে কীভাবে? কীভাবে এ সমাজে নারী সমান তালে পা ফেলবে? পরিবারের ভেতরের মানসিকতা হিসাব করলে এখনও শতকরা ৯০ ভাগ পরিবারের মধ্যে নারীকে পাহাড় ডিঙাতে হয়। আর সমাজে নামলে, কোন পেশায় নামলে সেখানে নারীকে ডিঙাতে হয় আরও বেশি উচ্চ পাহাড়। যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক, এই উপমহাদেশের শিক্ষা বিস্তারের পীঠস্থান তার প্রথম উপউপাচার্য ভারতী রায়। তাও তিনি হয়েছিলেন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। পরবর্তীতে তিনি ভারতের রাজ্যসভা সদস্যও হয়েছিলেন। এই ভারতী রায়কেও সংসার ও কাজ মিলিয়ে কম পাহাড় ডিঙাতে হয়নি। এখানে নিজের পড়ার ভেতর দিয়ে পাওয়া একটা উদাহরণ দেই। বাস্তবে এটা কোন গবেষণার জন্য নয়। আমি পড়ি নিজের আনন্দে ও খানিকটা নিজের পাগলামিতে। একেক সময়ে একেক ধরনের বিষয় পড়তে ইচ্ছে করে। পরম হিতাকাঙ্ক্ষী মুনতাসীর মামুন ভাইয়ের সঙ্গে এর কোন কিছু শেয়ার করলে উনি বলেন এগুলো নিয়ে একটা বই লিখতে। কখনও মনে হয় হয়ত লিখে ফেলি। আবার শেষ পর্যন্ত হয় না। যাহোক, এখান থেকে কয়েক বছর আগে প্রায় এক বছর পড়েছিলাম সফল নারীদের আত্মজীবনী। তাদের ভেতর কেউ কমিউনিস্ট নেত্রী, কেউ কংগ্রেস নেত্রী, কেউ আমেরিকার সফল এক্সিকিটিভ, কেউবা সঙ্গীতশিল্পী, কেউ অভিনেত্রী, কেউ এ্যাঙ্কর এমন আর কি। এ ছাড়া মার্গারেট থেচার, ইন্দিরা গান্ধী, মিসেস বন্দরনায়েক, বেনজির, সোনিয়া এদের জীবনী তো আগেই পড়েছি।  তাদের জীবনী পড়তে পড়তে একটি জায়গায় প্রায় সবার ক্ষেত্রে মিল পেয়েছি তা হলো সবাইকে সমাজের এই পাহাড় ডিঙিয়ে, পরিবারের পাহাড় ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছেন বাবা নয় তাদের মা। এমনকি কারও কারও মা ওই অর্থে শিক্ষিতা ছিলেন না তার পরেও সেই মা তাদের পাহাড় ডিঙাতে উৎসাহ যুগিয়েছেন, সব ধরনের সাহায্য করেছেন। তাদের ওই সব লেখার লাইন বিটুইন যেন খুঁজে পাওয়া যায়, সংসারের, সমাজের এই পাহাড়টি না ডিঙিয়ে তাদের মায়েরা সারা জীবন যে কষ্ট পেয়েছেন ওই কষ্ট  যেন তাদের মেয়েরা আর না পায় সে জন্যই তারা তাদের মেয়েদের বলেছেন, এগিয়ে যা, সমাজ সংসারের এই বিধিনিষেধকে তুচ্ছ জ্ঞান কর।

এখন প্রশ্ন হলো,  এই পাহাড় ডিঙিয়ে এগিয়ে আসতে পারেও বা ক'জন। তারপরে মুরগির প্রতি যেমন জিহ্বা বের করে বসে থাকে শিয়ালরা। তেমনি তো নারীর প্রতি জিহ্বা বের করে বসে আছে রাশেদ খানরা। আর তাদের পূর্বসূরিরা তো এদের তেঁতুল বলছেন। শুধু তাই নয়, দেশের অর্থনীতি ধরে রেখেছে যে ৫০ লাখের ওপর মেয়ে, এই গার্মেন্ট শ্রমিকদের যেখানে আমরা শ্রদ্ধা করব, যেখানে প্রতিদিন অন্তত একবার মনে করব এই মেয়েদের, বোনদের, মায়েদের শ্রমে আমাদের দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে- তাদের নামে নানা অনুষ্ঠানে এক শ্রেণীর লোকেরা যে কুৎসিত কথাবার্তা বলে তাতে মাথা হেঁট হয়ে আসে। মনে হয়, এ সমাজের মানুষ আমরা! আসলে কী আমরা মানুষ!

আসলে এখনও আমরা সকলে শতভাগ মানুষ হইনি। তার পরেও একাংশের আছে ডাবল ফেস। সব মিলে নারীদের জন্য এ সমাজ পথ চলা এক দুর্গম যাত্রা। সে যে কী দুর্গম যাত্রা তা আবার তারুণ্যে বসে সঠিক বোঝা যায় না। যেমন চারুকলার একটি মেয়ে আমার অফিসে কাজ করত। আমার ছেলের বয়সী হবে। সে আমাকে দাদা ডাকলেও পিতার মতো ভক্তি করত। শার্ট-প্যান্টই পরত মেয়েটি। শ্যামল গায়ের রং, বাঙালী মাপে তাকে দীর্ঘই বলা যায়। হাসি খুশি মেয়েটিকে অফিসে সকলে আদর করত। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় একদিন গণজাগরণ মঞ্চ থেকে হেঁটে অফিসে আসছে এ সময়ে পরীবাগে বেশ কয়েকটি ছেলে তাকে বলল, সে যেন পোশাক বদলে ফেলে তা না হলে তার অবস্থা রাজীব হায়দারের মতো হবে। মেয়েটি ভয়ার্ত চোখ নিয়ে আমার কাছে এলো। সঙ্গে সঙ্গে আইজি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিষয়টি জানালাম। তাকেও অভয় দিলাম। কিন্তু সে আর বেশি দিন চাকরি করতে পারলো না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। তারপরে একদিন ফোন করে সময় চেয়ে দেখা করতে আসে। তার পোশাক দেখে আমি বিস্মিত হই। বলি, তোমার এ অবস্থা কেন। বলল, তার বিয়ে। সে বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছে। আর যেহেতু এখন তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই এ পোশাক তাকে পরতে হবে। মেয়েটি বিয়ের ইনভাইটেশন কার্ড রেখে চলে যাবার পরেও অনেকক্ষণ কোন কাজ না করে বসে থাকলাম। মনে মনে শুধু ভাবি হোমো সেপিয়ান্সের ইতিহাস ৩ লাখ বছরের। আমাদের কি আরও তিন লাখ বছর অপেক্ষা করতে হবে? আধুনিক সভ্যতার বয়স যদি ৫ হাজার বছর ধরি, তাহলেও কি আরও পাঁচ হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে?

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে যে আন্দোলন হয়ে গেল সেখানে আমার অনেক মেয়েদের দেখেছি, তারা যা বলছে তার অর্থ দাঁড়ায় কেউ তাদের হাত ধরে টেনে তুলক এ তারা চায় না। নিজের যোগ্যতাতেই পৃথিবীতে স্থান করে নিতে চায়। রবীন্দ্রনাথও এমনটি চেয়েছিলেন, নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা! বাস্তব জীবনে রবীন্দ্রনাথের দুই মেয়ে পারেনি তাদের নিজের ভাগ্য জয় করতে। এমনকি তাদের ভাগ্য জয় করতে রবীন্দ্রনাথ সাহায্য করার সুযোগও হারিয়েছিলেন তাদের বিয়ে দেয়ার পরে। কারণ তাদের শ্বশুরবাড়ির রীতিনীতিই তাদের মানতে হতো। রবীন্দ্রনাথের মেয়েদের এ অবস্থা কাটাতে হয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথমে আর এখন একবিংশ শতাব্দীর শুরু। এ উপমহাদেশ খুব বেশি বদলায়নি। তাছাড়া প্রতিটি বিপ্লবে, পরিবর্তনের ইতিহাস ভাল করে পড়লে দেখা যায়, ওই বিপ্লব বা পরিবর্তনে পুরুষের অবস্থানের যা পরিবর্তন হয় নারীর অবস্থানের পরিবর্তন ওই হারে হয় না। সোভিয়েত বিপ্লবেও হয়নি। এক জনও সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নারী হননি, ৭০ বছরের সোভিয়েত ইউনিয়নে। কিউবাতেও কোন ক্ষমতাধর নারীকে দেখা যায়নি।

ইতিহাসের এই শিক্ষা থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে নারীর অবস্থা পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু নানা স্থানে নারীকে হাত ধরে টেনে তোলার ব্যবস্থা রাখেন। শেখ হাসিনা যে ক'বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন তিনি এই কাজ অনেক বেশি করেছেন। যে মা পেটে সন্তান ধারণ করেন, সেই সন্তানের পরিচয়ে মায়ের কোন অধিকার ছিল না। শেখ হাসিনাই প্রথম তাকে সে অধিকার দেন। আমার যে মেয়েরা রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে দাঁড়িয়ে বলছে, নিজ হাতেই নিজের ভাগ্য গড়ব। তাদের কণ্ঠ শুনে আমারও তরুণ বেলার কথা মনে হয়েছে। ওই চত্বরে যখন মিছিল করেছি তখন মনে হতো আসলে এ সমাজ আমি বদলে ফেলবই। আজ যখন প্রৌঢ়ত্বে এসে সংসারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের জগদ্দল পাথরগুলোকে চিনতে শিখেছি, তখন দেখতে পাই এই পাথরগুলো নারীর জন্য কী বিশাল পাহাড় তৈরি করে রেখেছে। এই পাহাড় বা এই খাঁচা যাই বলি না কেন এগুলো দেখে মনে হয় কেবল জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়ার সেই গানটি– এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে? আসলে ওই গানটি কিন্তু শেষ করতে পারেননি কোনদিন গায়ক, আজ মনে হয় এখনও গানটি অসমাপ্তই আছে।

তবুও এই পাহাড় ঠেলে, এই খাঁচা পার হয়ে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে।  নারীকে এগোতে হবে। তবে যতদিন আমাদের মনোজগতে নারীর বিরুদ্ধে যে পাহাড় আছে যা বয়ে বেড়াচ্ছে বৃদ্ধ থেকে তরুণ রাশেদ অবধি -এই পাহাড় যতদিন সরবে না ততদিন কী নারীর এগিয়ে যাওয়া থেমে থাকবে? এখনও যখন পৃথিবীতে চন্দ্র সূর্য ওঠে তাহলে পৃথিবীতে এখনও কিছু মানুষ আছে তারা অন্তত এগিয়ে আসবেন  যাতে নারীরা এগিয়ে যেতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন নারীর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া। আধুনিক রাষ্ট্রে এই সহায়তার হাতটিকে সব সময়ই আইনের কাঠামোর ভেতর আনতে হবে। সাম্প্রতিক এই আন্দোলনের ফলে আমাদের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার প্রতি বড় ধরনের একটি আঘাত এসেছে। কারণ, রাষ্ট্র যদি হাত না বাড়ায় তাহলে এ সমাজে নারী অগ্রগতি আরো পিছিয়ে যাবে। তাই যেখানে যেখানে রাষ্ট্রের হাত আছে এই হাত যেন রাষ্ট্র গুটিয়ে না নেয় সেটা দেখার দায়িত্ব এখন সমাজের নারী নেতৃত্ব সহ সকল প্রগতিশীল মানুষের। তারুণ্যের উম্মাদনায় আমাদের কোন মেয়ে যদি বলে, না- রাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রয়োজন নেই- আমি বীর হস্তে বরমাল্য নেব- সে বলুক। তার সাহসকে শ্রদ্ধা করা যেতে পারে কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সময় এখনও আসেনি। রাষ্ট্রের সহযোগিতার হাত নারীর প্রতি থাকতেই হবে। রাষ্ট্র যেন কোন ক্রমেই এ হাত গুটিয়ে না নেয়।