কোটা পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্তরা কি অমেধাবী?

কানিজ আকলিমা সুলতানা
Published : 15 April 2018, 06:03 AM
Updated : 15 April 2018, 06:03 AM

এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে একটি ধারণা বিশেষভাবে প্রচারিত হয়েছে যে কোটা পদ্ধতির নিয়োগের ফলে সরকারি চাকরিতে মেধাহীনরা ঢুকে পড়ছে ফলে প্রশাসন মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। অনেকেই মনে করেন কোটায় দুর্বল প্রশাসন তৈরি হয়েছে এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের উন্নয়ন ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। পক্ষান্তরে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ জমা হচ্ছে। এর ফলে প্রায় সব মহলই এ অন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। এবারের কোটা সংস্কার দাবির অন্যতম লক্ষ্য ছিল বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিলোপ অথবা একেবারেই কমিয়ে আনা। বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি যেহেতু পুরো কোটার একটি বড় অংশ তাই এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার তৃতীয় প্রজন্মের অমেধাবী প্রার্থীরা ব্যাপক হারে সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই কি কোটা ব্যবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অমেধাবীরা সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়ছে? ব্যাপক এ আলোচনার রেশ ধরে গত ১২ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে চ্যানেল আইয়ের টকশো তৃতীয় মাত্রায় অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও সাবেক পিএসসি-র চেয়ারম্যান ডঃ সাদ'ত হোসাইন কোটা পদ্ধতি, এর প্রয়োগ ও কোটা সুবিধায় নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কোটা প্রয়োগ করা হয় সকল রকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মেধা তালিকার ভিত্তিতে। পরীক্ষায় কোনো কোটা সিস্টেম নেই। প্রার্থীরা প্রিলিমিনারী, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। দুই/আড়াইলাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে কমবেশি পাঁচ হাজার মেধা তালিকায় স্থান পায়। তারপর সেই তালিকা থেকে ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়। তারপর জেলা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও অন্যান্য কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়ে থাকে। অনেক সময় এই মেধা তালিকার একদম নীচের দিক থেকে পালি, উর্দু এমনকি অংক শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয় যদি তালিকার উপরের দিকে শিক্ষক না থাকে।

তিনি বলেন, প্রাথমিক মেধা তালিকায় আসতে সবাইকে পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখেই আসতে হয়। কোটা থাকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে। তবে জেলা কোটার সাথে অন্যান্য কোটার সমন্বয় একটি জটিল প্রক্রিয়া। যেমন কোন জেলায় যদি কোটা বরাদ্দ থাকে দু'জন আর সেই জেলায় তিনজন প্রার্থী মেধা তালিকায় ১,২,৩ নম্বর সিরিয়ালেও থাকে তবে তৃতীয়জন চাকরী পাবেন না। কারণ তৃতীয় জনের আগেই সেই জেলা কোটা পূর্ণ হয়ে গেলে সেই জায়গায় হয়তো ২০০তম মেধাক্রমের কেউ চাকরি পেয়ে যাবেন যদি তার জেলায় কোটা খালি থাকে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার মাধ্যমে প্রশাসনে অমেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এমন প্রচারণার প্রতিবাদ করেন ডঃ সাদ'ত। তিনি বলেন, আড়াইলাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে পাঁচ হাজার যারা উত্তীর্ণ হন তারা অত্যন্ত মেধাবী হিসেবেই মেধা তালিকায় আসেন।

এখানে উল্লেখ্ করা যায় যে, ৩৬তম বিসিএস এর প্রার্থী সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ৩২৬ জন। প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১৩ হাজার ৮৩০ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন মোট ৫ হাজার ৬৩১জন। এ ফলাফলে ২ হাজার ৩২৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ক্যাডারের বাইরে উত্তীর্ণ ৩ হাজার ৩০৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে নন-ক্যাডার হিসাবে পরবর্তীতে মেধার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

উপরোক্ত তথ্যাবলী থেকে এটি স্পষ্ট যে কোটা ব্যবস্থা থাকার পরেও সরকারি চাকরিতে কোনো অমেধাবীর নিয়োগ পাওয়া সম্ভব নয়। বিসিএস কারিগরি কোটায় অর্থাৎ শিক্ষা, চিকিৎসা, পুরোকৌশল ইত্যাদি ক্যাডারের নিয়োগে প্রচুর কোটাভিত্তিক পদ খালি থাকে বিধায় সেসবে সাধারণ মেধাভিত্তিক নিয়োগই দেয়া হয়। গত ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএস এ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি ছিল। পরে এসব পদে নিয়োগ দিতে ৩২তম বিশেষ বিসিএস হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সম্প্রতি কোটা পদ্ধতির এ বিষয়টি সংস্কার ক'রে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হয়েছে। ৩৩ তম তে মেধাভিত্তিক ৭৭%+, ৩৫ তমতে মেধাভিত্তিক ৬৭%+ ও ৩৬ তমতে মেধাভিত্তিক ৭০%+ নিয়োগ হয়।

কোটা সংস্কারের দাবিতে গত কয়েকদিন যে আন্দোলন হয়েছে সেই সময়টাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন টকশোতে আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর মতামত এসেছে। কেউ কেউ কোটা পদ্ধতি বাতিল চাইলেও অধিকাংশই কোটা কমিয়ে আনার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিপরীতে প্রচুর অসন্মানজনক উচ্চারণ শোনা গেছে। এটি জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধায় অমেধাবীরাই প্রশাসনে নিয়োগ পাচ্ছে। আন্দোলনের ফেস্টুন ব্যানারে 'মুক্তিযোদ্ধার নাতি পুতি কোটা বাতিল কর' বা শ্লোগান হয়েছে 'গর্ধভ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চেয়ে মেধাবী রাজাকারও ভালো'।

যদিও মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রতি ক্ষোভ বেশি তবে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থায় মেধাবীরা সবচাইতে বেশি বঞ্চিত হয় জেলা কোটার জন্য। বর্তমান কোটা ব্যবস্থায় জনসংখ্যার উপর নির্ভর করে কোটা বরাদ্দ হয়। ফলে যে জেলায় জনসংখ্যা বেশি, সেই জেলা থেকে লোক নেওয়া হয়। কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকার একজন প্রার্থী ভালো করলেও বাদ পড়ে যান। এছাড়া ১৯ টি জেলা থাকাকালীন জেলা কোটা চালু হয়েছিল। এখন জেলা ৬৪টি। অথচ কোনো কোনো নিয়োগে এত সংখ্যক পদই থাকেনা। জেলা কোটা ব্যবস্থা জটিল হওয়ায় এর অপব্যবহার হয় বেশি। এখানে দুর্নীতিরও সুযোগ থাকে বেশি। এবারের আন্দোলনে আন্দোলনকারীরা বর্তমান কোটার বরাদ্দ ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এর বন্টন কিভাবে হবে সে বিষয়ে তারা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যে ৫৬ শতাংশ কোটার কথা বলা আছে এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা রয়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবিমতে এই কোটাকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনলে পাঁচ ধরনের কোটার জন্য জেলা পর্যায়ে প্রার্থী বরাদ্দ ভগ্নাংশে হবে মানে বরাদ্দ এক এর কম হবে। মানুষ যেহেতু ভগ্নাংশে ভাগ করা যাবেনা তাতে কোটা থাকলেও সেটা হবে শুভংকরের ফাঁকি, কেউ নিয়োগ পাবেনা। পাঁচ ধরণের কোটার মধ্যে ১০ শতাংশ ভাগ করে দেয়ার মত সংস্কার হলে কোটা থাকা না থাকার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকেনা বরং হিসেবের জটিলতার ফাঁকে কিছু দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে।

সময়ের প্রয়োজনে বন্টন ও প্রয়োগ সুবিন্যস্ত করার লক্ষ্যে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার হওয়া দরকার ছিল। জেলা কোটার জটিলতা থেকে কিভাবে মেধাবীরা সুবিধা পাবে সেটা নিয়ে কাজ করা দরকার ছিল এবং কোটা কমিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনা দরকার ছিল যাতে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের শ্লোগান, 'কাউকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া নয়'-এর উপর ভিত্তি করে উন্নয়ন কর্মকান্ড এগিয়ে নেয়া যায়।

দিনশেষে এই আন্দোলন থেকে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার হয়েছে যে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনকারীদের স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না ফলে কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের তারা অমেধাবী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সমাজের নানা স্তরের সুবিধার কথা না ভেবেই ১০ শতাংশ কোটা রাখার জন্য দাবি জানিয়েছে এবং এমন একটি জটিল বিষয়ের হিসেবনিকেশের কথা মাথায় না রেখে দাবি মানার সময়সীমা সাতদিনে বেঁধে দিয়েছে। এ আন্দোলনের সবচাইতে গ্লানিকর দিক ছিল, তারা দেশের সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটুক্তি করেছে।