স্যারের কথা মনে পড়ে

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 14 April 2018, 02:57 PM
Updated : 14 April 2018, 02:57 PM

কতদিন থেকে তিনি আর টেলিফোন করেন না। আমার কোনো লেখা পড়ে তার প্রতিক্রিয়া জানান না। বলেন না, চিনতে পারছেন, আমি মোজাফফর, কুঁড়েঘর। অথবা আমার নাম মোজাফফর আহমদে নূরী, আমি পথে পথে ঘুরি। হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক প্রবাদপ্রতিম নাম অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ নিজেকে এভাবেই পরিচিত করতেন। তিনি কথা বলতেন কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবে। কখনো থাকতো প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালি। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সংক্ষেপে ন্যাপের সভাপতি। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ১৯৭৩ সালে ঢাকা আসার পর। আমি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে কখনো সংশ্লিষ্ট ছিলাম না। কিন্তু তার কথা শোনার জন্য মাঝে মাঝে তার কাকরাইলের বাসায় কিংবা তোপখানা রোডে ন্যাপ অফিসে গিয়েছি।

আমি ছাত্র ইউনিয়ন করি, কমিউনিস্ট কর্মী সেটা তিনি জানতেন। তারপরও আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখায় তিনি আমাকে একটু বাড়তি স্নেহ করতেন। বলতেন, তোমরা আমার অফিসের ( তোপখানা রোড) সামনে দিয়া সিপিবি অফিসে ( পুরানা পল্টন) যাও। এখানে নাইমা একটু জিরাইয়া, একটু চা-বিস্কুটও তো খাইয়া যাইতে পারো। আমি যেতাম বলে তিনি খুশি হতেন। তারপর তিনি যখন জানতে পারেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের এলাকায় আমার বাড়ি, তখন বলতেন, তুমি তো আমার ডা. মালেকেরও এলাকার লোক। তাহলে সে- অফিস এ-অফিস মিলিয়ে যাতায়াত থাকলে দোষের কি!

বলা প্রয়োজন যে, ডা. আব্দুল মালেক ঠাকুরগাঁয়ে ন্যাপের একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। আমাকে তিনিও খুবই স্নেহ করতেন। তিনিই আমাকে স্যারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মালেক ভাই পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে ঢাকা চলে আসেন এবং অধ্যাপক সাহেবের বাসায়ই তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। যদিও ঢাকা পরিচয়, কিন্তু অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে আমি প্রথম দেখি ঠাকুরগাঁয়ে। ১৯৭০ সালে ন্যাপের এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তিনি ঠাকুরগাঁ গিয়েছিলেন। ওই জনসভায় মতিয়া চৌধুরীকেও প্রথম দেখি এবং তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ ও উজ্জীবিত হই। মতিয়া চৌধুরীর 'অগ্নিকন্যা' নামের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিলাম।

দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির আলো ছড়ানো অধ্যাপক মোজাফফর এখন বেঁচে থেকেও রাজীনিতিতে সক্রিয় নেই। তিনি অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন। আজ ১৪ এপ্রিল তিনি ৯৭ বছরে পা রাখবেন। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি অধ্যাপনার পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমে ঢাকা কলেজ এবং তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়িয়েছেন। রাজনীতির প্রয়োজনে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বয়সে তিনি বঙ্গবন্ধুর দুই বছরের ছোট। কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রীতিময়। স্যার মাঝেমাঝে রসিকতা করে বলতেন, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হলে আমি তো জাতির চাচা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের বড়ো অবদান রয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক। ন্যাপ – সিপিবি- ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীরও তিনি অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার যে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল তার সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর। বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। জাতি সংঘেও তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একাধিক বার কারাবরণ করেছেন। আত্মগোপনে থেকেছেন। আত্মগোপনে থাকার সময়কার একটি মজার ঘটনা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে আত্মগোপনকারী বাম নেতারা সাধারণত রাতের বেলা চলাফেরা করতেন। এক রাতে এভাবেই আকস্মিকভাবে অধ্যাপক সাহেবের সঙ্গে দেখা হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মণি সিংহের। দুজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। হঠাৎ তারা লক্ষ করেন দূর থেকে একজন লোক তাদের দিকে আসছে। পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের লোক ভেবে মণি সিংহ আড়ালে যেতে চাইলে অধ্যাপক মোজাফফর বলেন, বড়ো ভাই ( মণি সিংহকে সবাই বড়ো ভাই বলেই ডাকতেন) ওই লোক হয় কমিউনিস্ট, না হয় চোর। এতে রাতে জেগে পাহারা দেওয়া পাকিস্তানি পুলিসের কম্মো নয়। একটু পর তাদের সামনে যিনি আসেন তিনি মোহাম্মদ তোয়াহা, ষাটের দশকের একজন জাঁদরেল কমিউনিস্ট নেতা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ন্যাপকে মনে করা হতো আওয়ামী লীগের পর বড়ো দল। বঙ্গবন্ধুর পরই বড়ো নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ন্যাপ তার রমরমা অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটি প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ন্যাপ, প্রকারান্তরে অধ্যাপক মোজাফফর ব্যর্থ হয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। ভেতরের খবর যারা জানেন, তাদের হয়তো এটাও জানা আছে যে স্বাধীন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে অধ্যাপক মোজাফফরের ভিন্ন মত ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, ন্যাপ হবে মাস পার্টি। সিপিবি এবং ন্যাপের সমান্তরাল বেড়ে ওঠার পক্ষে তিনি ছিলেন না।

বাকশাল গঠন, বাকশালের কমিটিতে তার নিজের ও দলের অবস্থানও তাকে হয়তো খুশি করতে পারেনি। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় বামপন্থিদের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন আদায় করা সম্ভব নয় বলেও হয়তো তিনি মনে করতেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম যে একটি বড়ো উপাদান হয়ে দেখা দেবে এটা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ উপলব্ধি করেছিলেন। আর সেজন্য তিনি স্লোগান তুলেছিলেন 'ধর্ম, কর্ম, গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্র'। তার এই ধারণা তখন খুব প্রশংসিত হয়নি।

১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি ন্যাপ-সিপিবি ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
রাজনীতি, বিশেষত সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তিনি একাধিক বই লিখেছেন। সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ নামে একটি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে দুই বছর আগে সরকার স্বাধীনতা পদক দিতে চেয়েছিল। তিনি সবিনয়ে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। জীবনে লোভ মোহের কাছে পরাজিত না হয়ে সমাজতন্ত্র তথা গরিব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের যে লক্ষ সামনে রেখে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে একচুলও দূরে সরেননি। আদর্শ ও নীতি ধরে আঁকড়ে আছেন অবিচল। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে  জীবনের শুরু থেকেই শত্রুজ্ঞান করে এসেছেন, এখন জীবন সায়াহ্নে এসেও সেই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মানুষের শোষণমুক্তির স্বপ্ন একদিন না একদিন পূরণ হবে – এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন।

স্যারের জন্মদিনে তাকে অভিনন্দন। তার শতায়ু ও সুস্থ জীবন কামনা করছি।