কোটাবিরোধী আন্দোলন: জিতেছেন হাসিনা, হেরেছে সরকার ও দল

স্বদেশ রায়
Published : 14 April 2018, 05:48 AM
Updated : 14 April 2018, 05:48 AM

কোটাবিরোধী আন্দোলনের বিষয়টি এখন মুখে মুখে। সর্বত্র এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। একজন ফিজিক্যাল ফিটনেস ট্রেনার অতি সহজভাবে বললেন, স্যার এই আন্দোলনের ফলে একটা লাভ হয়েছে। এখন সবাই টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বলতে পারছে। আগে তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বললে, তাদেরকে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী এসব বলা হতো। এখন দেখেন টকশোতে কত জোরের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বলছে। এখন আর রাজকার বললেও লজ্জার কিছু নেই। কারণ, রাজকাররা তো মেধাবী। তাই তাদের পক্ষে এখন অনেকে জোর গলায় কথা বলতে পারছে। তার কথা শুনে চমকে উঠলাম। যেন কানের ভেতর বেজে উঠলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মামুন আর তারেকের ফোনালাপ। তারেক বলছে, যারা আন্দোলন করছে তারা তো মেধাবী। তারেকের কথা, ওই ট্রেনারের কথা সব মিলিয়ে মনে হলো- কী আন্দোলন হলো তাহলে? ছেলে মেয়েরা সাধারণ মানুষের কাছে তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে রাজাকার ও মেধাবীকে সমার্থক শব্দ করে দিলো? বিএনপির এসিসট্যান্ট অর্গানাইজিং সেক্রেটারী শহীদুল ইসলাম বাবুল আন্দোলন চলাকালে মঙ্গলবার ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেন- "জ্যামানা বদল গ্যায়া! যে তরুণ প্রজম্ম কিছুদিন আগে স্লোগান দিতো' রাজাকারের ফাঁসী চাই সেই তরুণ প্রজম্মই আজ বলছে, ' আমিই রাজাকার'।" হাতে ও বুকে 'আমি রাজাকার' লিখে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক ছেলের ছবি ইতোমধ্যে ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে। বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে এই যে মেধাবী ও রাজাকার সমার্থক করার একটা আন্দোলন হলো- এ আন্দোলনে লজ্জা কার? বিএনপি ও জামায়াতের নিশ্চয়ই নয়। কারণ, রাজাকার শব্দ যত প্রিয় হবে দেশে, মুক্তিযুদ্ধকে যত বির্তকিত করা সম্ভব হবে ততই এদের রাজনৈতিক লাভ। তাহলে ক্ষতি হলো কাদের? আন্দোলনের শেষ দিন অর্থাৎ বুধবার নোয়াখালি, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকার গ্রীন ইউনিভারসিটির সামনের রাস্তা- এই পাঁচটি স্থান থেকে স্থানীয় ব্যক্তিরা আমার অফিসের ফোনে ফোন করেন। তারা বলেন, তারা মিছিলের সামনের ভাগে সব থেকে একটিভ দেখছেন চিহ্নিত ছাত্র শিবিরের ছেলেদের। শিবিরের ছেলেদের আর যাই হোক মেধাবী বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ, একজন মেধাবী কখনো কট্টরপন্থী হতে পারে না। কট্টরপন্থী বুদ্ধিতে একজন শয়তান হতে পারে, মেধাবী হতে পারে না। মেধাবীকে অবশ্যই উম্মুক্ত মনের হতে হবে, তা নাহলে সে পৃথিবীর সব ধরনের জ্ঞানের রাজ্যে কীভাবে যাবে? গোলাম আযম শয়তান ব্যক্তি হিসেবে ড. আনিসুজ্জামানের থেকে এক কোটি গুণ বড় তবে সে ড. আনিসুজ্জামানের নখের সমান মেধাবী ছিলো না। তাই মেধাবী অর্থ যখন এখানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সে সময়ে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ, বিশেষ করে যারা এই আন্দোলন করেছে তাদের এখন শান্ত মাথায় একটু ভাবা প্রয়োজন- আসলে তারা কী আন্দোলন, কাদের জন্যে আন্দোলন করলো? বাংলাদেশের ৪৮ থেকে সর্বশেষ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন অবধি সকল আন্দোলন দেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই আন্দোলন দেশকে কোথায় নিলো তা এখন শান্ত মাথায় আন্দোলনকারী ছাত্র ছাত্রীদের একটু ভেবে দেখা দরকার। তাদের চিন্তা করা দরকার, সাধারণ মানুষ বলছে- এই আন্দোলনের বড় লাভ হলো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে টক শো তে জোর গলায় কথা বলতে পারছে। এখন আর রাজাকার কোন দোষের শব্দ নয়। আশা করি আন্দোলনের মাঠে যারা এসেছিলো সেসব ছাত্র ছাত্রীরা এখন শান্ত মাথায় টেবিলে বসে বিষয়টি ভেবে দেখবে।

তবে আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সরকারের যে সব দুর্বলতার দিক  ফুটে উঠেছে তার ভেতর সব থেকে বড় হলো, সরকারের পক্ষে সাইবার যোদ্ধা নেই। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনের সময় সেখানে বেশ বড় একটি সাইবার যোদ্ধা দল গড়ে উঠেছিলো। তারা প্রতি মুহূর্তে ওই সময়ে ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক মাধ্যমের অপপ্রচারের জবাব দেয়। তারা অপপ্রচারকারীদের সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে। এবারের এই তথাকথিত 'মেধাবীদের' যে আন্দোলনটি হলো তার বড় একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব। সরকার পক্ষের বা ছাত্রলীগসহ অনান্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণদেরকে ওই ভাবে সাইবার যোদ্ধা হিসেবে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ ভবিষ্যতের জন্যেও। কারণ, জামায়াত ও বিএনপি সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে ফায়দা লুঠছে সেই সাঈদীর রায়ের পর থেকে। সরকারের উচিত ছিলো তার প্রশাসন বিশেষ করে আইটি মন্ত্রনালয় ও বিটিআরসি যেন দিন রাত ২৪ ঘন্টা সজাগ থাকে সে ব্যবস্থা করা। তাদের সে উদ্যোগ এ আন্দোলনের সময় দেখা যায়নি। যে আইডিগুলো থেকে এই গুজব ছড়ানো হচ্ছিলো সেগুলো কি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেয়া সম্ভব ছিলো না? এই কাজ রেগুলেটারি বডি করেনি। আর প্রথম দিন রাতে যখন গুজব ছড়ানো হলো একজন মারা গেছে তখনই কি সরকারের উচিত ছিলো না এগুলো সার্বক্ষণিক মনিটর করার নির্দেশ দেয়া। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

দ্বিতীয় দিন রাতে গুজব ছড়ানো হলো এশাকে কেন্দ্র করে। এশাকে কেন্দ্র করে যে ন্যাক্কারজনক ও অমানবিক ঘটনা ঘটিয়েছে আন্দোলনকারীরা তার নিন্দার কোন ভাষা নেই। তবে যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিবির নেতৃত্ব দিয়েছে সেখানে নারীর প্রতি এ সহিংসতা স্বাভাবিক। তবে এশা ও ভিসির বাড়ি ভাংচুরের ঘটনার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের অসহায়ত্ব বেরিয়ে এসেছে। এ সময়ে অনেক বেশি অভাব বোধ হয়েছে নাজমুলের। ছাত্রলীগের এই সাবেক জেনারেল সেক্রেটারী ছেলেটির দুর্বার সাহস ও নেতৃত্ব দেখেছি হেফাজতের তাণ্ডবের দিনেও । সেদিনও সে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও গণজাগরণ মঞ্চকে হেফাজতের তাণ্ডব থেকে রক্ষা করেছিলো। নাজমুলের মত সাহসী নেতৃত্ব এ মুহূর্তে ছাত্রলীগে থাকলে ওই রাতে আন্দোলনকারীরা ওইভাবে ভিসির বাড়িতে হামলা করতে পারতো না। তাদের সামনে ছাত্রলীগ নিশ্চয়ই নাজমুলের নেতৃত্বে অসহায় থাকতো না বরং যেভাবে হেফাজত পিটিয়ে শাহবাগ থেকে বের করে দিয়েছিলো ঠিক একই ভাবে সেদিন ভিসির বাসায় আসা ওই মুখোশ পরাদের মুখোশ নাজমুল খুলে দিতে পারতো হয়তো। কারণ, নাজমুলের অন্তর থেকে একটা প্রকৃত ঘৃণা আছে জামায়াত, শিবির ও বিএনপিসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি। আর ভিসির বাসায় হামলাকারীদের প্রতিহত করতে পারলে, তাদের মুখোশ খুলে দিতে পারলে পরের দিন ইতিহাস ভিন্ন হতো। নাজমুলের মত আরেকজনের অভাব মনে হয়েছে এই আন্দোলনের সময়, তিনি সৈয়দ আশরাফ। তিনি যদি আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী থাকতেন, তাহলে ভিসির বাসায় ওই হামলার পরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও সৈয়দ আশরাফের মাথায় থাকতো এদের ভেতর শিবির ও ছাত্রদল আছে। তাঁর মাথায় থাকতো শিবির ও ছাত্রদলের সদস্যরা রাজাকার ও আলবদরের সন্তান। যেমন হেফাজতের সময় তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, এরা রাজাকার ও আলবদরের সন্তান। তাই সৈয়দ আশরাফ বুঝতেন, যেখানে মূল খেলাটি খেলছে জামায়াত- শিবির ও বিএনপি ও তাদের গডফাদার তারেক রহমান সেখানে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কতটুকু ফল হবে আর ঘি কোন আঙুলে কীভাবে তুলতে হবে। তাহলে শেখ হাসিনা সেই ভাবে প্রস্তুতি নিতেন। আর যাই হোক, ওবায়দুল কাদেরের ভেতর সৈয়দ আশারাফের মত জামায়াত শিবির বা স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ওই মাপের ঘৃণা নেই। বরং তিনি একটু প্রথম আলো মার্কা বুদ্ধিজীবী চরিত্রের। তা না হলে স্বাধীনতাবিরোধী সিনহাকে ঘিরে যখন কয়েক সম্পাদক, কয়েক আইনজীবী ও কয়েক ব্যবসায়ী মিলে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত করতে যাচেছ, শেখ হাসিনার সরকারকে অবৈধ ঘোষণার সকল ষড়যন্ত্র যখন পরিণতির দিকে, শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানের নওয়াজ শরীফ বানানোর সব ছক যখন পরিণত হতে চলেছে- সে সময়ে তিনি সিনহার সঙ্গে দেখা করতে যান। তাই তার পক্ষে শিবির ও ছাত্রদলের প্রতি ওই ঘৃণা জাগ্রত করা সম্ভব নয়। আর শত্রুর প্রতি ঘৃণা জাগ্রত না হলে প্রকৃত সিদ্ধান্ত নেয়া বা শক্রর চরিত্র চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। এ কারণে  ছাত্রলীগের মত এখানেও ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগও পরাজিত হয়েছে। তিনি যাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তাদের সকলকে তিনি চিনতে পারেননি। তাদের চোখের ভাষাও পড়তে পারেননি। এমনকি তিনি বুঝতেও পারেননি, যারা এভাবে ভিসির বাসায় আক্রমন চালিয়েছে তাদের সঙ্গে শুধু সাধারণ ছাত্ররা নেই- আরো অনেক চক্র আছে। এগুলো মাথায় রেখে আলোচনা চালাতে হতো তাঁর। তিনি মনে করেছিলেন, শুধু তাঁর যাত্রার ঢংয়ের নাটকীয়তা দিয়েই বাজিমাৎ করবেন। জামায়ত ও পাকিস্তানের আই এস আই এর পরিকল্পনাকে এত সহজ মনে করলে কি আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারীর পদ চালানো যায়?

যাহোক, সমস্ত বিষ কন্ঠে নিয়ে দেশ ও দলকে রক্ষা করার ক্ষমতা শেখ হাসিনার আছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, সমস্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি একাই লড়তে পারেন। এবং অন্যের কাছে যা পাহাড়সম ভারী তার কাছে সেটা পাখির পালক। অনেকে এখন বলছেন, শেখ হাসিনা ক্ষোভ থেকে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শেখ হাসিনার মত পরিণত নেতা কখনই ক্ষোভ থেকে সিদ্ধান্ত নেন না। যারা মনে করছেন তিনি ক্ষোভ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা তাকে বুঝতে ভুল করেছেন। বরং তিনি যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তেমনি জনগণকেও সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দিয়ে গেছেন এ সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে। জনগন যদি তাদের দ্বায়িত্ব পালন করতে পারে, দেশের সব অঞ্চলের ছেলেদের যদি এখন উপলব্দি হয়- কোনটা তাদের জন্যে ভালো তারা তাদের মত করে আবার শেখ হাসিনার কাছে আসতে পারে। সে পথও খোলা রেখেছেন তিনি। তাই এই আন্দোলনে মেধাবীরা এখানে রাজাকার শব্দের ভেতর হারিয়ে গেছে, সরকার ও দল হেরে গেছে দূরদৃষ্টি ও সাহসের অভাবে। আর শেখ হাসিনা জয়লাভ করেছেন তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে।