কোটা নিয়ে কয়েক ফোটা

সৌরিন দত্ত
Published : 11 April 2018, 12:02 PM
Updated : 11 April 2018, 12:02 PM

১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ সন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশবন্ধু কলেজের ছাত্র রাজীব গোস্বামী গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহননের চেষ্টা করেছিল মন্ডল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন চেষ্টার প্রতিবাদে। ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন ভিপি সিং-এর জোট সরকার। কম্যুনিস্ট থেকে বর্ণবাদী, হিন্দুত্ববাদী এমনকি আঞ্চলিক দল – মশলামুড়ির ভিপি সিং সরকারের জোটে ছিলনা এমন কেউ নেই। কাজেই ক্ষমতার কোন সমীকরণে তিনি ১৯৮০ সালের মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে গিয়েছিলেন তা হয়তো রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ব্যাপার কিন্তু তার পরিণতিতে সারা ভারত জুড়ে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল তা সহজে নেভেনি। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল অশোক কুমার ঠাকুর বনাম ভারত প্রজাতন্ত্র নামে একটি জনস্বার্থ মামলায়। আর তারপরে আসে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের সেই যুগান্তকারী রায়- "সংরক্ষণ কোন স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। সংরক্ষণের নামে আসলে সংরক্ষিতকে আরো পশ্চাতে ঠেলে দেয়া হয়"' তারপরেও জাতপাত এবং ব্যাপক আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের প্রেক্ষিতে ভারতের শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা।

পাকিস্তান তো এ বিষয়ে আরেক কাঠি সরেস-পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে মেধা ও যোগ্যতার বিচারে মাত্র ৭.৫ ভাগ লোক চাকরী পায়। তেলা মাথায় তেলের মত পাকিস্তানের সবচেয়ে অগ্রসর জনগোষ্ঠী পাঞ্জাবীদের জন্য ৫০% সংরক্ষিত।
সম্প্রতি ঢাকায় ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবীতে। কোটা মানেই জনগোষ্ঠীর কিছু অংশকে বিশেষ সুবিধা দেয়া আর সেই সাথে যোগ্যদের জায়গা কিছুটা সংকুচিত হয়ে যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই যোগ্যদের মনে অসন্তোষ দানা বাধে। প্রাক-৭১, পশ্চিম পাকিস্তানিরা জনসংখ্যার ৫৬.৪ ভাগ হওয়া সত্বেও আমাদের দাবিয়ে রাখতে চাইছিল কোটা দিয়ে। কিন্তু এক মহান পুরুষের এক অঙ্গুলি হেলনেই বিফল হয়ে গেছে তাদের কুটকৌশল। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলোর একটি ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য। আর তাই স্বাধীন দেশের ঊষালগ্নে কোটার মাধ্যমে দেশের অনগ্রসর এবং পশ্চাদপদ মানবগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেয়া ছিল আমাদের কর্তব্য। বলাবাহুল্য আমরা এই ছোট ভূখন্ডের মানুষগুলিকে এক কাতারে নিয়ে আসতে প্রতিবেশী দেশগুলোর চাইতে অনেক বেশী সফল। কিন্তু জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র অংশকে ব্যাপক বিশেষ সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে কি আমাদেরকে সেই পুরানো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে হবে না? পাঠক, কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা নয় , তার সংস্কারই আমাদের সবার চাওয়া যদি হয় তবে সেই কোটা কি জনসংখ্যার অনুপাতে হওয়া উচিত নয়? পৃথিবীর সব দেশেই কোটা অনুন্নত এবং অনগ্রসর জাতি বা নৃগোষ্ঠীর জন্য। ত্রিশ লক্ষ শহীদ হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যদিও সনদধারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মোট বর্তমান জনসংখ্যার দুভাগও নন। তাঁদের পোষ্যদের জন্য ত্রিশ ভাগ কোটা কি একটু বেশী হয়ে যায় না? মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তান এবং তাদের অবদানকে আমরা চিরকাল মনে রাখব। শুধু মনেই রাখব না , আমাদের আচার কর্মে আমরা তা দেখাব। তবে তাঁদের পোষ্যদের জন্য কোটা একটু কমিয়ে দিলে, যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁরা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন সেই নির্ভীক মানুষদের প্রতি আমাদের যোগ্য সম্মান দেখানো হবে। আর যদি আমরা তা না করি তবে প্রতি বছর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানোর যে ভাইরাস জন্ম নিয়েছে তা আর কমবে না। হয়ত আপনাদের মনে পড়বে এক অতি উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন। আমরা যদি এই সংস্কারটুকু না করি, এই রোগে আগামীতেও অনেকে আক্রান্ত হবেন।

এমন এক সময় ছিল যখন হাওড় অঞ্চল বা দুর্গম চরাঞ্চল থেকে জেলা শহরে আসতেই বেলা শেষ হয়ে যেত। আজ যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন, ঢাকা থেকে দেশের দূরতম প্রান্তেও ১২ ঘন্টায় যাওয়া সম্ভব। আজ দেশের প্রতিটি শিশু সে যে এলাকারই হোক, এখন সে পোলিও টিকার আওতায়। আজকের বাস্তবতায় জেলা কোটা কতটুকু যৌক্তিক?

কিন্তু কোটার সংস্কার চেয়ে যারা আগুন জ্বালায়, দেশের উন্নয়ন কামনায় তাদের কতটুকু সদিচ্ছা আছে আমার তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। এদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস এক চিরভাস্বর ইতিহাস, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই ইতিহাসের পথিকৃত। কিন্ত কোনো আন্দোলনেই কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা বা তার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়নি। নিজের শিক্ষককে মেরে আপনারা আসলেই কি কিছু অর্জন করতে পারবেন? সাধারণ শিক্ষার্থী আর মধ্যরাতে ছাত্রী হলে হামলা হলেই কি আন্দোলন থেমে যাবে ? না কখনো গিয়েছে?
সরকারী সিদ্ধান্তের সুশৃংখল বিরোধিতা করা এবং করতে পারাটাই গনতন্ত্রের সৌন্দর্য। যারা তা বুঝেনা, জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে তাদের আন্দোলনের কতটুকু অধিকার আছে তাও বিবেচ্য বিষয়। আজ যে আগুন জ্বলছে এবং উল্টোপাল্টা কথা বলে যাঁরা সেই আগুনে ঘি ঢালছেন , সেই আগুন কি তাঁরা নেভাতে পারবেন? মনে রাখবেন, নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায়না।