খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যত

স্বদেশ রায়
Published : 10 April 2018, 08:40 AM
Updated : 10 April 2018, 08:40 AM

রাজনীতিতে এ মুহূর্তে সব থেকে আলোচিত প্রশ্ন খালেদা জিয়ার ভবিষ্যত কী হতে যাচ্ছে? শুধু মাত্র যে সাধারণ মানুষের এ প্রশ্ন তা নয়, খালেদার দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় মুসলিম মৌলবাদী জোটের সকল নেতারই একই প্রশ্ন। তাদের অনেকের সঙ্গে নানান ব্যক্তিগত আলোচনায় ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন আসছে, খালেদা কি আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন? কী হতে যাচ্ছে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত?

খালেদা এ মুহূর্তে একটি দুর্নীতি মামলার রায়ে পাঁচ বছর দণ্ডিত হয়ে জেলে। এছাড়া গ্রেফতার দেখানো হয়েছে অন্য একটি মামলায়। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামে রাতের বেলায় একটি বাসে পেট্রোল বোমা ছোড়ার ফলে সাত জন ঘটনাস্থলে পুড়ে কয়লা হয়ে যায়, ২৭ জনকে অর্ধদগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়; তাদের ভেতর ৩ জন হাসপাতালে পৌঁছেই মারা যায়। এই গণহত্যাটির হুকুমের আসামী হিসেবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছিলো তার চার্জশীট হয়ে গেছে। সে মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও গণহত্যার আরো দুটি মামলার চার্জশীট ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। তাই সব মিলে খালেদার দলের অনেকেই এবং তার জোটের প্রায় সকল নেতারা মনে করছেন, আগামী ডিসেম্বরে যে সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে ওই নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি পাবার কোন সম্ভাবনা নেই। দুর্নীতির মামলায় যদিও তিনি জামিন পান তারপরেও অন্য মামলায় গ্রেফতার দেখানোর ফলে তাকে জেলেই থাকতে হবে।

অন্যদিকে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী খালেদার নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পথ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আইন অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী মামলায় কেউ দুই বছর ছয় মাসের বেশি কারাদন্ডে দন্ডিত হলে তিনি তার দণ্ড ভোগ করার সময় ও শেষ হবার পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে আর কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। খালেদার মামলার রায় বিচারিক আদালতে হয়েছে। এখন তার পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে দন্ড স্থগিত চাওয়া হবে। দন্ড স্থগিত হলেও তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে উচ্চ আদালতে দুই ধরনের রায় আছে। একটি রায়ে বলা হয়েছে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। অপরদিকে সর্বশেষ রায়ে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত উচ্চ আদালতের বিচার শেষ হবে ততক্ষণ তিনি দন্ডিত। অর্থাৎ বিচারিক আদালতের রায় বহাল থাকবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশণকে উচ্চ আদালতের সর্বশেষ রায়কে গাইড লাইন হিসেবে ধরতে হবে। সে হিসেবে খালেদার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ থাকে না। তবে তার পরেও খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এখানে উচ্চ আদালতের একটি গাইড লাইন চাওয়ার সুযোগ থেকে যায়। এবং সে সুযোগ তারা নেবে।

আবার ইতোমধ্যে খালেদার জামিনের আবেদন উচ্চ আদালতে করার ভেতর দিয়ে আরেকটি আদেশ এসেছে খালেদার মামলাকে ঘিরে। উচ্চ আদালত যদিও দুর্নীতির মামলায় বয়স ও শরীর বিবেচনা করে খালেদ জিয়াকে চার মাসের জামিন দিয়েছে। ওই জামিনের আদেশের সঙ্গে সঙ্গে ওই আদালত আরো নির্দেশ দিয়েছে যেহেতু খালেদার মামলার বিচারিক আদালতের যাবতীয় নথি উচ্চ আদালতে আনা হয়েছে, তাই এই চার মাসের মধ্যেই মামলার পেপারবুক তৈরি করতে হবে। খালেদার জামিন আবেদন শুনানীর সময় উচ্চ আদালত পনের দিনের মধ্যে সকল নথি তাদের কাছে পাঠাতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দিয়েছিলো। সেই নির্দেশ অনুযায়ীই নথি আসে। এরফলে উচ্চ আদালতে খুব সহজেই চার মাস পরেই খালেদার মামলার শুনানীর দিন ধার্য করার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু উচ্চ আদালতে শুনানী হয় পেপারবুকের ওপর। সেখানে অন্য কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। তাই খালেদার দুর্নীতির মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশণ(দুদক) তখন শুনানীর জন্যে আবেদন করলে উচ্চ আদালত শুনানীতে যাবে। আর সেটা জুলাই মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে হতে পারে। সেখানে খালেদার পক্ষের আইনজীবিরা হয়তো চেষ্টা করবে সময়ক্ষেপনের জন্যে। তারা যেমন সময়ক্ষেপনের চেষ্টা করবে অন্যদিকে দুদক ও সরকার চাইবে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দ্রুত হোক। সব মিলে আগামী অক্টোবর নভেম্বরের আগে এ মামলার নিষ্পত্তি হলেও হতে পারে।

উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে খালেদার দন্ড কমবে না বলেই মনে করেন বেশ কয়েকজন সর্বোচ্চ আদালতের সাবেক বিচারপতি। তাদের বক্তব্য, ওই মামলায় অন্য আসামীদের বিচারিক আদালত দশ বছর জেল দিয়েছে। খালেদার বয়স বিবেচনায় তাকে বিচারিক আদালতই দন্ড কমিয়ে দিয়েছে তাই উচ্চ আদালতে তার আর দন্ড কমার কোন সুযোগ নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সর্বশেষ রায় বা খালেদার মামলার শুনানী শেষ হয়ে যাওয়া- এই দুইকে মাথায় রেখে বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন আগামী নির্বাচনে খালেদার অংশগ্রহণের কোন সুযোগ নেই। অন্যদিকে তাঁর ছেলে তারেক রহমান ফেরারি আসামী। মানি লন্ডারিং এর একটি মামলায় তার সাত বছর জেল আগেই হয়েছে। ওই মামলার আপীলের সময়ও পার হয়ে গেছে। তারা কোন আপীল করেনি। এ কারণে তারেক রহমানের নির্বাচনে অংশগ্রহণের আর কোন সুযোগ নেই। মা ও ছেলে দুই-ই নেতৃত্ব ও নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়ার পর দলটির হাতে থাকে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়াদা রহমান। খালেদা জেলে যাবার আগে তার দলের সর্বশেষ স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিংএ প্রস্তাব এসেছিলো- জোবায়াদাকে স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বর করা হোক। খালেদা তাতে মত দেননি। অন্যদিকে দলটির ঘনিষ্ট সূত্র মতে, জোবায়াদা রাজনীতিতে আসবেন না। তার মায়ের বাড়ির কেউ চাননা তিনি এই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। এমনকি একথাও জানা গেছে জোবায়াদা ও তারেক রহমানের ভেতর মনমালিন্যও হয়েছে তাকে এই রাজনীতিতে আনার টানা হেঁচড়া নিয়ে।

এসব মিলে বাস্তবতা বলছে, আগামী নির্বাচনের আগেই দেশের রাজনীতিতে খালেদা ও তার পরিবারের অস্তিত্ব অনেকটাই সর্বোচ্চ হুমকির মুখে পড়ছে। অন্যদিকে পেট্রোল বোমা মেরে খালেদার নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াত যে মানুষ হত্যা করেছিলো তার বিচার শুরু হয়ে গেছে। এই বিচারের স্বার্থে খালেদার দলের অনেক নেতা হুকুমের আসামী হিসেবে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। এমত অবস্থায় খালেদার নিজস্ব দল ও তারঁ নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় মুসলিম মৌলবাদী জোটের ভবিষ্যত কী? খালেদার অবস্থান অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গেলে তার নিজ দলে এক বা একাধিক ভাঙ্গন আসতে পারে। কারণ, খালেদার দলে তারেক রহমানের অনুরাগী বেশ বড় একটি তরুণ অংশ রয়েছে। তারা চাইবেন না, খালেদা ও তারেক রহমানকে বাইরে রেখে কোন নির্বাচনে যেতে। অন্যদিকে কট্টর তারেক রহমান ও পাকিস্তানী আই এস আই এর অনুগামী একটি তরুণ গ্রুপ মনে করছে, যাই ঘটুক না কেন তাদের নির্বাচনে যাওয়া উচিত। কারণ নির্বাচন ছাড়া অস্তিত্ব বজায় রাখা কঠিন। এছাড়া সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ আলাদা বিএনপি তৈরি করে খালেদার অবর্তমানে নিজেদের একটি অবস্থান তৈরি করার জন্যে নির্বাচনে যেতে পারেন। খালেদার দলের যদি এ অবস্থা হয় তখন তার নেতৃত্বাধীন মুসলিম মৌলবাদী বিশ দলীয় জোটের বাকি উনিশ দলও এক সঙ্গে থাকতে পারবে না। তাদের ভেতর এখনই তিনটি  স্রোত। একটি  স্রোত মনে করে যাই হোক তারা বিএনপির সঙ্গে থাকবে। অন্য আরেকটি গ্রুপ চায় দেশের আরো ইসলামিক দল নিয়ে একটি ইসলামিক মৌলবাদী জোট গড়ে তুলতে। এছাড়া ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি দল ইতোমধ্যে বাংলাদেশের আরেক সামরিক শাসক এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। অপরদিকে বিশ দলীয় জোটে আছে তবে তারা পুরোপুরি ইসলামিক দল নয় এমন দুই একটি দলের নেতাকে গত কয়েকদিনে সরকারের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণীদের বাসায় দেখা গেছে। কর্নেল অলি ইতোমধ্যে বিএনপির প্রতি ঈংগিত করে বলেছেন জোটে তাকে বা তার দলকে সম্মান করা হচ্ছে না।

সব মিলিয়ে এখন দুটো বিষয় দেশের রাজনীতিতে বেশ সামনে চলে এসেছে- এক, খালেদা ও তার পরিবার হয়তো অচিরেই বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়তে যাচ্ছে। দুই, খালেদার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় ইসলামিক মৌলবাদী দল কমপক্ষে তিন টুকরো হতে চলেছে। যদি আগামী কয়েক মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন ভূমিকম্প না হয় তাহলে এমনি ধারাতেই যাবে খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যত। আর এ ঘটনা যদি ঘটে, এ পথে যদি আগামী নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে বাংলাদেশ -তাহলে দেশটির ওপর থেকে পাকিস্তানী সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী আই এস আই এর প্রভাব আরো কমবে। দেশের ছোট বড় ইসলামিক মৌলবাদী দলগুলো আই এস আই এর টাকায় সৃষ্ট বটে তবে গত প্রায় তিন দশক ধরে তাদের মূল স্তম্ভ খালেদা জিয়া। তিনিও তাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পান বলে পাকিস্তানী আদালতেও বলা হয়েছে। তাই রাজনীতির মূল সড়ক থেকে খালেদা জিয়ার এই ছিটকে পড়ার ভেতর দিয়ে আই এস আই'র অনেক শেকড় অনেকখানি উপড়ে যাবে বাংলাদেশ থেকে।