বানানের রাজনীতি

রাখাল রাহারাখাল রাহা
Published : 23 April 2018, 11:08 AM
Updated : 23 April 2018, 11:08 AM

[লেখকের নোট: এই লেখাটায় যে বানান ব্যবহৃত হয়েছে তা বর্তমান বাংলা প্রমিত বানানের সর্বশেষ রূপ নয়। এখানে যেহেতু ১৯৩৬ সালের কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত প্রমিত বানান, ১৯৮৮ সালের এনসিটিবি নির্ধারিত বানান, ১৯৯২ সালের বাংলা একাডেমী (তদানীন্তন বানান) প্রবর্তিত প্রমিত বানান, ২০০৫ সালের এনসিটিবি পরিমার্জিত বানান, ২০১২ সালের বাংলা একাডেমি (বর্তমান বানান) পরিমার্জিত বানানসহ আরো কিছু উদ্যোগের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে, সে-কারণে আমি একটা প্রমিত বানান (এখানে ১৯৩৬ সালের প্রমিত বানান বিকল্পসহ) ব্যবহার করেই লেখাটা লিখেছি। প্রমিত বানান নির্ধারণে সবসময় সর্বক্ষেত্রে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি এবং এর ফলে ভাষা ও বোধের রাজ্যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।  তা তুলে ধরার জন্য এই লেখা।]

১.
এখন আমরা যে-বানানকে প্রমিত বাংলা বানান বলি তার শুরু থেকেই রাজনীতি ছিল। এই রাজনীতিটা করেছিল ১৯৮৮ সালে সে-সময়ের সামরিক সরকার। পরিকল্পনা ও পরামর্শে ছিল আমলা-কর্মকর্তারা। আর কুমিল্লা বার্ডে তিনদিন পিকনিক আমেজে কর্মশালা করে এটা চূড়ান্ত করেছিলেন সে-সময়ের প্রায় সকল বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ।
কি সেই রাজনীতি? রাজনীতিটা হচ্ছে সব শিশুকে স্কুলে নেওয়া ও ঠিকঠিক লেখাপড়া শিখিয়ে বিদ্বান বানানোর জন্য আগে বাংলা ভাষার লিপি ও এর বানানটা 'সহজ' ও 'সমতা' করা দরকার! তা না হলে শীঘ্রই যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন হতে যাচ্ছে, তা ব্যাহত হবে! (বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৯০ সালে পাশ হয়।)
এই রাজনীতি বোঝার জন্য আমরা বাংলা প্রমিত বানান নির্ধারণের ২টি বড়ো পর্বের কর্মপ্রক্রিয়া ও কালপঞ্জীটা দেখে নেবো।

প্রথম পর্ব (১লা আগষ্ট ১৯৩২ — ২০শে মে ১৯৩৭)
১৯৩০ : 'বাংলা টাইপ ও কেস' শিরোনামে প্রবাসী পত্রিকায় অজরচন্দ্র সরকারের প্রবন্ধ প্রকাশ। এখানে তিনি দেখান বাংলা টাইপসংখ্যা ৫৬৩, টাইপ কেসসংখ্যা ৪৫৫, অতিরিক্ত টাইপগুলো একই কেসের মধ্যে তিন-চারটা করে রাখতে হয়, সময়ের অপচয় হয় এবং কম্পোজে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়।
১৯৩২, ১লা আগস্ট : ভাষা অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসাবে ২ বছরের জন্য রবীন্দ্রনাথের কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান, এবং রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বাংলা চলিত বানান প্রমিতকরণের প্রস্তাব।
১৯৩৪ : উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব অনুমোদন, গবেষণা সহকারীর পদ সৃষ্টি, গবেষণা সহকারী হিসাবে বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের যোগদান, এবং তাঁর সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আদর্শ বানান পদ্ধতি নির্ধারণের খসড়া প্রস্তাব প্রদান।
১৯৩৫, ২৬শে সেপ্টেম্বর : সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও রাজশেখর বসু কর্তৃক বাংলা লাইনোটাইপ উদ্ভাবন, লাইনো-তে বাংলা টাইপসংখ্যা ৫৬৩ থেকে কমে হয় ১৭৪, আনন্দবাজার পত্রিকা লাইনোটাইপে ছাপা শুরু।
১৯৩৫, নভেম্বর : কেন্দ্রীয় বানানসংস্কার সমিতি গঠন, সভাপতি রাজশেখর বসু ও সম্পাদক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, সদস্য প্রমথ চৌধুরী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ ১১ জন; সমিতি কর্তৃক রবীন্দ্রনাথের খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ, সমস্যার প্রকৃতি ও পরিমাণ নির্ধারণের জন্য খসড়া প্রস্তাবের উপর আলোচনা করে মতামত গ্রহণের জন্য প্রশ্নমালা তৈরি, সেই প্রশ্নমালা কয়েক শত লেখক-অধ্যাপককে লিখিত মতামত জানানোর জন্য প্রেরণ, প্রায় দুশো জন লেখক-অধ্যাপকের মতামত প্রাপ্তি।
১৯৩৫ : কেন্দ্রীয় পরিভাষা সমিতি গঠন, সভাপতি রাজশেখর বসু ও সম্পাদক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য।
১৯৩৬, ৮ই মে : লিখিত মতামতগুলো পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় বানানসংস্কার সমিতি কর্তৃক 'বাংলা বানানের নিয়ম' পুস্তিকার প্রথম সংস্করণ প্রকাশ। এবং এরপর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এর পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি।
১৯৩৬, অক্টোবর : বানান বিষয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধাদি ও মৌখিক আলোচনায় যেসব মতামত প্রকাশিত হয় সেগুলো বিচার করে 'বাংলা বানানের নিয়ম' পুস্তিকার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ এবং এতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বাক্ষর। এর পরও বিতর্ক অব্যাহত থাকে।
১৯৩৭, ২০শে মে : পত্রপত্রিকা ও আলোচনাসভায় অব্যাহত তর্ক-বিতর্ক পর্যালোচনা করে 'বাংলা বানানের নিয়ম' পুস্তিকার তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ।
লক্ষ্যণীয় যে, বাংলা প্রমিত বানান নির্ধারণের প্রথম পর্বের শুরু এবং শেষের মাঝে প্রায় ৫ বছরের ব্যবধান। অর্থাৎ একটা দীর্ঘ সময় নিয়ে মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এই পর্বে বাংলা বানান প্রমিতকরণের বিধান দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল বিকল্প বানানগুলোও রাখার বিষয়ে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল তারা আস্তে আস্তে এই বানানে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। সুতরাং নম্বার কাটা যাওয়ার বিষয় ছিল না। ফলে বলা যায় কিছু বিতর্ক নিয়েও প্রায় অর্ধশত বছর ধরে বাংলা প্রমিত বানান হিসাবে সেই বানান অনেকটাই গ্রহণীয় ছিল অধিকাংশ মানুষের কাছে। এরপর আমরা বাংলা প্রমিত বানানের দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করি।

দ্বিতীয় পর্ব (২১শে অক্টোবর ১৯৮৮ — ২৩শে অক্টোবর ১৯৮৮)
১৯৮৮ : ১৯৮৮ সালে সামরিক সরকারের কৌশল বাস্তবায়নে আমলাদের পরামর্শে এনসিটিবি'র উদ্যোগে ইউনিসেফের সহায়তায় 'সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পটভূমিতে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতাবিধান-বিষয়ক জাতীয় কর্মশিবির' অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই কর্মশিবির সফল করতে প্রায় শখানেক কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-গবেষককে ৩ দিনের জন্য কুমিল্লায় বার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁরা 'সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা' সফল করতে ৩ দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯৩৬ সালে নির্ধারিত বাংলা বানানের বহু বিধান পরিবর্তন করেন, বহু পরিপূরক বিধান চালু করেন। তাঁরা কারচিহ্ন ও যুক্তবর্ণের অস্পষ্ট রূপকে যথাসম্ভব বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটা করতে গিয়ে তাঁরা ব্যঞ্জনের সাথে কারচিহ্ন যুক্ত হওয়া ৬টি টাইপ এবং ব্যঞ্জনের সাথে ব্যঞ্জন ও তার সাথে কারচিহ্ন যুক্ত হওয়া ৩৬টি যুক্তবর্ণের টাইপ অর্থাৎ মোট ৪২টি টাইপের রূপ পরিবর্তন করেন। এই ৪২টি টাইপ ব্যবহার করতে হয় বাংলা ভাষায় এমন শব্দের সংখ্যা অন্তত দশ সহস্রাধিক।
লক্ষ্যণীয় যে, বাংলা বানান প্রমিতকরণের দ্বিতীয় পর্বের শুরু এবং শেষের মাঝে ব্যবধান মাত্র ৩ দিনের। বস্তুত এর পর থেকেই এনসিটিবির এক পাঠ্যপুস্তকের সাথে আরেক পাঠ্যপুস্তকের, এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তকের সাথে এনসিটিবির বাইরে থেকে প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তক, অপাঠ্যপুস্তক, পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনার বানানে ব্যাপক 'অসমতা' সৃষ্টির সূচনা হয়। উল্লেখ্য সর্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অধ্যাদেশ পাশ (অ্যাক্ট নাম্বার ২৭, ১৯৯০) বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পাশ করা হয় ১৯৯০ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী তারিখে।
এই দ্বিতীয় পর্বের অনিবার্য পরিণতিতে যা ঘটেছে তার একটি কালপঞ্জী তৈরী করা যেতে পারে।
১৯৯২, নভেম্বর : ১৯৮৮ সালের সেই কর্মশালায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এনসিটিবি থেকে 'পাঠ্য বইয়ের বানান' পুস্তক প্রকাশিত হয়; স্পষ্টীকরণ করা ৪২টি টাইপের অস্পষ্ট রূপ শিক্ষার্থীদের না শেখানোর বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং সেভাবেই সব পাঠ্যবই প্রণয়ন করার চেষ্টা করা হয়।
১৯৯২ : এনসিটিবি-র পাশাপাশি বাংলা একাডেমীও 'প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম' প্রচলন করে। এতে এনসিটিবির কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কিছু বর্জন ও কিছু নতুন সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করা হয়। কারচিহ্ন ও যুক্তবর্ণের স্পষ্টরূপ ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা রেখে প্রচলিত 'অস্পষ্ট' রূপ অভিধানে চালু রাখা হয়।
২০০০, ২৭শে নভেম্বর : বাংলা একাডেমী নির্ধারিত 'প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম'-এর সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয় এবং কারচিহ্ন ও যুক্তবর্ণের 'অস্পষ্ট' প্রচলিত রূপ বহাল রাখা হয়।
১৯৯০ থেকে ২০০৫ : এই ১৫-১৬ বছরে কয়েক কোটি শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা পাঠ্যবই ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যুক্তবর্ণ ও কারচিহ্নের ৪২টি প্রচলিত 'অস্পষ্ট' রূপ শিখতে পারেনি। তারা জলে পড়ে সাঁতার শেখার মতো পত্রপত্রিকা, দেয়াল, পোষ্টার, সাইনবোর্ড, ব্যানার, পাঠ্য বহির্ভূত বই ইত্যাদির মধ্যে ডুবে ডুবে এসব যুক্তবর্ণ শেখার কসরৎ করেছে।
২০০৫, নভেম্বর : এনসিটিবি থেকে 'পাঠ্য বইয়ের বানান' পুস্তকের সংশোধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ। ১৫ বছর পরে এসে এখানে আবার শিক্ষার্থীদের কার-চিহ্ন ও যুক্তবর্ণের পূর্বতন 'অস্পষ্ট' রূপকে পরিবর্তিত 'স্পষ্ট' রূপের পাশে শেখানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিছু শব্দের বানান আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২০০৯ : প্রথমা প্রকাশন থেকে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার জন্য 'প্রথম আলো ভাষারীতি' পুস্তক প্রকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উদ্যোগের বাইরে থেকে বানান নির্ধারণের প্রথম উদ্যোগ শুরু হয়। এতে বাংলা একাডেমী ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং যুক্তবর্ণের প্রচলিত 'অস্পষ্ট' রূপকে বহাল রাখা হয়।
২০১২, সেপ্টেম্বর : বাংলা একাডেমীর 'প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম'-এর সংশোধন ও পরিমার্জন, অনেকগুলো বিকল্প বানান ব্যবহারের বিষয়ে স্বাধীনতা প্রদান; সরকারের নির্দেশে এনসিটিবি-বানানের বাংলা একাডেমীর বানানের কাছে আত্মসমর্পণ।
একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখতে পাবো পাকিস্তান সৃষ্টির পর রোমান বা আরবী হরফে বাংলা লেখা, বর্ণমালা ও বানান সংস্কার, অথবা বাংলা ভাষার ইসলামীকরণের যে উদ্যোগ, তা আমাদের পূর্বসূরীরা বুঝে প্রতিহত করতে পেরেছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালে সামরিক সরকারের টলায়মান গদির ভাবমূর্তি রক্ষার বহুমূখী ফিকিরের অংশ হিসাবে আর আমলা-কর্মকর্তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী নানা ধরণের কাজ বাগানোর উপায় সৃষ্টির স্বার্থে নেওয়া যে কর্মসূচী তা আমরা বুঝতে পারিনি।
এরপর থেকে আমরা ভাষা নিয়ে যত কথা বলেছি, তার হয়তো ৯৯ ভাগই বানান নিয়ে। যত বুদ্ধিবৃত্তিক ঝগড়া হয়েছে, তার হয়তো অর্ধেকই বানান নিয়ে। এভাবে গত প্রায় তিন দশকে আমরা যত সামাজিক সময় ও রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করেছি, অর্থমূল্যে এটা হিসাব করলে হয়তো একখান জাতীয় বাজেটের সমান হয়ে যেতে পারে।

২.
১৯৮৮ সালের 'সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পটভূমিতে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতাবিধান-বিষয়ক জাতীয় কর্মশিবির' লিপিরূপ পরিবর্তনের পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বিকল্প বর্জন করে যেসব বানান গ্রহণ করেছিল তার কিছু দৃষ্টান্ত এরকম : খ্রিস্টান, পোস্টঅফিস, পেশি, শেফালি, আমদানি, গ্রিক, জানুয়ারি, লাইব্রেরি, নানি, বাঙালি, সোনালি ইত্যাদি। কিন্তু 'বহুলপ্রচলিত' বলে তাঁরা হাত দেয়নি শ্রেণী, পল্লী, রানী, একাডেমী, নবী, বীমা, লীগ, স্পীকার, শহীদ ইত্যাদি বানানে। তবে ২০০৫ সালে এসে তারা বলেছে, খ্রিস্ট ও খ্রিস্টান শেখানো ভুল হয়েছে, কারণ খ্রিষ্ট ও খ্রিষ্টান বাংলায় 'আত্তীকৃত' হয়ে গেছে! ল্যাও ঠ্যালা!
অন্যদিকে বাংলা একাডেমী ১৯৯২ সালে তাঁদের প্রণীত বানানবিধিতে বহুল প্রচলনের ছাড় দেয়নি। তারা করলো শ্রেণি, পল্লি, রানি, নবি, বিমা, লিগ, স্পিকার, শহিদ ইত্যাদি; একাডেমী-কে বাইরে রাখা হলো। ২০০৫ সালেও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বহুল প্রচলনের বিধি অপরিবর্তিত রাখলো। কিন্তু বর্তমান সরকারের শিক্ষাবিভাগ ২০১২ সালে একাডেমীর বানানকেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করায় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো। তাই তারা 'বহুল প্রচলনের' বিধি বাতিল করে একাডেমীর সেই ১৯৯২ সালে চালু করা 'শ্রেণি' ইত্যাদি পাঠ্যপুস্তকে চালু করেছে ২০১৩ সালে এসে।
এই যে ডামাডোল তাতে বানানবিদদের কারো পক্ষেই এখন বলা সম্ভব নয় তাঁরা কখন, কোনটা, কার জন্য, কেন করেছিলেন (বোর্ড ও একাডেমী দুটোরই বানানবিধি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন এমন একজন অধ্যাপকের সাথে কথা বলে এটা নিশ্চিত হয়েছিলাম)। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ এর থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে দুবছর গবেষক হিসাবে কাজ করেছিলেন; লিখে, চিঠি লিখে, বক্তৃতা দিয়ে নিজের মত ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু এখন বানানবিদেরা অনেকটা শীত-গ্রীষ্ম বুঝে কাজ করেন। তাঁরা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে গিয়ে বোর্ডের চাহিদামতো করেন, বাংলা একাডেমীতে গিয়ে একাডেমীর মতো করেন, ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে গিয়ে ফাউণ্ডেশনের মতো করেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে মাদ্রাসা বোর্ডের মতো করেন, পত্র-পত্রিকা বা অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদের মতো করেন, এবং নিজের বইয়ে নিজের মতো করেন!
তারই সর্বশেষ ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রের উদ্যোগের বাইরে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বানান নির্ধারণের প্রথম উদ্যোগ হিসাবে যে প্রথম আলো ভাষারীতি, তারাও বানান বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যা বাংলা একাডেমী থেকে পৃথক। যেমন একাডেমীর ঈগল, একাডেমী, ক্ষেত, ঘণ্ট, চাষী, ঠাণ্ডা, দেশী, নিশ্বাস, বন্দি (আটক অর্থে), মূলা, ইত্যাদিকে তারা করে ইগল, একাডেমি, খেত, ঘন্ট, চাষি, ঠান্ডা, দেশি, নিঃশ্বাস, বন্দী (আটক অর্থে), মুলা, ইত্যাদি (প্রথম সংস্করণ থেকে গৃহীত)।
বাংলা বানান ও লিপি-সংস্কারের এরকম এলোমেলো প্রক্রিয়ায় যেটা ঘটছে তা হচ্ছে এক প্রজন্মের সাথে আরেক প্রজন্মের শুধু নয়, এক ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সাথে আরেক ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্নতা-বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে; শিক্ষক-শিক্ষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। ভয়ঙ্কর সত্য হচ্ছে, এখন অধিকাংশ মানুষ ভাবে, একটা কিছু লিখলেই হয়। কিন্তু তারও চেয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষতি যেটা হয়েছে আমাদের জাতীয়তার দ্বন্দ্ব, স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বন্দ্ব, সমতল-পাহাড়ের দ্বন্দ্ব, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর দ্বন্দ্ব, সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্ব, এনজিও-জিও দ্বন্দ্ব ইত্যাদির পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের মধ্যেই প্রবেশ করেছে হ্রস্ব ই-কার দীর্ঘ ঈ-কার, হ্রস্ব উ-কার দীর্ঘ ঊ-কার, বর্গীয় জ অন্তঃস্থ য, দন্ত্য ন মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য স মূর্ধন্য ষ, ২১-২১শে ইত্যাদির দ্বন্দ্ব। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন মনে হয় হ্রস্ব ই-কার, হ্রস্ব উ-কার, বর্গীয় জ, দন্ত্য ন, দন্ত্য স, ২১, ১৬, ২৬ এগুলো প্রগতিশীল  অনেকখানি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের! আর দীর্ঘ ঈ-কার, দীর্ঘ ঊ-কার, অন্তঃস্থ য, মূর্ধন্য ণ, মূর্ধন্য ষ, ২১শে, ১৬ই, ২৬শে এগুলো প্রতিক্রিয়াশীল  রাজাকার-টাজাকার হবে! কি বিশাল সামাজিক সময় ও শক্তি আমরা ব্যয় করে চলেছি কিছুই না করার কাজে!

৩.
বানান ও লিপি নিয়ে সরকার ও প্রতিষ্ঠানের এসব নয়-ছয় কর্মসূচী কি জনমানুষ গ্রহণ করেছে? যদি আমরা ক্যাশ মেমো, ভাড়ার নোটিশ, বাজারঘাট, দোকানপাট, কাপড়চোপড়ের দোকানের দিকে তাকাই তাহলে কি দেখতে পাই? এখনো আমরা দেখি 'বাড়ী ভাড়া দেওয়া হবে', 'রাষ্ট্রীয় জরুরী সেবা নাম্বার', 'শাড়ী-লুঙ্গী-গেঞ্জী আমদানী-রপ্তানী ও খুচরো-পাইকারী বিক্রি করা হয়' ইত্যাদি সহ এরকম বহু কিছু। কিন্তু আমরা সচরাচর এগুলো দেখতে পাই না। কারণ আমরা ২-৪ শতাংশ মানুষ মনে করি, আমরা করছি মানে এটা আমাদেরই অধিকার! আমরা মেনেছি মানেই সবাই মানবে! আমরা বুঝেছি মানেই সবাই বুঝবে!
বিস্ময়কর হচ্ছে যারা বাংলা বানান ও লিপির এসমস্ত প্রমিতকরণের সাথে যুক্ত তাঁরাও সবসময় একমত হয়ে কাজগুলো করেননি, একে অন্যের বিরোধীতাও করছেন। কিন্তু আমাদের অনেকের মতে সব কিছুতেই বিরোধীতা করে সমাজের যেসব 'প্রগতিশীল' মানুষ, তারা কিন্তু খুব আগ্রহভরে সরকার ও নানা প্রতিষ্ঠানের নেওয়া এইসব 'বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত' গ্রহণ করছে। বরং এগুলো মানার বিষয়ে তারা সবসময় অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে। কখন-কোন বানান সরকার ও তার প্রতিষ্ঠান কি করলো সে-বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নিতেই তাদের অস্থিরতা দেখা যায়। তাদের কখনও প্রশ্ন জাগেনি কেন সরকার সকল ক্ষেত্রে এতো নয়-ছয় প্রকল্প বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও বানান নিয়ে 'সত্যিকারের উন্নয়ন' করছে? এমনকি এগুলোর উদ্ভটতায় সরকার, তার প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষজন যখন পেছনে ফিরেছে, তখনও তারা তাদের গতি থামায়নি (যেমন, বাংলা একাডেমীর ২০১২ সালের যে বানান রীতি সেখানে তারা আগের থেকে সরে এসে বেশকিছু বিকল্প বানান রেখেছে, তাদের দাওয়াতপত্রে বা ব্যানারে ২১শে বা ২৬শে ব্যবহার করছে)। এর কারণ হতে পারে সবকিছু ভাঙতে চেয়ে যেহেতু কিছুই ভাঙা যায়নি, সেই অস্থিরতায় হয়তো এসব মানুষ ভাষা, তার লিপি ও বানান ভাঙার পথে অন্তত এগিয়ে থাকতে চায়।
এ সবকিছুর ফলে যা হয়েছে, আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে বানান। বিষয় বা টেক্সট নয়। আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা গুছিয়ে লিখলেন। তা পড়ার আগেই 'লালসালু'র মজিদের মতো চারপাশ থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে "তোমার ক-য়ে হ্রস্ব-ই কার কেন? তোমার খ-য়ে দীর্ঘ-ঈ কার কই?" ইত্যাদি।
এই যে পরিস্থিতি এর মধ্যে কোটি কোটি শিক্ষার্থীকে টেনে আনা হয়েছে। ভাষা পড়তে-লিখতে শিখুক-না-শিখুক, বানান আগে! যে বিধি নিজেই ক'দিন পরপর বদলায়, নতুন ডালপালা গজায়, তাকে ক'দিন পরপর বদলে-বদলে শিক্ষার্থীদের গেলানো হচ্ছে। তারা পাঠ্যবই, অপাঠ্যবই, পত্রপত্রিকা, দেয়াল, পোষ্টার, সাইনবোর্ড, বাস, ট্রেন, লঞ্চ ইত্যাকার বহুস্থানের বহুরকম বানান ও লিপির অসমতার রাজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। এদের কাছে বানান এখন একটা সফটওয়ারের মতো, নতুন নতুন আপডেট আসবে আর সবাইকে তা কিনে কিনে শিখে শিখে ব্যবহার করতে হবে। ফলে বাংলা বানান এখন এক নৈরাজ্যের নাম। অথচ এরা শুরু করেছিল শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলা লিপি ও বানান সহজ ও সমতার কথা বলে, যেটা নাকি অপরিহার্য ছিল সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে!
আজ সেই সিদ্ধান্তের পর তিন দশক পার হতে চললো। কত দূর এগোলো শিক্ষা? এখন প্রশ্ন ফাঁস করে, এমসিকিউ ৪০ নম্বর বলে দিয়ে, শুধু এমসিকিউ-তে ৩৩ পেলেই পাশ করিয়ে দিয়ে, খাতায় যা-লিখুক নাম্বার দিতে বলেও সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। মাঝখান থেকে বানান ঘিরে মজিদের প্রশ্নের ছড়াছড়ি আজ, তোমার দাড়ি কই?

৪.
আসলে প্রতিষ্ঠান-প্রশাসনের ছড়ি ঘুরিয়ে, ক্ষমতাবলয়ের সুবিধা নিয়ে বা ভাষার কাঠিন্যের যুক্তি দেখিয়ে বা শিক্ষা বিস্তারের মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে রাষ্ট্রের নাগরিকদের করের টাকার নয়ছয় করে এলোমেলো কিছু নিয়ম নির্ধারণ করে তার ঢোল পিটালেই ভাষা বা তার বানান পরিবর্তিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় না। বরং এতে নৈরাজ্যই উৎসাহিত হয়। এর জন্য আগে জানা ও বোঝা চাই ভাষা বা বানানের ইতিহাস, ভাষা বা বানান পরিবর্তনের ইতিহাস, সমাজ-ভাষা পরিস্থিতি এবং ভাষা বা বানান পরিবর্তনের নিয়ম। এর জন্য মনোজগতের উপনিবেশ থেকেও বের হওয়া চাই। কিন্তু এই যে মনোজগতের উপনিবেশ, যার থেকে নিস্কৃতি আমরা পেতে চাই, এটাকে ভিত্তি করেই ১৯৮২ সালে এক জেনারেল ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ক্ষমতা দখল করেই সাধারণের দৃষ্টি সরাতে কিছু কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এর একটা ছিল Dacca বানান পরিবর্তন করে Dhaka করা।
স্বৈরশাসক সবসময় মেরেধরে বা জেলজুলুম দিয়েই তার স্বৈরশাসন চালায় তা নয়, বরং সে বহু বহু ইতিবাচক প্রপঞ্চকেও তার স্বার্থে ব্যবহার করে। কারণ যে কোনো সমাজে চালু ইতিবাচক প্রপঞ্চ ব্যবহার করে খুব সহজেই মানুষকে ধোকা দেওয়া যায়, বোকা বানিয়ে কার্যসিদ্ধি করা যায়। Dacca উচ্চারণ কলোনীয়াল প্রভুদের, সুতরাং আমাদের জাতীয়তাবোধের পক্ষে এই উচ্চারণ অসম্মানজনক। সুতরাং এটা পরিবর্তন করতে হবে। এটা না-ছিল বাংলা একাডেমীর, না-ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, না-ছিল ভাষাবিজ্ঞানীদের নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত।
এর ফল কি হলো? একটা দেশের রাজধানীর বানান পরিবর্তন করতে সেই দেশের মধ্যে ও বাইরে যত কিছুতে সেই বানান আছে তা পরিবর্তন করতে হয়। সেই রাষ্ট্রের প্রায় সকল মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কথা বলতে হয়, বাদানুবাদ করতে হয়। কয়েক কোটি মানুষের এই বাদানুবাদের মূল্য বাদ দিলেও কথিত আছে সেই ১৯৮২ সালে এজন্য কয়েকশত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল, যখন দেশের আশি ভাগ মানুষ নিরক্ষর, আশি ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে, আশি ভাগ মানুষ চিকিৎসাসুবিধা বঞ্চিত। কিন্তু এগুলোর মাধ্যমে সে যে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে এসে আমার ঘাড়ে চেপে বসলো সেই ক্ষোভ অনেকটা স্তিমিত করা গেল। যারা সামরিক শাসন চান না তারাও বহু মানুষ এটার পক্ষ নিয়ে নিলেন।
একইভাবে এখন যদি লক্ষ্য করি, চট্টগ্রাম, যশোর, বগুড়া, কুমিল্লা এসব বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কারা নিচ্ছেন? কে পরামর্শ দিচ্ছে? বাংলা একাডেমী? ভাষাবিজ্ঞানীরা? কোনো বিশ্ববিদ্যালয়? মানুষের মধ্যে এটা করার জন্য প্রবল সামাজিক চাপ ছিল? না। সরকার ও আমলাতন্ত্রের একটি কমিটি এটা করছে। এখন এগুলোর ইংরেজী বানান পরিবর্তনের জন্য পার্লামেণ্টে বিল তোলা হবে, গেজেট করা হবে। এরপর এসব শহরের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরের সকল ডক্যুমেণ্ট, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বানান পরিবর্তন করে নতুনভাবে তৈরী করতে হবে। এবং এভাবে আমাদের ঘাড় থেকে উপনিবেশের ভূত তাড়ানোর নামে আমাদেরই রক্ত নিঙড়ানো হাজার কোটি টাকার নয়ছয় করা হবে! আমরা পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে বাদানুবাদ করতে থাকবো। আর ভুলে যাবো আমাদের ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, আমাদের রিজার্ভ চুরি হয়ে যাচ্ছে, আমাদের ঘাম ঝরানো টাকাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেছে, গুম-খুন-ধর্ষণ আমাদের নিত্য সঙ্গী, আর আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে আছে মিথ্যা ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক এক সরকার।