স্বৈরশাসনের জন্মজয়ন্তী উদযাপন কীভাবে সম্ভব হল?

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 5 April 2018, 04:45 PM
Updated : 5 April 2018, 04:45 PM

স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং তার স্বৈরজ জাতীয় পার্টি তাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের  জন্মজয়ন্তী পালন করেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তারিখটি ছিল ২৪ মার্চ ২০১৮। ঠিক এই দিনে,  ১৯৮২ সালে, সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জোরপূর্বক বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন। অবৈধভাবে জারি করেন সামরিক আইন। সারাদেশ জুড়ে দেয়ালে লাগানো পোষ্টারে যদিও 'মহাসমাবেশ' কথাটি লেখা ছিল, কিন্তু দিন নির্বাচন দেখে বুঝা যায় যে এটা ছিল এরশাদের "অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জয়ন্তী"।

এই সমাবেশ থেকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিচিত্র রাজনৈতিক অশ্রাব্যতার চর্চা করে গেলেন। এছাড়া রাজনৈতিক সং এর ভূমিকায় অভিনয়ও করে গেলেন। লক্ষ্য করতে হবে যে এসব তিনি করে গেলেন টি এস সি তে শহীদ মিলনের আত্মদানের  স্মারকের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। শিক্ষাভবনের সামনে জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা, আইয়ুব, মোজাম্মেলদের স্মৃতি স্মারকও খুব কাছেই। লাউড স্পীকারের কল্যাণে তার এই সংবাজি হয়তো নূর হোসেন চত্বর পর্যন্ত গিয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের।

যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তখনকার রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার মন্ত্রে গোটা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন, সেই পবিত্র ময়দানে স্বৈরশাসনের বার্ষিকী উদযাপন? এও কি মানা যায়? কেউ কি খেয়াল করেন নি?এই জায়গায় তাকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়াই ঠিক হয়নি। এমন কি এই দিনে অন্য কোন স্থানেও তাকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া ঠিক হত না।

১৯৮২ এর ২৪ শে মার্চ জাতির জীবনে স্বৈরশাসনদুষ্ট একটি কালো দিন। এরশাদ এই দিনটিকে উদযাপন করে গোটা জাতিকে অপমান করলেন। ঠিক তার একদিন পরেই ২৫ মার্চ"গণহত্যা দিবস"। ১৯৭১ এর কথা স্মরণ করলে যে কেউ মনে করতে পারবেন এক থেকে পঁচিশে মার্চ প্রতিটি দিন ছিল সংগ্রাম, প্রতিরোধ আর স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির দিন। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও প্রতিরোধ আর অসহযোগ আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন কেউ না কেউ। আর ২৫মার্চ এর গণহত্যার শিকার একটি জাতি কীভাবে পাল্টা আঘাত করে একটি সশস্ত্র গণযুদ্ধের সূচনা করেছিল, তা আজ বিশ্বইতিহাসের অংশ। এরশাদের এই সমাবেশ একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আর প্রতিরোধের ইতিহাসের উপর ইতিহাস লেখার ঔদ্ধত্যপূর্ণ চেষ্টা। তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে এই  অপচেষ্টার জবাব চাওয়া উচিৎ। একটি দুষ্টাত্মা "বিশ্ব বেহায়া" এবং তার অনুচরদের বিচার হওয়া উচিৎ ছিল অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার অপরাধে। তাহলে ক্ষমতাচ্যুতির সাতাশ বছর পর এই তথাকথিত মহাসমাবেশ করে ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস পেতোনা।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্ষমতার জটিল সমীকরণে এরশাদের দল আজ ক্ষমতার অংশীদার। তার দল থেকে রয়েছে মন্ত্রী। এরশাদ নিজেও নিযুক্ত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিশেবে। ক্ষমতার রাজনীতি যে শহীদের রক্তের দোহাই মানে না, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে।

রওশন এরশাদ এই শেষ সময়ে এসে রাজনৈতিক অস্তিত্ত্ব সংকট অনুভব করে তার দলের মন্ত্রীদের মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। সম্ভবতঃ তা তিনি   করেছেন ক্ষমতার পকেট থেকে বের হয়ে এসে একটুখানি সত্যিকারের বিরোধী দল হয়ে উঠার বাসনায়। রওশন বুঝতে পেরেছেন জাতীয় পার্টি বিরোধী দলও হয়ে উঠতে পারেনি। রাজনীতিতে সত্যিকারের বিরোধী দল হয়ে উঠাও অনেক বড় অর্জন। জাতীয় পার্টি নেহায়েতই রাজনীতির আগাছা।

রওশন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন রাজনীতি 'ফার্স্ট লেডি'  হওয়ার উদ্ভট বাসনার মত সহজ নয়। এ এক দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ত্যাগের বিষয়, জনগণের সাথে থাকার বিষয়। রওশন এবং এরশাদ তাদের কারোরই তা শেখার মত বয়স আর নেই। আর জনগণের সাথে থাকার যোগ্যতাও তাদের নেই। বাংলাদেশের এই 'ইমেলদা মার্কোস' এর সামনে সংসদ অধিবেশন কক্ষে এখনো বিদেশী ব্র্যান্ড এর মিনারেল ওয়াটার এর বোতল থাকে। আহা এই বাংলার জল ময়মনসিংহের এই জমিদার কন্যার তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে না!

অবাক হয়ে ভাবি, পৃথিবীর কোন দেশেই কি পতিত স্বৈরশাসক আবার রাজনীতিতে টিকে থাকতে পেরেছে? পতনের পর তাদের ঠিকানা হয়েছে কারাগার, নির্বাসন কিংবা উন্মুক্ত প্রান্তরে জনগণের সামনে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড। জেনারেল নরিয়েগা, চুন দু হুয়ান, সুহার্তো কিংবা ইদি আমিন এর কথা ভাবলে এটাই দেখা যায়। আর আমাদের পতিত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর নতুন করে একটি প্রেম করলেন। "বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা" এই প্রবাদ বাক্য বাস্তবে রূপায়ন করলেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে চুরিকৃত অর্থ দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যও করলেন। নির্বাচন করে পার্লামেন্টের সদস্যও হলেন। অথচ পতনের পর ইতালির বেনিতো মুসোলিনি এবং তার প্রেমিকা ক্লারার লাশ মিলানের রাস্তায় উল্টো করে ঝুলিয়ে জনতা  যেভাবে  থুতু এবং ঢিল নিক্ষেপ করেছিল তেমনটিই হতে পারত এরশাদের সঠিক পরিণতি।

শ্রদ্ধেয় জিল্লুর রহমানকে যখন রাষ্ট্রপতি করা হল, তখন এরশাদ  মামা বাড়ির আবদারের মত রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশ ব্যক্ত করেছিলেন মিডিয়ার সামনে। এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে তিনি জিল্লুর রহমানের চেয়ে বয়সে দু' বছরের বড়। নির্লজ্জ এরশাদ জানেন না বোধ হয় যে ৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে, ৭১'র  মুক্তিযুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের অবদান কতখানি। এরশাদের রাজনৈতিক বালখিল্যতা অত্যন্ত বিরক্তিকর। তার রাজনৈতিক ভাঁড়ামি যেকোনো সচেতন মানুষের জন্য অসহনীয়।

রাজনীতিতে ময়লা দিয়ে ময়লা ফেলার সংস্কৃতিই আজ এরশাদকে এক ধরণের বৈধতা দিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী জামাত এবং তাদের আশ্রয়দাতা বি এন পি আর তাদের উপজাত জঙ্গি চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আওয়ামীলীগ আজ এরশাদকে সাথে নিয়েছে। কিন্তু এই স্বৈরশাসককে সাথে নেওয়ায় জনগণের রাজনৈতিক চেতনার জায়গাটি আহত হয়েছে। রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে যেকোনো কিছুকে একই টেবিলে বসার সুযোগ করে দিলে রাজনৈতিক নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক।

আওয়ামীলীগ যেটুকু সমর্থন এরশাদের নিকট থেকে পেয়েছে, তা কি জনগণের কাছ  থেকে আদায় করা যেত না? আওয়ামীলীগের মাঠের রাজনীতিবিদরা হয়তো এই প্রস্তাবকে অবাস্তবই বলবেন। দলের কৌশলী রাজনীতিবিদরা বলবেন, এক এগার উত্তর সময়ের রাজনৈতিক মেরুকরণে এরশাদ প্রতিপক্ষের কাছেও বিক্রি হতে পারতেন। আর জনগণের কাছে নিজেদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশে উদার যে আওয়ামী নেতৃত্ব তাঁরা হয়তো বলবেন, এরশাদ যেটুকু তাৎক্ষণিক সমর্থন যোগান দিতে সক্ষম নির্বাচনী প্রস্তুতিকালীন সময়ের মধ্যে জনগণের ভিতর থেকে এইটুকু সমর্থন বের করে আনার পর্যাপ্ত সময় হাতে ছিলনা। কিন্তু পতিত স্বৈরশাসক যখন রাজনীতিতে অনিবার্য হয়ে পড়েন তখন  জনগণের গণতন্ত্র কতদূর অগ্রসর হয়েছে এই প্রশ্ন নির্দ্বিধায় করা যায়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এরশাদের ক্ষমতার এই জয়ন্তী উদযাপন দেখে আশির দশকের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শহীদদের পরিবার এবং সাথীরা, সেই সময়ের স্বৈরশাসন বিরোধী রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতি কর্মীরা কতটা অপমানিত, হতাশ এবং বিষণ্ণ বোধ করেছে তা সহজেই অনুমেয়। এই দৃশ্য আমাদের কারোরই দেখার কথা ছিলনা। আবারও বলব, কী দুর্ভাগ্য!