ধর্ষণ, হত্যা, হিজাব ও বোরকা

আনিস আলমগীর
Published : 4 April 2018, 03:01 PM
Updated : 4 April 2018, 03:01 PM

মেয়েটাকে ধর্ষণও করলো আবার ধর্ষণের পর মেরেও ফেললো। এটিতো মনে হচ্ছে নব্য জাহেলিয়াতের সূচনার লক্ষণ। হবিগঞ্জের স্কুল ছাত্রী বিউটি আক্তারের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা হয়তো বাংলাদেশের নিত্যদিনের ঘটনা নয় কিন্তু দিন দিন এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা বাড়ছেই। গত কিছুদিন ধরে-তো মনে হচ্ছে ধর্ষণ আর হত্যার হিড়িক লেগেছে দেশে। সমাজকে এই উগ্রতা পুনঃগ্রাস করার আগেই রাষ্ট্রকে তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ইতালির রেনেসাঁর সূচনায় যুক্তিবাদী বিশ্বাসের লেখক ছিলেন ব্রসেলিন এবং তার শিষ্য আবেলার। আবেলার-এর পুরুষাঙ্গ ছেদন করেছিলো পূরুহিতেরা। অভিযোগ তিনি তার বান্ধবী এলোয়াজ-এর সঙ্গে যৌন মিলনে লিপ্ত হয়েছিলেন। ক'দিন আগে দেখলাম ভারতের বেশ কয়েকটি বাসে মহিলা বাসযাত্রীর সঙ্গে পুরুষ যাত্রীর প্রকাশ্যে ধর্ষণের চেষ্টার কথা। এরপর ভারতে দাবি উঠেছে ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ ছেদনের আইন প্রণয়নের।

সম্ভবত এরা আবেলার-এলোয়াজের প্রাচীন কাহিনির কথা অবগত আছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে, ক'দিন পর ঘরে প্রবেশ করে নারীদের ধরে নিয়ে যাবে। তাই যদি না হবে তাহলে প্রকাশ্যে বাসে পুরুষ যাত্রী মহিলা যাত্রীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয় কিভাবে! সুতরাং ভারতীয় সুশীল সমাজের অনুরূপ ঘটনার জন্য লিঙ্গ কর্তনের দাবি অযৌক্তিক নয়।
আমাদের সমাজ তো একধাপ এগিয়ে। ধর্ষণের সঙ্গে হত্যাও যোগ হয়েছে। এর আগে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে জাকিয়া সুলতানা রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং এ সমাজে লিঙ্গ ছেদনের দাবি যথাযথ হবে না। এখানে ক্রসফায়ারই হবে উপযুক্ত শাস্তি।

দেখলাম ধর্ষণের সঙ্গে পোশাককে সম্পৃক্ত করে বেশ বিতর্ক হচ্ছে। একদল দেখাতে চাচ্ছেন ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাকও দায়ী। আরেকদল এটাকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী এটা অযৌক্তিক। পোশাক যে ধর্ষণের প্রধান কারণ নয় তার প্রমাণ তো সম্প্রতি দুই বছরের শিশু আর বোরকা পরা নারীকে ধর্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। তবে ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী না হোক, যৌনতায় পোশাকের ভূমিকা নেই তা  বলা যাবে না।

যোগ করতে চাই যে,পোশাক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্থান কাল বিবেচনায় নেওয়া উচিত। পোশাকের কোনও আকর্ষণ নেই একথা যত যুক্তি দিয়ে বুঝানো হোক তা হবে বাস্তবতারহিত। পোশাকই নর-নারীর সৌন্দর্য্য বর্ধন করে। পোশাকই মানুষকে সভ্য সমাজে রুচিসম্মতভাবে উপস্থিত হতে সাহায্য করে। ড্রেস এড্রেস দ্যা ম্যান/উইমেন। রাষ্ট্র বা সমাজ কাউকে শালীন পোশাক পরতে বলতে পারে, তবে বোরকার মতো পোশাক চাপিয়ে দিতে পারে না। আবার কিছু পশ্চিমা দেশের মতো বোরকা না পরার আইন করতেও পারে না।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বোরকা নিয়েও মহা 'প্যাঁচাল' চলছে। কিছু নারীবাদী আর কথিত প্রগতিশীল পুরুষ বোরকাকে একটি সাম্প্রদায়িক পোশাক হিসেবেও দেখছেন। তাদের হয়তো অন্য ধর্মাবলম্বী নারীদের ধর্মীয় বেশভুষা চোখে পড়েনি। ক'দিন আগে একজন মহিলা এমপির সঙ্গে পোশাক নিয়ে কথা হচ্ছিল। একটি পত্রিকার আয়োজনে এক সেমিনারে কিছু নারীনেত্রী তাদেরকে নাকি স্লিভলেস পোশাক পরে পার্লামেন্টে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। এমপি নাকি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

একজন নারী কী পোশাক পরবে, আর কী পরবে না, সে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পোশাক-আশাক পরবে নাকি মানুষ হিসেবে পরবে–সেটি আমরা ওই নারীর ওপরই ছেড়ে দিতে পারছি না কেন! আমাদের ক্যাম্পেইন করার প্রয়োজন কেন! অশালীন না হলেইতো হলো। এখন যদি কেউ হিজাব সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়,সেটি সে ধর্মীয় দৃষ্টিতে পরছে নাকি ফ্যাশন হিসেবে পরছে- আপনার মাথা ব্যথা কেন!

হিজাব নিয়ে তো দেখি গানও হচ্ছে, সময়ের স্রোতে। 'মায়াবি মাতওয়ালী চাঁদ রূপওয়ালি হিজাবের আড়ালে কি ঝলক দেখালি। দৃষ্টিতে তোমার আছে যাদু গোলাপ রাঙা ওই ঠোঁটেতে মধু এক দেখাতেই নজর কাড়িলি। হিজাবের আড়ালে কি ঝলক দেখালি।'
আমাদের এটা ভুললে চলবে না, যারা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পোশাক পরে তাদের পোশাককে নিন্দা করে রাষ্ট্রে অহেতুক বিবাদের সূচনা করে লাভ নেই। অনাদি অনন্তকাল থেকে ধর্ম ছিল এবং অনন্তকাল থাকবে। তাদের পোশাকও থাকবে। পরিবর্তন, পরিবর্ধনও চলবে।
আমি ২৫টির মতো দেশ সফর করেছি, মূলত সাংবাদিকতার কাজে। ওই সব দেশের সিংহভাগের সমাজ ব্যবস্থা আমাদের দেশের চেয়ে উন্নত। পোশাক নিয়েও এতো 'প্যাঁচাল' দেখিনি। যে আফগানিস্তানের বোরকা নিয়ে আপনি ভাবছেন তালেবানরা এটা চাপিয়ে দিয়েছে, সে আফগানিস্তানের সিংহভাগ নারী ওই ট্রেডিশনাল পোশাক পরতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তালেবান চলে যাওয়ার পরও তারা সেটাই ধরে রেখেছে।

আবার যে ইরানে মহিলারা বোরকা না পরে ঘরের বের হতে পারে না, সেই ইরানের মেয়েরা এটাকে পর্দা নয় জুব্বা হিসেবে নিয়েছে। বোরকার নিচে তাদের টপস,টাইট জিন্স নয়তো স্কাটই দেখেছি তেহরানে ইরানীদের বাসায়। রাতের ১২টায়ও নারী-পুরুষ একসঙ্গে শেয়ারে গাড়িতে চড়ে যাচ্ছে সেখানে। সব কিছুর পেছনে রয়েছে মেনে আসা দীর্ঘদিনের অভ্যাস, সংস্কৃতি।

সেক্স নিয়ে আমাদের সমাজের মতো ভণ্ডামি অন্যদেশে আমি দেখিনি। আমরা প্রগতিশীলতার কথা বলি আবার সেক্স নিয়ে কথা বললে নিন্দার ঝড় তুলি। দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে স্বেচ্ছায় মিলনের জন্য আমরা যেভাবে দোষী বানিয়ে ইটা মেরে, বেত্রাঘাত করে পিটিয়ে মারি, পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, পত্রিকা ছবি ছাপিয়ে বাহবা নেয়– সেটি পৃথিবীর কম দেশেই ঘটে। আবার ধর্ষককে ধরে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া, ধর্ষণের সাজা কয়েক হাজার টাকা নির্ধারণ– সেটিও বিরল অন্য দেশে। থানায়ও পড়ে থাকে না শত শত ধর্ষণ মামলা। ধর্ষণের প্রমাণের জন্য ধর্ষিতাকে আদালতে আবার কথার আঘাতে নির্যাতিত হতে হয় না।

সব দেশের মানুষের মধ্যে এক বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে দেখেছি– তা হলো আনন্দ উপভোগের মধ্যে যৌন আনন্দ উপভোগই চরম আনন্দদায়ক উপভোগ। ইতিহাসতো বলে যারা আবেলারের লিঙ্গ কর্তন করলো এলোয়াজের সঙ্গে যৌন মিলনের জন্য, সেই খ্রিস্টের মোহন্তরাও ব্রাহ্মাচার্যের শপথ নিয়ে গোপনে রক্ষিতা পোষণ করতো। প্রাকৃতিক নিয়মের বাহিরে যাওয়া সম্ভব নয় বলে নারী পুরুষের মিলন ঘটে। সে মোহন্তই হোক কিংবা ধর্ষকই হোক- মিলন জরুরি। শারীরিক চাহিদার যে কোনও অবদমনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াতো সমাজে হবেই।

ইংরেজ আমলে  প্রতিটি শহরে পতিতালয় স্থাপনের স্বাধীনতা ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে নাকি জাহাজ নোঙ্গর করার পর নাবিকেরা জাহাজ থেকে নেমে প্রথমে খোঁজ করে পতিতালয় কোথায়। ইংরেজরা সুসভ্য জাতি। অসভ্যতা পরিহারের পস্থা হিসেবে সম্ভবত পতিতালয় স্থাপনের অনুমতি দিত। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি বিদেশি সৈন্যের সমাবেশ ঘটেছিলো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। এইসব সৈন্যদের প্রয়োজনে কুমিল্লা শহরের পতিতালয় ছোট বলে দাউদকান্দির গৌরিপুর বাজারের পার্শ্বে আরেকটা পতিতালয় স্থাপন করা হয়েছিল।

যখন পতিতালয় ছিল তখন জোর করে মেয়ে তুলে নিয়ে ধর্ষণের কথা আজকের মতো তেমনভাবে কেউ শোনেনি। চট্টগ্রামের রিয়াজদ্দীন বাজারের পতিতালয় উচ্ছেদ করেছিলেন  ফজলুল কাদের চৌধুরী। ফজলুল কাদের চৌধুরী কোনও ধর্মীয়  অনুভূতি থেকে এ কাজ করেননি। জায়গাটার মালিক ছিলেন রফিক উদ্দীন ছিদ্দিকী। তাকে পতিতারা খাজনা দিতো। রফিক উদ্দীন ছিদ্দিকী ছিলেন জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি আর ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। উভয়ের মাঝে ছিল বিরোধ। রফিক উদ্দীন ছিদ্দিকীকে অজনপ্রিয় করার জন্য আর নিজের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি অনুরূপ উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

কারণ দেখা যায়,পরবর্তীকালে এই পতিতারা মাঝির ঘাটে গিয়ে জায়গা ভাড়া করে পতিতালয় স্থাপন করেছিলো। ফজলুল কাদের চৌধুরী মাঝির ঘাটের পতিতালয় স্থাপনের সময় বাধাও দেননি বা পরবর্তীতে উচ্ছেদও করেননি।
ধর্মের 'মর্দে মুজাহিদ' সেজে 'মওলানা' শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের পতিতালয়টি উচ্ছেদ করেছেন। সমাজের কতটুকু উপকার হয়েছে জানি না তবে যেটি একটি এলাকার মাঝে সীমবদ্ধ ছিল তা এখন সারাদেশময় একটা উৎপাত সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার সোনাগাছি পতিতাপল্লী না থাকলে কলকাতায় মেয়েলোক লুট হতো। সব কিছু হজম করছে সোনাগাছি।

আমি দাবি করছি না যে পতিতালয় পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে সমাজপতিরা নিজেদের ঠুনকো জনপ্রিয়তার জন্য যা করেছেন তাতে সমাজ উপকৃত হয়নি। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। এখন সরকারকে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে হবে এ উঠতি প্রবণতা থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য।