যাত্রাপালা: চন্দ্রগুপ্ত-৬। ষষ্ঠ অঙ্ক, ১ম দৃশ্য

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 8 April 2018, 03:08 AM
Updated : 8 April 2018, 03:08 AM

[পাটলিপুত্র নগরের গোপন রাজকীয় মন্ত্রণাকক্ষ। চাণক্য এক অতি সাধারণ কর্কশ কাষ্টাসনে উপবিষ্ট। অন্য একটি আরামদায়ক আসনে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বসিয়া আছেন। চাণক্যের মুখমণ্ডলে বিদ্রুপান্বিত ক্রোধ এবং সম্রাটের মুখমণ্ডলে ঈষৎ লজ্জ্বা ও অপরাধবোধ সুস্পষ্ট। হাতে তালি দিতেই চাণক্যের একান্ত নিজস্ব গুপ্তচরদলের প্রধান প্রবেশ করিয়া হাত জোর করিয়া দ্বারপ্রান্তে জানু পাতিয়া অবস্থান করিতে লাগিল। চাণক্যের দৃষ্টির সহিত তাহার দৃষ্টি মিলিতেই চাণক্য ও সম্রাটের সমীপবর্তী হইয়া চর বলিতে আরম্ভ করিল]

গুপ্তচর: প্রভূ, আমি যখন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সন্মুখস্থিত সড়কে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা কণ্টকে কণ্টকে একাদশ ঘটিকা। প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ উপেক্ষা করিয়া শিক্ষার্থীবৃন্দ সমভিব্যাহারে অধ্যাপক মৈসদক, শৈশরক, মৈমনক প্রমূখ ফৌটপথে দণ্ডায়মান। তাহাদিগের হস্তে ধৃত একাধিক বৈনর এবং ফৈস্টন, যাহাতে ধবল রঙের উপরে রক্তিম অক্ষরে লেখা রহিয়াছে: 'স্বল্পোন্নত আর্যাবর্ত অবশেষে উন্নয়নশীল সাম্রাজ্যের তালিকাভুক্ত হওয়াতে মহান সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে অভিনন্দন!'

সারিবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইতে না দাঁড়াইতেই শিক্ষার্থী-শিক্ষক নির্বিশেষে সকলেই মৌবইল বাহির করিয়া নিজস্বী তুলিতে শুরু করিল। তীব্র রৌদ্রের মধ্যে মুখমণ্ডলে একাধিক পোঁচের কড়া মেক-আপ হৈজব কিংবা নৈকব নামক আরবীয় আচ্ছাদনে ঢাকিয়া ডানহাতে মোবইল ধরিয়া বামদিকে ঘাড় ঈষৎ বক্র করিয়া স্বল্পোন্নত কিংবা অনুন্নত বক্ষদেশ যথাসম্ভব সন্মুখে ঠেলিয়া দিয়া শিক্ষার্থীনীরা পউজ দিতে লাগিলেন। হতবাক হইয়া লক্ষ্য করিলাম, কিছু কিছু শিক্ষার্থীনীর শুধু চক্ষুদ্বয় দৃশ্যমান হইতেছে। নিছক এই 'আইফি' তুলিয়া কী লাভ তাহা শুধু তাহারা কিংবা অন্তর্যামী জানিলেও জানিতে পারেন। ছাত্রগণেরও নিজস্বী তোলাতে ক্লান্তি নাই। চুঙ্গা আকারের জৈন্স পাতলুনে ঢাকা ছাত্রাবাসের অখাদ্য ভক্ষণজণিত অপুষ্টির শিকার অর্ধমৃত পশ্চাদদেশ যথাসম্ভব বাঁকাইয়া তাহারাও মোবইল টিপিতেছে এবং প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে যাহাতে পার্শ্বে কিংবা দূরে দণ্ডায়মান কোনো সুন্দরী, প্রিয় সহপাঠিনীর মুখমণ্ডলের একাংশ স্বালোকচিত্রে কমবেশি দৃশ্যমান হয়।

অধ্যাপকবৃন্দের কপাল হইতে টপটপ করিয়া ক্রমাগত স্বেদবিন্দু ঝরিয়া সড়কের তপ্ত বালুকারাশি ভিজাইতে লাগিল। রৌদ্রতাপে কাহারও কাহারও বিরলকেশ মস্তক চকচকায়মান। অধ্যাপিকাগণ শাড়ির অঞ্চল উত্তোলন করিয়া রৌদ্রতাপ হইতে মুখমণ্ডল রক্ষা করিতে ব্যস্ত, কারণ আর্যাবর্তের উন্নয়ন হউক কিংবা না হউক, সোনার বর্ণ কালি হইয়া গেলে তাহারা মুখ দেখাইবে কী করিয়া! চৈত্রমাসের বাঙ্গিফাটা গরমে হাঁসফাঁস করিলেও ১১টা হইতে ১২টা – এই এক ঘটিকা সড়কপ্রান্ত হইতে কাহারও নড়িবার উপায় নাই। সম্রাটের কড়া হুকুম: রৌদ্র-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করিয়া সম্রাটের সাফল্যে সকলে মিলিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতেই হইবে! সম্রাটকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তিনি অধ্যাপকবৃন্দকে মুষ্টিবদ্ধ দক্ষিণ হস্ত শূন্যে ক্ষেপণ করিয়া ফাঁফা স্লোগান দিতে আদেশ করেন নাই (যে শ্লোগানের সহিত বিশ্বাসের যোগ নাই তাহকে 'ফাঁফা শ্লোগান' কহে)। শ্রেণীকক্ষে আবোল-তাবোল বকিতে বকিতে অধ্যাপকবৃন্দের যে গলা এমনিতেই শুষ্ক হইয়া থাকে, প্রখর রৌদ্রে তাহা শুষ্কতর হইয়া উঠিতেছিল। ইহার উপর স্ব-অঙ্গুলি দিয়া আপন পশ্চাদ্ধেশ চাপিয়া চিৎকার করিতে বাধ্য হইলে তাহাদিগের স্বরতন্ত্রীর সাড়ে বারোটা বাজিয়া যাইত।

আইসক্রিম বিক্রেতাবৃন্দ তাহাদের ত্রিচক্রযান লইয়া এদিক ওদিক দৌঁড়াইয়া কুল পাইতেছিল না। মৌর্যসাম্রাজ্যের যে সকল পাঠক এই বিশেষ খাদ্যটির সহিত পরিচিত নহেন, তাহাদিগের উদ্দেশ্যে বলি: এক বিশেষ ধরনের বরফ-ননীকে অর্বাচীন কালের ম্লেচ্ছ ইঙ্গরাজি ভাষায় 'আইসক্রিম' কহে। প্রচণ্ড গরমে এই লেহনদণ্ডটি ওষ্ঠাবৃত করিয়া জিহ্বাদ্বারা চুষিলে অত্যন্ত উপাদেয় বলিয়া মনে হয়। এই আইসক্রিম দেদার বিক্রি হইতেছিল। বছর চল্লিশেক আগে চট্টগ্রামের রক্তিম দীঘি ময়দানে এককালের ভামনেতা এবং বর্তমানে সম্রাটের অমাত্য রৈশদখ্যন মৈননকে একবার বলিতে শুনা গিয়াছিল: 'কত নেতা আসিল, কত নেতা গেল! লাভ হইল শুধু ঐ বাদাম-ব্যাপারির!' উন্নয়নের কথা যদি বলেন, তবে আইসক্রিম বিক্রেতাদের স্বল্পোন্নত পকেট কমবেশি উন্নয়নশীল হইয়া উঠিতেছিল বটে।

চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক শৈশরককে রৌদ্রে ঘর্মায়মান শিক্ষার্থীগণের উপর বংশনির্মিত এক পাত্র হইতে পুষ্প-পাপড়ি বৃষ্টি করিতে দেখিলাম। তাহা দেখিয়া ভাষাকেন্দ্রের পরিচালক শৈশরক তাহাকে ইয়ার্কি দিয়া কহিলেন: 'বাড়াবাড়ি করিয়া কী লাভ?। বেতন কিছুমাত্র বাড়িবে না।' শুনিয়া চারুকলা শৈশরক হাসিয়া উত্তর করিলেন: 'আপনিই বা রৈাদ্রে গলদঘর্ম হইতেছেন কেন? আপিসের শীতাতপে বসিয়া থাকিলেইতো পারিতেন!' অতঃপর উভয় শৈশরক প্রকটক অধ্যাপক রব্বনীর সহিত আলোকচিত্রে স্থির হইয়া রৌদ্রতাপ উপেক্ষা করিয়া লাউড-স্পিকারে মহাধ্যক্ষ ঐকত্রজমনসহ একাধিক শিক্ষকনেতার বক্তৃতা শুনিতে লাগিলেন। চন্দ্রদ্বীপীয় উচ্চারণে মহাধ্যক্ষের গতানুগতিক বক্তব্যের সিংহভাগ জুড়িয়া ছিল সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এবং আমলক দলের ছাত্রশাখার ভূয়সী প্রশংসা। অন্য বক্তারাও তাঁহার সহিত কমবেশি একমত। একমত না হইয়াই বা উপায় কি! অর্বাচীন ইঙ্গরাজি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে: 'ধর্ষণ যখন অনিবার্য, তখন উপভোগ করাই শ্রেয়!' 'পরের মুখে শেখা এবং বাধ্য হইয়া পাখির মতো আওড়ানো' বুলিতে আকর্ষণীয় কিছুই থাকার কথা নহে। ইহা ছাড়া অর্বাচীন বাংলায় একটি প্রবাদও আছে: 'সকল জাম্বুকীর এক রা', অর্থাৎ অরণ্যবাসী জাম্বুকীগণ সাধারণত দুই রকম চিৎকার করে না।

গুপ্তচর নীরব হইলে চাণক্য ইঙ্গিতে তাহাকে নিষ্ক্রান্ত হইতে নির্দেশ দিলেন। ইহার পর চন্দ্রগুপ্তের দিকে স্থির দৃষ্টিপাত করিলে সম্রাট হাত কচলাইয়া ঈষৎ অপ্রস্তুতভাবে বলিতে লাগিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত: গুরুদেব, কী বলিব। আপনি আমার সহিত একমত হইবেন না জানি, তবু আপনাকে আগেও বলিয়াছি, এখনও বলিতেছি, উপদেষ্টা এবং কায়স্থগণের পরামর্শ আমাকে কমবেশি শুনিতেই হয়। তাহারা বলিতেছে, আমলকদলের বিশাল সব অর্জনের খবর জনগণের কর্ণে প্রবেশ করিতেছে না, অথচ নির্বাচন মহাসমর দ্বারে মুর্হুর্মুহু করাঘাত করিতেছে। এই কারণেই প্রধানত তাহাদিগের পরামর্শে এই সমাবেশ, র‌্যালি ইত্যাদি আয়োজনের নির্দেশ দিয়াছি, যাহাতে প্রথমত, জনগণ আমার অর্জনসমূহ সম্পর্কে জানে এবং দ্বিতীয়ত জনসমাবেশ দেখিয়া বিরোধী নেতৃবৃন্দের চক্ষু ধাঁধাইয়া যায়। আমি জানি, আপনি বলিবেন: 'খৈলদা কারারুদ্ধ হওয়ার পরও কোনো উচ্চবাচ্য হয় নাই, সুতরাং মাভৈ!' কিন্তু প্রভু, একটি ফরাসি প্রবাদ আছে: 'ঘুমন্ত জল হইতে ভয়ঙ্করতর কিছুই নাই!'

চাণক্য: চন্দ্রগুপ্ত, আমি জানি। যত উপদেশই আমি তোমাকে দিই না কেন, সারমেয়-পুচ্ছের মতো তোমার স্বভাব কস্মিন কালেও বদলাইবার নহে। তুমি এখন আর্যাবর্তের সম্রাট, কোনো এক কালের মত আর বালক নহ যে তোমাকে আমি আমার উপদেশমত কার্য করিতে বাধ্য করিতে পারিব। তবুও আমি যেহেতু এখনও তোমার গুরু, তোমাকে আমি উপদেশ দিবই, শোনা বা না শোনা তোমার ব্যাপার। আমার উপদেশে তুমি যে একেবারেই কর্ণপাত কর না, তাহাও আমি বলি না। এই বছর সপ্ত মার্চে মহান শাক্য মজ্জবের ভাষণ লইয়া খ্বু একটা বাড়াবাড়ি হয় নাই। শোন চন্দ্রগুপ্ত! মানুষ মাত্রেই যেমন মরণশীল, তেমনি সাম্রাজ্য মাত্রেই কমবেশি উন্নয়নশীল। ইহা ঢাক পিটাইয়া বলিবার মতো কোনো বিষয় নহে। একদা নিদ্রাকাতর এক গর্ভবতী কিশোরী তাহার মাতাকে বলিয়াছিল: 'মাতঃ, প্রসবব্যথা উঠিলে আমাকে জাগাইয়া দিতে ভুলিও না।' মাতা উত্তর দিয়াছিল: 'ব্যথা উঠিলে তুই নিজেই আমাকে ঘুমাইতে দিবি না!' একইভাবে বাংলাদেশ যখন প্রকৃতই উন্নয়নশীল কিংবা উন্নত হইবে তখন কাহারও সনদের প্রয়োজন হইবে না।' তোমার পিতা মহান শাক্য মজ্জব কি সপ্ত মর্চের ভাষণ দিবার পূর্বে বিদেশিগণের সনদ কিংবা স্বীকৃতির অপেক্ষা করিয়াছিলেন? যে সাম্রাজ্যের রাস্তায় তুমি এখনও লাল ও সবুজ বাতি দিয়া গাড়ি চালাইতে সক্ষম হও নাই, যাননিয়ন্ত্রণ করিতে অসংস্কৃত সড়করক্ষীদের যে সাম্রাজ্যে হাত-পা ছুঁড়িতে হয়, সেই সাম্রাজ্য উন্নয়নশীলতার সনদ পাইলেই বা কি? বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা বিদ্যালয়ে। অথচ তোমার সাম্রাজ্যে বিদ্যালয়ের সন্মুখের রাস্তায় পথকলিরা এখনও ভিক্ষা করিতেছে। রাস্তায় একটা ডাস্টবিন নাই। লোকজন, এমনকি তোমার শিক্ষক-বিচারক-আমলারাও ইচ্ছামতো যেখানে সেখানে নোংরা ফেলে। যে সাম্রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নিয়োগে কোটি কোটি টাকা উৎকোচের লেনদেন হয়, সেই সাম্রাজ্য উন্নয়নশীল – ইহা পাগলেও বিশ্বাস করিবে না, যতই তুমি বিদেশীয় সংস্থা হইতে সনদ আনয়ন কর না কেন।

আর সনদ পাইলেই বা কি? তোমার শিক্ষামাত্যের অবিমৃশ্যকারিতায় ফাঁসহওয়া প্রশ্নের জবাব দিয়া সনদ পাইয়া যাহারা বিচারক, অধ্যাপক, ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়র হয় তাহাদের উপর সম্পূর্ণ আস্থা কি কেহ রাখিতে পারে? রাখিতে যে পারে না, তাহার প্রমাণ, তোমার সাম্রাজ্যের অমাত্যেরা সর্দিকাশি হইলেও সিংহপুরে চলিয়া যায়, দেশীয় কোনো হাসপাতালে ভর্তি হইবার সাহসমাত্র করে না। চন্দ্রগুপ্ত, তুমি ও তোমার উপদেষ্টাগণ মিলিয়া দিবাস্বপ্ন দেখিতেছ, ঠিক আছে, কিন্তু জনগণকে দিবাস্বপ্ন দেখাইবার চেষ্টা করিও না। দুর্নীতি, যানজট, মূল্যবৃদ্ধি, বিমানদুর্ঘটনাসহ হাজারো প্রাণান্তকর ঝামেলায় তাহাদের প্রাণ এতটাই ওষ্ঠাগত যে দিবাভাগে দূরে থাক, রাত্রিকালেও তাহাদিগের ঠিকমত নিদ্রা হয় না। জনগণ যদি অনিদ্রায় ভোগে তবে তুমি তাহাদিগকে স্বপ্ন দেখাইবে কী করিয়া?

চন্দ্রগুপ্ত, প্রকৃত উন্নয়ন হয় মানুষের মননে ও আচরণে এবং এই উন্নয়ন সাধন করিতে অন্য অনেক অপরিহার্য উপাদানের সহিত সময়েরও প্রয়োজন হয়। স্থান-কাল-পাত্র। কাল উন্নয়নের একটি প্রধান নিয়ামক। কর্মারের মহা-হাতুড়ির প্রচণ্ডাঘাতে নয়, স্বর্ণকারের ক্ষুদ্র হাতুড়ির টুকটুক আঘাতেই সকলের অগোচরে সমাজ ও সাম্রাজ্যের প্রকৃত উন্নয়ন হইয়া থাকে। কার্যকর উন্নয়ন কাহারও সনদের অপেক্ষা করে না। যে কয়েক শতকের মননচর্চার ফলশ্রুতিস্বরূপ পাশ্চাত্য আজ উন্নত হইয়াছে, আর্যাবর্তের জনগণ সেই কয়েক শতক আহার-নিদ্রা-মৈথুন ছাড়া আর কিছুই করে নাই। উন্নয়ন বালকের হাতের মুড়কি-পি- নহে। উন্নয়ন একটি শাঁখের করাত। না করিলেও সমালোচনা করিতে ছাড়িবে না, কিন্তু উন্নয়ন করিলেই কি জনগণ তোমাকে সমর্থন করিবে? দুর্জনেরা বলিবে, উন্নয়ন করাইতো সম্রাটের কাজ। উন্নয়ন করার জন্যেইতো তাহাকে ক্ষমতার সিংহাসনে বসানো হইয়াছে।

সাবধান চন্দ্রগুপ্ত। শীতকালের ওয়াজ গরমকালে করিবার চেষ্টামাত্র করিও না। তুমি এবং তোমার পারিষদবর্গ হয়তো খেয়াল কর নাই, রাজনীতি ও প্রচারের ধরণ পাল্টাইয়া গিয়াছে। এখনকার নেতা আর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা ও কর্মকাণ্ড দেখিয়া তরুণ সমাজ হাস্য সংবরণ করিতে পারে না। সাম্রাজ্যকে যদি উন্নয়নশীল বলিয়া আসলেই তুমি বিশ্বাস কর, তবে কেন বিস্মৃত হও যে সাম্রাজ্যের জনগণের বিবেচনাশক্তিও উন্নয়নশীল? অনাগত যুগের বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ একদিন লিখিবেন: 'কত বড় কহে আমি নকল হীরাটি। তাইত সন্দেহ করি, নহ ঠিক খাঁটি!' আমি তোমাকে ইহার পূর্বেও বলিয়াছি, ষাট-সত্তর-আশি-নব্বই দশকের মতো জনসমাবেশ কিংবা গলাবাজি করিয়া জনগণকে তুমি সাতপাঁচ চৌদ্দ বুঝাইতে পারিবে না, বরং শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণের বিরক্তি উৎপাদন করিবে মাত্র। সাম্রাজ্যের জনগণ সামাজিক মিডিয়ার কারণে ইদানিং অনেক বেশি সচেতন। তুমি ঢাক পিটাইয়া বলিলে লোকে বাধ্য হইয়া শুনিতে পারে বটে, কিন্তু বিশ্বাস করিবে না। তাহারা দৃষ্টিতে কৌতুকের আবহ নিয়া জনান্তিকে মুচকি হাসিবে এবং প্রতিটি হাসিতে তোমার বালখিল্য কার্যক্রমের হাস্যকর দিকটি প্রকাশিত হইবে। তাহারা মুখে বলিবে: 'হাসি না!', হাসিবেও না, অথচ তাহাদের চোখেমুখে সমালোচনামূলক হাসি জাজ্বল্যমান হইবে। এইসবের ফলশ্রুতিতে তোমার সমর্থন কমিবে। তোমার সমর্থন কমা মানেই বিরোধীদলের সমর্থন বাড়া, সেই বিরোধীদল অতীতে যত অপকর্মই করিয়া থাকুন না কেন।

শুধুমাত্র গুজবের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে সামাজ্য ধ্বংস হয়। অর্থপূর্ণ মুচকি হাসিও সামাজ্যের পতনের অন্যতম নিয়ামক হইয়া উঠিতে পারে। মুচকি কিংবা হাহা, কোনো হাসিই গায়ের জোরে সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস করা যায় না। সুতরাং এমনভাবে সাম্রাজ্য পরিচালনা কর, যাহাতে কাহারও ওষ্ঠে তৃতীয়া তিথীর চন্দ্রের মত মুচকি হাসি ফুটিয়া না উঠে। তাহা বলিয়া জোর করিয়া কাহারও হাসি বন্ধ করিতে আমি তোমাকে বলি না। আমার উপদেশ: প্রকৃত এবং কার্যকর উন্নয়ন করিতে চেষ্টা কর। কার্যকর উন্নয়নের মুখোমুখি হইয়া মানুষ কখনই হাসিতে সক্ষম হয় না, নিজের অজ্ঞাতসারে সম্রাটকে সমর্থন করিতে বাধ্য হয়। বৎস চন্দ্রগুপ্ত, বুকে হাত দিয়া বল দেখি, যে উন্নয়নের দাবি তুমি করিতেছ, তাহার কতভাগ টেকসই এবং কতভাগ শ্রেফ অপচয়? জানিতে চেষ্টা কর, এখনও সময় আছে। সম্প্রতি লক্ষ লক্ষ পৌস্টর-ফৈস্টুন তৈয়ার করিতে যে কোটি কোটি মুদ্রার অপচয় হইল, সেই অর্থ সাম্রাজ্যের উন্নয়নে ব্যয় করিলে উত্তম হইত না কি?

চন্দ্রগুপ্ত, অধ্যাপক শৈশরকের মুখে শুনিয়াছি, একদা তাহার শৈশবে জৈয়হর্মন নামক এক পাতাবাহার রাষ্ট্রপতি শকটস্থ হইয়া রাজপথ দিয়া গমন করিবার সময় চৈত্যগ্রামের কুমারিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বালক-বালিকাগণকে রাস্তার দুই পার্শ্বে ঠাঠা রৌদ্রে দণ্ডায়মান করিয়া ক্লান্তিহীনভাবে হস্ততালি দিতে বাধ্য করিয়াছিলেন, যাহাতে জৈয়হর্মন পুলকিত হইয়া রাষ্ট্রীয় কোষাগার হইতে তাহাদিগের বিদ্যালয়ফন্ডে দুই চার পয়সা খয়রাৎ করিয়া যান। প্রচণ্ড রৌদ্রতাপে শারিরীকভাবে দুর্বল বালক শৈশরক সংজ্ঞা হারাইয়া ভূমিতে পতিত হইলে দণ্ডায়মান হওয়ার কর্তব্য হইতে সে কোনমতে নিষ্কৃতি পাইয়াছিল। কাকতালীয়ভাবে সেই রাত্রেই চট্টগ্রামের সর্কিট হউজে জৈয়হর্মনকে নির্মমভাবে হত্যা করিয়াছিল একদল বিদ্রোহী সেনা।

কীসে যে কী হয়, আমি জানি না চন্দ্রগুপ্ত। কোনো এক উন্মাদ হিপি একবার প্রশান্ত মহাসাগরে প্রশ্রাব করিয়াছিল এই আশায় যে অতলান্তিক সাগরের জল কিছুটা হইলেও বৃদ্ধি পাইবে। উন্মাদে কী না করে! কিন্তু কোন দূরবর্তী পাপ কীভাবে, কখন, কোথায়, কাহাকে স্পর্শ করে, তাহা মানববুদ্ধির অগোচর। একান্ত নিজ স্বার্থে সাম্রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত, আক্কেলবান নাগরিককে তাহাদিগের অনিচ্ছায় প্রখর রৌদ্রে একটি ঘণ্টা বে-আক্কেলের মতো ঠায় দণ্ডায়মান রাখা কোনোমতেই যে কোনো সম্রাটের জন্যে মহাপূণ্যের কাজ বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না – এইটুকু বোঝার ক্ষমতা আশা করি এখনও তোমার কিংবা তোমার উপদেষ্টা-অমাত্য-সচিবগণের আছে।