অতিক্রান্ত স্বাধীনতা দিবস: কেমন দেশ চাই আমরা?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 27 March 2018, 01:26 PM
Updated : 27 March 2018, 01:26 PM

স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হলো সমারোহে। এমন সমারোহ বা উদযাপনের ঘটায় মনে হতে পারে সবাই আসলে স্বাধীনতার মূল্য বোঝেন বা দেশের প্রত্যেক মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধ গভীর ভাবে প্রোথিত? আসলে কি তাই?

সাতচল্লিশ বছর পর ও আমরা যদি মূলে হাত না দেই আর সত্য না বলি সমস্যা কখনোই যাবেনা। তাছাড়া বায়বীয় মূল্যবোধ বা বায়বীয় সামাজিক মিডিয়ার আড়ালে যে সত্য তাকে খুঁজে বের করতে না পারলে একদিন তার চরম মূল্য দিতে হবে। দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমি বালক। আমার স্মৃতিতে স্পষ্টভাবে গেঁথে আছে সেই দিনগুলি। যে অপার উৎসাহ আর পাকি ঘৃণায় মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার সামনে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

মাঠে ছিলেন তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলদের মত নেতারা। ময়দানে ছিলেন যুবক অগ্রজেরা- যুবতী বোনেরা। আর পেছনে ছিলেন এদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ। এই মধ্যবিত্তই মূলত নির্ণায়ক। তারা ঝুঁকি না নিলেও মুক্তিযুদ্ধ চেয়েছিলেন বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। মুনতাসীর মামুন যে বলেন, 'বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীন করে গেছেন'- আমি এটা মানিনা। অনিচ্ছুক নয় মূলত দোদুল্যমান একটি জাতিকে তিনি সঠিক পথে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু এটা মানি সেই দোদুল্যমান পেন্ডুলামের কাঁটাটি আজ আবার সাতচল্লিশ বছর পর ১৯৪৭ এর দিকেই যেন ঝুঁকে আছে। যেখানে আছে পাকিস্তান ভাঙার বেদনা, ধর্ম এবং ভারত বিদ্বেষের মত কঠিন বিষয়। তারসাথে যোগ হয়েছে সংখ্যালঘু নামে পরিচিত মানুষের প্রতি অবজ্ঞা।

একটা ব্যক্তিগত ঘটনার কথা বলি। কয়েকবছর আগে দেশের একটি নামকরা টিভি চ্যানেলে গিয়েছিলাম আড্ডা দিতে। সেখানে শীর্ষপদে থাকা আমার বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের চিনি কৈশোর থেকে। সে দুপুরে আমাকে দেখে অনেকদিন পর মিলিত হয়ে তারা যে পরিমাণ খুশি হয়েছিলেন এবং আপ্যায়ন ও সৌজন্য দেখিয়েছিলেন তা কখনো ভোলার নয়।

কিন্তু সে আড্ডায় হঠাৎ করেই ভরা মজলিশে ঠাট্টার নামে আমাকে জব্দ করার জন্য প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমি দেশে আসার আগে আমার কলকাতার বাড়িটা দেখে এসেছি কি না? আমি একটুও থতমত খাইনি। কারণ আমি জানি কলকাতায় আমার বাড়ি আছে কি নাই। যৌবনে দু একবার পড়ার জন্য এমনকি চলে যাবার জন্য সেখানে পাঠানোর চিন্তা করেছিলেন কেউ কেউ। আমার মা এবিষয়ে কখনো সায় দিতেন না। তাঁর এককথা দেশে থাকবে। যা হবার এখানেই হবে। আর আমি বড় হতে হতে এই সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছিলাম আমি শরণার্থী বা কলকাতার তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে ফুটপাথে হকারি করা কিংবা সওদাগরী অফিসে কেরাণী হবার জন্য জন্মাইনি। ফলে মাকে এই প্রশ্ন করে কাবু করা সহজ ছিলো না।

আমি চটজলদি প্রশ্নকর্তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার লাহোরের বাড়িটির কি হাল? খুব অপ্রস্তুত আর বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন , আরে আমার কেন লাহোরে বাড়ী থাকবে? আমি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, তাহলে আমার কলকাতায় বাড়ি থাকার কী কারণ?

এই যে মানসিকতা এটাই আমাদের সমস্যা। আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাও মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন হিন্দুরা দুই নৌকায় পা রাখে বলেই বিপদ। এই দুই নৌকার এক নৌকার মাঝিরা যে ইচ্ছে হলেই নৌকা ডুবিয়ে তাদের মেরে ফেলে বা পানিতে ফেলে দেয়, তার কথা কিন্তু বলেননি। আর খালেদা জিয়া এবং তার দলের নীতিই হচ্ছে থাকলে পায়ের তলায় থাকো।

নয়তো যাবার সময় কন্যা জমি এগুলো রেখে যাও। এটা কেবল সংখ্যালঘু হিন্দুদের বেলায় না, দেশের চাকমা-রাখাইন-পাহাড়ি জনপদের সব আদিবাসীদের বেলায় সত্য। আজ এতবছর পর এই সত্য প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমানকেও ছেড়ে কথা বলছেনা। বলছেনা বলেই হুমায়ূন আজাদ থেকে রাজীব, দীপন হয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল আজ আক্রান্ত নিহত অথবা আহত। তাই প্রশ্ন জাগে এই স্বাধীনতাই কী চেয়েছিলাম আমরা? একাত্তরে আমাদের সাধনা ছিলো বাঙালি হবার। আর আজ?

ঢাকায় গল্প গদ্য লিখে পরিচিত একটি তরুণী বলেছিলো তার জীবনের ঘটনা। মেয়েটি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রবল অনুগত। এইদেশ এইজাতি এই সমাজকে আলোময় দেখতে চায় সে। কখনো ধর্মে বর্ণে ভাগ করেনা কাউকে। 'বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালি', লেখা একটি পোস্টার এনে লাগিয়েছিলো ঘরের দেয়ালে। একদিন তার স্বামী প্রবল আক্রোশে সেই পোস্টারটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। অসহায় মেয়েটি কারণ জেনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তার স্বামীর ধারণা এইসব নাস্তিক মার্কা পোস্টার ঘরে থাকার কারণে তার পাপ হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছেনা। কবে আমরা এমন বদলে গেলাম? কবে থেকে আমরা এমন জাতিতে পরিণত হলাম?  এখন তো এমন অবস্থা আপনি চাইলেও অনেক কথা বলতে পারবেননা। আওয়ামী লীগের দশ পার্সেন্ট নেতা কর্মী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন কি না এই প্রশ্ন করা যৌক্তিক হলেও আপনি তা করতে পারবেননা।

এত বছর পর ও আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে মীমাংসায় আসতে পারিনি। একটি জাতি বা দেশ কারো বাঁশির ফুঁয়ে স্বাধীন হয়, এমন আজগুবি তত্ত্বও এদেশের মানুষ খায়। শুধু খায়না, বিশ্বাসও করে। কাদের সিদ্দিকীর মত মুক্তিযোদ্ধা সবচেয়ে সেরা খেতাব পাওয়া রাজনীতিবিদও এ নিয়ে দ্বন্দ্বে ভোগেন।

এমন দিন খুব বেশি দূরে না তিনি বলবেন জিয়াউর রহমানের কারণেই তিনি কাদেরিয়া বাহিনী বা মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে দেখুন স্যুট টাই কোট পরা ব্যারিস্টার ড: কামাল হোসেন। যে বয়সে অনেকদেশে মানুষ পার্টির সদস্য পদ পায় সে বয়সে হয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। সংবিধান রচনায় ও তাঁর অবদান আছে। সেই তিনি ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছেন।

জনাব এ কে খন্দকার আমাদের বিজয় দিবসের সরকারি প্রতিনিধি। যিনি চোখে দেখেছেন কে কার কাছে কেন কীভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। সেই তিনিও জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আওয়ামী হালুয়া রুটির মন্ত্রিত্ব খাবার পর লিখলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ মূলত জনযুদ্ধ না সামরিক যুদ্ধ।' যার মানে ঝোলটা যাবে জিয়াউর রহমানের পাতে। বা জাতীয়তাবাদীদের প্লেটে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব আমাদের বীর অবীর মুক্তিযোদ্ধা অমুক্তিযোদ্ধা সবাই চল্লিশ অবদি থাকবেন নির্ভীক স্বাধীনতাকামী? এরপর আস্তে আস্তে হবেন জাতীয়তাবাদী আর মরার আগে পাকিস্তানের প্রতি অনুরাগ আর দেশভাঙার শোক ও মরণের ভয়ে  মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী?

খেয়াল করবেন স্বাধীনতার চেতনাকে নামিয়ে আনা হয়েছে কিছু আনুষ্ঠানিকতায়। স্কুল কলেজ বা যেসব জায়গায় বাধ্যতামূলক এসব অনুষ্ঠান করা হয় বা করতে হয় তাতে আন্তরিকতা থাকে ন্যূনতম। এগুলো মূলত চাকরি বাঁচানো আর কর্তব্যের অংশ। এভাবে কি চেতনা বজায় থাকে? না ধরে রাখা যায়? দেশে গিয়ে দেখেছি সবাই আরামে আছেন। টাকা পয়সার অভাব নাই । ভালো খাওয়া দাওয়া ভালো পোশাক বছরে বেড়াতে যাওয়া সব চলছে। তারপরও অভিযোগ।

রাস্তায় জ্যাম, লেখাপড়ার মান খারাপ. ঘুষ-দুর্নীতি বা চুরি ডাকাতি, সবদোষ দেশের। নিজেরা অপরিকল্পিতভাবে মানুষ বাড়িয়ে  দেশকে দু:সহ করে তুললে তা নিয়ে কথা নাই। নিজেরা চরিত্র না বদলালেও কথা নাই। নিজেরা ভালো থাকার নামে ঘুষ দুর্নীতিতে ডুবে থাকলেও ঠিক আছে। যত দোষ নন্দ ঘোষ। দেশে তো বটেই, বিদেশেও দেখছি রবীন্দ্রনাথের গান করেন, নজরুলের কবিতায় উদ্বেলিত বা জীবনানন্দের নামে আকুল মানুষের মনে সন্দেহ। শেখ হাসিনা ভারতের পাপেট। দেশ চালাচ্ছে অন্য দেশ।

জঙ্গি বা সন্ত্রাস হলে তার দায় আমেরিকার।  ভিন্ন দেশ বা আইএস জাতীয় চক্রান্ত ছাড়া নিজেদের কোন দোষই দেখতে পাননা তারা। এই মানসিকতাই কী বাংলাদেশের প্রোডাক্ট ?

একদল লোক রাজনীতিকে গালাগাল করার নামে মূলত আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করার কাজে অক্লান্ত। এরাই আমাদের সমাজে সুশীল। সাথে জুটেছে নতুন আপদ সামাজিক মিডিয়া। এই সামাজিক মিডিয়া ধর্মের নামে এমন সব কাজ করে যাতে মানুষের জীবনই আজ হুমকির মুখে। যে ধর্ম কাল ধরে যুগ যুগ ধরে আমাদের শান্তি ও সহাবস্থানের পথ দেখিয়েছে শিখিয়েছে তাকে এরা বিপদে ফেলতেও কসুর করছেনা। দেশের মানুষের মনে তাই একটাই প্রশ্ন, কবে তারা শান্তিতে নিরাপদে থাকার একটা দেশ পাবেন?

অথচ আজকের বাংলাদেশ একটু উন্নয়নশীল দেশ।  আমাদের যৌবনে জন্মভূমি ছিলো আরেক ধরনের। আমাদের পোশাকের ঠিক ছিলোনা। একটি ব্যালবটম প্যান্ট সেলাই করতে দিয়ে সারারাত জেগেছিলাম সকালে পাবো বলে। হাতে গোণা কয়েকটি শার্ট আর দুয়েক জোড়া মাঝারি মানের জুতো। আমাদের বাবাদের চশমার কাঁচ খালি পুরু হতো। কপালের ভাঁজ হতো দুশ্চিন্তায় ঘন। যাদের বাড়িতে একাধিক কন্যা তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিলো কীভাবে মেয়ের বিয়ে হবে। চাকরী ছিলো সোনার হরিণ।

আজ যারা আমাদের দেশকে উন্নতশীল বা সমৃদ্ধ বলছে সেদিন তাদের চেহারা ছিলো ভিন্ন। তারা আমাদের শুধু তলাবিহীন ঝুড়ি বলেননি ফকির ভিখারি ডাকতেও কসুর করতেন না। তাদের ফেলে দে্য়ও পোশাক বর্জ্য দুধ, ব্যবহৃত প্রসাধনী দিয়ে বড়লোক বা আধুনিক সাজতে হতো আমাদের। আমাদের দেশ টিকবে কি না, এনিয়ে কত তত্ত্ব আর কত উপদেশ! বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর এমনও ধারণা করা হয়েছিল পাকিস্তানে ফেরার খুব বেশি দেরি নাই আর। অথবা ছায়া পাকিস্তান হতে চলেছি আমরা।

আজকের বাংলাদেশ আরেক চেহারার। তার গায়ে এখন উন্নয়নের জোয়ার। কলকাতা গেলেই বুঝতে পারি কতটা ভালো আছে দেশের মানুষ। সুখ বা শান্তির কথা বলছিনা। তাদের পোশাক খাবার কিংবা জীবনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাংলাদেশে আর যাই থাক টাকার অভাব নাই। যে টাকা ছিলো স্বপ্ন সে টাকা আজ বাতাসে উড়ছে। আমি এমন কাউকে দেখিনি যার হাতে টাকা নাই। এটা বলতেই হবে আওয়ামী লীগের সরকার বাংলাদেশের চেহারা ফিরিয়ে দিয়েছে। বিশেষত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে উন্নত ও মর্যাদার আসন লাভ করেছে।

তারপর ও কেন এই বাস্তবতা? কেন এখনো সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা? মুখে আচরণে আওয়ামী, ভোটে ধানের শীষ আর অন্তরে জামাত? একথা বলছিনা বিএনপি বা জামাত করা যাবেনা। নিশ্চয়ই যাবে। তারা যতদিন রাজনীতিতে আছে থাকবে ততদিন সমর্থনও করা যাবে।

কিন্তু তার আগে কয়েকটা বিষয়তো নিশ্চিত হতে হবে। ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ সমাজের চেহারা বা প্রগতিশীলতা এগুলো আমরা আসলে চাই কি না? চাইলে হানাহানি বন্ধ করে শান্তিতে থাকার পথ তৈরি হোক। আর না চাইলে কি তার সমাধান তা ঠিক করুক দেশের বুদ্ধিজীবী বরেণ্য মানুষেরা বা রাজনীতিবিদেরা। আমরা আমাদের দেশপ্রেম আর স্বদেশের মঙ্গল চাই। তার অপমান আর দেখতে চাইনা। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও এগিয়ে চলা নিশ্চিত করতে কেমন দেশ চাই সেটা ঠিক করা এখন জরুরি।