কাদের সিদ্দিকী: একজন পচে যাওয়া মানুষের কাহিনি!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 23 March 2018, 03:07 PM
Updated : 23 March 2018, 03:07 PM

''আমাদের দেশে খালি নারী নারী আর নারী। এই দেশে আল্লাহর রহমত বর্ষণ হতে পারে না। আল্লাতালা নারী সৃষ্টি করার পর থেকে আল্লাতালার নিজের উপর থেকেই নিজের রহমত উঠে গেছে। কাজেই রহমতের বর্ষণ পেতে হলে এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।'' এটা কোনো কাঠমোল্লার মন্তব্য নয়, জামায়াতে ইসলামীর কোনো নেতার বয়ান নয়, এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক 'মহানায়ক', 'বঙ্গবীর' খ্যাত কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকীর অমিয় বাণী!

''মানুষ মরে ফেলে পচে যায়, আর বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়'', শহিদ মুনীর চৌধুরী লিখেছিলেন 'রক্তাক্ত প্রান্তর' নাটকে। আমরা আপাতত দেখছি একজন 'বেঁচে থাকা' মানুষের 'বদলে যাওয়া' এবং পচে যাওয়া! একদা মহামহিম বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিটি বাংলাদেশে কেবল নারী আর নারী দেখেন আর এই পরিস্থিতিতে দেশের কোনো ভবিষ্যৎ দেখেন না। তার ধারণা, 'পুরুষের শাসন' কায়েম না হলে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে পারে না!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবাধ্য বা নাফরমানও আখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আলাদা দল গঠন করা এই রাজনীতিক। বলেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে চলা যায় না! নারী নেত্রীর অধীনে থেকে দীর্ঘদিন রাজনীতি করে আসা কাদের সিদ্দিকী এখন নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন! কাদের সিদ্দিকীর মুখে এ ধরনের কথা শুনলে সত্যিই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না। কারণ আমরা একদা যে কাদের সিদ্দিকীকে চিনতাম, তার সঙ্গে এই কাদের সিদ্দিকীকে কিছুতেই মেলানো যায় না!

বরেণ্য সাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদ 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে কাদের সিদ্দিকীকে চিত্রিত করেছেন এভাবে, ''ষোলই ডিসেম্বর ভোরবেলা কারফিউ দেয়া শহরে দুটি গাড়ি যাচ্ছে। সেদিন নগরী ঘন কুয়াশায় ঢাকা। রাস্তা জনশুন্য। গাড়ি দুটি যাচ্ছে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের হেড কোয়ার্টারের দিকে। প্রথমটা জিপ। সেখানে বসে আছেন মেজর জেনারেল জামশেদ। দ্বিতীয়টা পতাকা উড়ানো স্টাফ কার। এখানে আছেন ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। লম্বা চুল-দাড়িতে কাদের সিদ্দিকীকে দেখাচ্ছে চে গুয়েভারার মত।

নিয়াজী প্রতীক্ষা করছিলেন। জেনারেল নাগরা ঘরে ঢোকার মাধ্যমেই সেই প্রতীক্ষার অবসান হলো। নিয়াজী নাগরাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বিড়বিড় করে কাঁদতে কাঁদতেই বললেন-"আমার আজকের এই অপমানের জন্য দায়ী রাওয়ালপিন্ডির বাস্টার্ডরা।"

নিয়াজীর ফোঁপানো একটু থামতেই জেনারেল নাগরা তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটির সঙ্গে নিয়াজীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। শান্ত গলায় হাসি হাসি মুখে বললেন, এই হচ্ছে সেই টাইগার সিদ্দিকী।

জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জামশেদ অবাক হয়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে। তাদের স্তম্ভিত ভাব কাটতে সময় লাগলো। এক সময় নিয়াজী করমর্দনের জন্য তার হাত বাড়িয়ে দিলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে। কাদের সিদ্দিকী হাত বাড়ালেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, "নারী ও শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে আমি করমর্দন করিনা!''

হ্যাঁ, বাংলাদেশের অনেক মানুষের কাছেই কাদের সিদ্দিকী একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। সত্যিকার অর্থেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উজ্জ্বল নায়ক। বাংলাদেশের মানুষ ভালোবেসে তাকে বাঘা সিদ্দিকী নাম দিয়েছে। দিয়েছে বঙ্গবীর উপাধি। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার তাঁর অবদানের স্বীকৃতি দিতে তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিয়েছে। বিদেশি লেখকেরা তাঁকে নিয়ে লিখেছে উপন্যাস। সে উপন্যাস পড়ে নতুন প্রজন্মের অনেক বাঙালি সন্তান দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছেন। বাঘা সিদ্দিকীর প্রতি আত্মিক-বন্ধন অনুভব করেছে। মনে মনে তাঁকে বসিয়েছে নায়কের আসনে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরও তিনি সশস্ত্র লড়াই চালিয়েছিলেন। আর এ কারণে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকেন। ১৯৯১ সালে গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দেয়ার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকী তাঁর 'বীর উত্তম' খেতাব বর্জন করেন। আমরা মুগ্ধ হই!

২০০৫ সালে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপে স্বাধীনতাবিরোধীদের দল জামায়াতকে সরকার ও জোট থেকে বহিষ্কারের জন্য সময় বেঁধে দেন। ২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগের নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী নির্বাচন কমিশনকে প্রথম প্রস্তাব দেন, নির্বাচনে যেন যুদ্ধাপরাধীদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এরশাদ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মেনে আওয়ামী লীগের হয়ে রাজনীতি চালিয়ে যান কাদের সিদ্দিকী। সে সময় তিনি খালেদা জিয়ার কট্টর সমালোচক ছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও ১৯৯৬ সালে টাঙ্গাইলে একটি আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন। পরে সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় তার বাড়িতে পুলিশে তল্লাশির ঘটনায় আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষিপ্ত হন এবং ১৯৯৯ সালে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে আলাদা দল গঠন করেন। এর পর থেকেই শুরু হয় তাঁর বদলে যাবার ইতিহাস!

এমন একজন মানুষ এক জীবনে, কতোটা, ঠিক কতটো বদলাতে পারে? কতোটা অধঃপতিত হতে পারে? হ্যাঁ, গত দেড় দশক ধরেই আমরা কাদের সিদ্দিকীর অধঃপতনই কেবল দেখছি।

২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপির সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে নির্বাচন করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। তার পর থেকেই শুরু হয় বেগম জিয়া ও জামায়াতে ইসলামের প্রতি তাঁর মোহাবিষ্টতা।

আর্থিক দুর্নীতির খবরের শিরোনাম হয়ে তিনি প্রথম আমাদের চমকে দেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, টাঙ্গাইলে সেতু, সড়ক আর হাসপাতাল ভবন নির্মাণের মতো নয়টি জরুরি উন্নয়ন কাজ বছরের পর বছর ফেলে রেখেছে সোনার বাংলা প্রকৌশলী সংস্থা লিমিটেড। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কাদের সিদ্দিকী। কাজ শেষ করার নির্ধারিত সময়ের পর ক্ষেত্রবিশেষে এক থেকে ১১ বছর পার হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোনো অনুরোধ বা চাপ তিনি বিবেচনায় নেননি। কিনতু সাড়ে ২৩ কোটি টাকার এসব উন্নয়নকাজ আংশিকভাবে সম্পন্ন করে তিনি প্রায় ১৩ কোটি টাকা বিল তুলে নিয়েছেন।

তাঁর চরম অধঃপতনটি আমরা দেখতে পাই যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত কাদের মোল্লার রায়ের পর। কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার মুক্তি দাবি করে তিনি বিবৃতি দেন। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর কমান্ডার মাওলানা নিজামীরও তিনি মুক্তি দাবি করেন। দিগন্ত টিভিতে রাজাকার মীর কাশিমের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করলেন। হঠাৎ পক্ষ বদলিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কোলে আশ্রয় নিলেন। নিয়মিত দিগন্ত টিভিতে অংশ নিয়ে, নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকায় কলাম লিখে তিনি রাজাকারদের পক্ষে ওকালতি শুরু করলেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে 'রাজাকারের কমান্ডার' বলার ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখিয়েছেন। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে মিথ্যাচার এবং ভর্ৎসনা করেছেন।

জামাত-শিবিরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শাপলা চত্বরে গণহত্যার অভিযোগ করেছেন। জামায়াত কে এদেশে রাজনীতি করতে দেয়ার পক্ষে সাফাই গেয়ে কলাম লিখেছেন (দ্রষ্টব্য : "প্রধানমন্ত্রী হত্যার ষড়যন্ত্র–৩", ৮ ডিসেম্বর ২০১১, দৈনিক আমার দেশ)!

মনে পড়ে যায় পত্রিকায় দেখা সেই বিখ্যাত ছবিটির কথা! ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে কাদের সিদ্দিকী রাজাকার সন্দেহে ধৃত বিহারীকে নিজ হাতে হত্যা করছেন! খুব জানতে ইচ্ছা করে চল্লিশ বছরে একজন মানুষের চিন্তা-চেতনা পুরোপুরি উল্টে যায় কীভাবে?

একজন অর্থআত্মসাৎকারী, রাজাকার ও মোল্লাতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানো এই কাদের সিদ্দিকী আমাদের কাছে বড়ই অচেনা! যে কাদের সিদ্দিকীর নাম শুনে শ্রদ্ধায় বুক ফুলে যেত, সে কাদের সিদ্দিকীর নাম শুনলে এখন মনের ভিতর একটা তীব্র ঘৃণার জন্ম হয়। হুমায়ূন আজাদের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে- ''একজন রাজাকার সবসময়ই রাজাকার কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা সবসময় মুক্তিযোদ্ধা নয়।'' কাদের সিদ্দিকীর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার এমন পরিণতিতে সত্যিই খুব আফসোস হয়!

প্রতিটি বস্তুর যেমন মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকে তেমনি কালের আবর্তে মানুষেরও মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইদানিং প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী মানুষেরা পচে গিয়ে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধার্মিক মোল্লায় পরিণত হয়। হুমায়ুন আজাদের কথাগুলোকে নির্মমভাবে সত্য প্রমাণ দিয়ে চলেছেন টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী।

একদা মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু পরবর্তী সময়ে পচা-গলা নষ্ট হয়ে যাওয়া একমাত্র মানুষ হিসাবে তিনি নিশ্চয়ই ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন!

পুনশ্চ: পরিশেষে কবি সুবোধ সরকারের ভাষায় কাদের সিদ্দিকীকে বলি:

''শুনুন একটি মেয়ে কী পরবে, কীভাবে হাসবে, কোথায় দাঁড়াবে

সেটা তাকেই ঠিক করতে দিলে ভালো হয়

পুরুষ যন্ত্রটি আপনার, আপনি নিজেই ওটার দায়িত্ব নিন। (ধর্ষণ)