ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সময়

মুনতাসীর মামুন
Published : 19 March 2018, 04:11 PM
Updated : 19 March 2018, 04:11 PM

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন টুলু যার পোশাকি নাম সঈদা কামাল। আমাদের সবার খালাম্মা সুফিয়া কামালের কনিষ্ঠা কন্যা। তখন ফেরদৌসী থাকতেন তাঁদের বাসার পাশে। টুলু বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, তাদের পাশের বাসায় এক মহিলা থাকেন, তিনি কাঠ, গাছের টুকরো দিয়ে ভাস্কর্য করেন, দেখার মতো। তা আমি একদিন দুপুরে গেলাম সেই বাসায়। ফেরদৌসীই দরজা খুলে দিলেন। তাঁর স্বামী আহসানউল্লাহ যিনি আমাদের কাছে বিয়ার ভাই নামে পরিচিত তিনি ছিলেন বোধহয় তখন অফিসে। আমি ঘুরে ঘুরে গাছের টুকরো দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ভাস্কর্য দেখলাম। তারপর চলে এলাম। আমি তখনও তার সম্পূর্ণ পরিচয় জানতাম না যা আজ সবাই জানেন।

ফেরদৌসী আমাদের একজন হয়ে উঠলেন যখন তিনি নির্মূল কমিটিতে যোগ দিলেন। এর আগে নির্মূল কমিটির এক বিরাট সভায় তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, বিয়ার ভাইয়েরও। সবাই তাঁর কাহিনী শুনে অভিভূত আর বিয়ার ভাইকে দেখে মুগ্ধ। তারপর থেকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীক হয়ে উঠলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। নির্মূল কমিটির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ যত নিবিড় হলো ততো শাহরিয়ার, মুকুল আর আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো। শাহরিয়ারকে তিনি মামা বলতেন, আমাকে ভাই। আর আমি তাঁকে ডাকতাম আপা বলে। আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আমার কন্যা রয়া ছিল তার প্রিয়, রয়া তাকে ডাকতো চাচি বলে, নিজেই একলা প্রয়োজনে তার কাছে যেত। আমার সঙ্গে যখনই দেখা হতো, তখনিই আমার স্ত্রী ফাতেমা আর কন্যা রয়ার কুশল জিজ্ঞেস করতেন। তিনি বিভিন্ন বাসা বদল করে ধানমণ্ডির তিন নম্বরে সুন্দর একটি তলায় ভাড়া পেয়েছিলেন। দীর্ঘদিন সেখানে ছিলেন। আমি যখন ধানমণ্ডিবাসী হলাম তখন যখনিই সময় পেতাম তখনই যেতাম তাঁর বাসায়। তখন ফেরদৌসী আপার চেয়ে বিয়ার ভাইয়ের সঙ্গেই আলাপ হতো বেশি। একবার গেছি তার বাসায়। তখন তিনি গাছের গুঁড়ি দিয়ে একসেট বসার আসন তৈরি করেছিলেন। আমি তখন থাকতাম ইস্পাহানি কলোনির গাছগাছালিতে ঢাকা ছোট এক বাসায়, চিন্তা করলাম, বারান্দায় এই তিনটি আসন থাকলে নিসর্গের সঙ্গে মানিয়ে যাবে। আমি মাঝে মাঝে সেখানে সকালে বা বিকালে বসে পাখির ডাক শুনতে পাবো, বকুল ফুলের ঝরে পড়া দেখতে পাব। আমি বললাম, 'এই সেটটি আমার পছন্দ হয়েছে। আমি সংগ্রহ করতে চাই।'

'নিশ্চয়, এখুনি নিয়ে যান।'

'কতো দিতে হবে, তাতো বলবেন, তারপর তো দেয়া নেয়া।'

'টাকার প্রশ্নই আসে না', বললেন আপা, 'এসেই আপনার টাকার কথা যদি বলেন, তা'হলে আমি খুব দুঃখ পাব। আপনি নিশ্চয় আমাকে দুঃখ দিতে চান না।'

বিপাকে পড়লাম। তিনি শিল্পী, এ ধরনের একেকটি শিল্পকর্ম তৈরি করার খরচ আছে। আর তখন এটিই তাঁর জীবিকা। আমি বললাম, 'খরচটা তো নেবেন।'

তিনি বললেন, 'এ নিয়ে একটি কথা বললে আমার সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না।' আমিতো চাই না তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হোক। সেই সোফা সেটটি এখনও আমার ড্রইংরুমে আছে। সেটি দেখলেই এখন তাঁর কথা মনে পড়ে।

নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি ছিলেন। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সভা সমিতিতে তিনি গেছেন যখন সচল ছিলেন। এভাবে তিনি পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন একজন ভাস্কর হিসেবে এবং বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক হিসেবে।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জীবন সুখের ছিল না। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী 'নিন্দিত নন্দন' পড়লে তা বোঝা যায়। খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন। তিন সন্তানের জননী হয়েছিলেন। তাঁর পরিবার সেটি ভালোভাবে নেয়নি। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অর্থকষ্ট ছিল। ছোট চাকরি নিয়েছিলেন খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলে। যুদ্ধের আগে পরিচয় ও প্রেম হয় বিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে। তারপর আটকে পড়েন কর্মক্ষেত্রে। তারপর নির্যাতিত হতে থাকেন পাকিস্তানি অফিসারদের দ্বারা। সেই অসহায় জীবনের কথা অকপটে লিখেছেন আত্মজীবনীতে।

যুদ্ধশেষে বিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। বলা যেতে পারে বিয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দু'জন দু'জনকে আগলে রেখেছেন। বিয়ার ভাইয়ের অবসর নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের নানা জায়গায় থেকেছেন, জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যও ছিল। ঐ ক'টি বছরই তার সুখের জীবন। বিয়ার ভাইয়ের পরিবার তাকে গ্রহণ করেননি। ন্যায্য পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বিয়ার ভাই। তা নিয়ে অবশ্য, তাঁকে আক্ষেপ করতে শুনিনি। বিয়ার ভাই অবসর নেয়ার পর সে স্বাচ্ছন্দ্য থাকে নি। তাঁর শিল্পকর্ম বিক্রিই ছিল প্রকৃত রোজগার। তিন ছেলে মেয়ে, বিয়ার ভাই, অতিথি নিয়ে সংসার- ঢাকায় সে ধরনের সংসার চালানো কতো কঠিন তাতো সবাই জানে। ছেলে মেয়ে যেমন দেখে যেতে চেয়েছিলেন, তেমন হয়নি, প্রিয় এক কন্যার মৃত্যু তাঁকে আরো বিচলিত করেছিল।

কিন্তু, আমি কখনও তাঁকে বিচলিত দেখিনি, গোমড়া মুখে দেখিনি। সব সময়ই তাঁকে দেখেছি হাসিমুখে। সংসার আগলে থাকতে চেয়েছেন, লিখেছেন তিনি-
'কেবলমাত্র দুঃখ দিয়েই জীবন গড়া নয়। অনেক সুখের, আনন্দ, হাসির ঘটনা, ছোট ছোট বিষ্ময়। অনেক ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ, অনেক দেখা সব দেখা নয়। নানা বৈচিত্র্যে বয়ে যায় এ জীবন। এ জীবনকে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথের গানের মাঝে একটি মুক্ত উদার জীবন বোধের সৃষ্টি হয়। জীবন নির্মাণে কবিগুরুর দিক নির্দেশনা জগতের সকল সৌন্দর্য, সকল প্রকৃতির অনাবিল বিশ্বাস। প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ স্মরণে আমাদের জীবনচর্চা সংস্কৃত হয়। আমরা ঈশ্বরের কৃপায় সৃষ্টি বিশ্বাসী। সময়ের ক্ষমতা শেষ হওয়াকে মৃত্যু মনে হয়। যা সৃষ্টির পরিণতি। সেখানে কী আছে জানা নেই। আমার মনে হয় পাপ পূণ্যের হিসাব-নিকাশ এখানেই। ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ সবই অন্তরে।'

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর হয়ে ওঠা, স্বীকৃতি পাওয়াও এক সংগ্রামের ইতিহাস। শিল্পী মহলে স্বশিক্ষিত শিল্পী গ্রহণযোগ্য নয়, ভাস্কর তো নয়ই। ভাস্কর্যের প্রতি আমাদের এক ধরনের অনীহা আছে। ছাতকে থাকার সময়ই বোধহয় তিনি ভাস্কর হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতে থাকেন।

বিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর স্বস্তি পেয়েছিলেন কিন্তু বিয়ার ভাইকে এলিট সমাজের বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে, পরিবারেরও। কিন্তু, এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতেই ফেরদৌসী নিজেকে তৈরি করেছেন এবং পরবর্তীকালে সত্যকথনের মাধ্যমে তাঁর আত্মপ্রকাশ সেই শক্তিরই স্ফূরণ। লিখেছেন প্রিয়ভাষিণী- "১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে চাইলেই আমি পালাতে পারিনি এবং শত লাঞ্ছিত পরিবেশে আমাকে কঠোর সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য এই সামান্য চাকরিটি করতে হয়েছিল। অত্যন্ত বর্ণাঢ্য বিলাসে শৈশব পরবর্তী সময়গুলো খুবই দুঃসময়ে পার করতে হয়েছে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ন'মাস সময়ে সমুদ্র পেরিয়ে আসার পর মনে হলো, আমি পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড়। যেকোনো দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি এবং শক্তের জন্য আমার নিজেকে তৈরি করতে হবে।"

নিজেকে তৈরি করার জীবন ও সমাজের মুখোমুখি হওয়ার শুরু তখন থেকে।

ছাতকের সৌন্দর্য তাকে বিমোহিত করেছিল। "সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করেছিল।" লিখেছেন তিনি, "অবাক বিস্ময়ে সুন্দর পৃথিবীকে মন ভরে, বুক ভরে অনুভব করেছি। সমতট সৌন্দর্যের অপরূপ দেখার পর। পাহাড় সৌন্দর্যের এবং সুরমা নদীর অন্তর মিলন শোভা পৃথিবীর সকল ক্ষোভ যন্ত্রণা তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ ভেবে, গা থেকে ধূলার মতো ঝেড়ে ফেলেছিলাম।"

সেই সময়ে তাঁর সৃজনশীলতা বিকশিত হতে থাকে। নিসর্গকে ভালোবাসার কারণে, গাছের গুড়ি, কাণ্ড, শেকড়ই বেছে নিয়েছিলেন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। ছোট গাছ লতা, মরা কান্ডে বসিয়ে, গাছ জিইয়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি করার প্রয়াসও বোধহয় সেই নিসর্গ প্রেম থেকে।
গাছের একটি টুকরো কীভাবে তাঁর ছোঁয়ায় বাঙময় হয়ে উঠতো তা তাঁর ভাস্কর্য না দেখলে অনুভব করা যায় না। বাংলাদেশের ভাস্কর্যে তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। সামাজিক প্রতিবাদ হিসেবেও তিনি ভাস্কর্য ব্যবহার করেছেন। এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে তার 'ফতোয়াবাজ' ও 'বিধ্বস্ত মা ৭১'-এর কথা। সুফিয়া কামাল তাঁর ভাস্কর্য দেখে গিয়েছিলেন। লিখেছেন তিনি- "পোড়া কাঠ। শুকনো ঘাস। কাটা গাছের গুড়ি, ঝরাপাতা, মরা ডালপালা থেকে সৃষ্টির অপার রহস্যময় শোভা সৌন্দর্যের সম্ভার। ইতিহাস থেকে উপকথার উপাচার তার এই সংগ্রহের মধ্যে ধরে রেখেছেন। শিল্পাঙ্গনে, শিল্প ভাণ্ডারে ফেরদৌসীর এই বিস্ময়কর দান অনবদ্য, অপরিসীম।"

শামসুর রাহমান লিখেছিলেন "ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী কবিতা লেখেন না, তুলি ও রঙ দিয়ে ছবি আঁকেন না। অথচ তিনি একজন প্রকৃত শিল্পী, তার মধ্যে সৃজনশীলতা বিদ্যমান। তিনি গাছের শিকড় কিংবা ডালপালাকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে পারেন হাতের সামান্য একটি দু'টি টানে।"

এস এম সুলতান আরো ভালো বলেছেন, "Purity of Form এর মাধ্যমে সৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নবীন Form এর সমন্বয়েই এই সমন্বয়, Moor বলেছেন, পাথরের মাঝে অনেক ঘাত প্রতিঘাতে এই From এর সৃষ্টি, যা তিনি পেয়েছেন আমাদের Nature এর মধ্যে, এই From খুঁজতে শুধু ফেরদৌসীই পেরেছে। Higher Spiritual Sight না হলে এই অন্বেষণ হয় না। চরম আধ্যাত্মিক জ্ঞান এখানে রয়েছে তাই তার অন্বেষণ।"

ফেরদৌসী হয়ত এ কারণেই লিখেছিলেন, "জীবনের ছোট ছোট দেখা থেকে একান্ত ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে, অবাক হয়ে এই দেখাই একদিন পরম দেখা হয়েছে। ছোটবেলার খেলাধুলা, পড়ালেখার ফাঁকে, ছবির বইয়ের মাঝে, গাছ-গাছালির ডালপালা দিয়ে খেলাঘর সাজাতে সাজাতে খোয়ালি গাছের মারপ্যাচে কত সব আজব জীবজন্তু; মানুষের অবয়ব ধরা পড়েছে। পরবর্তীতে কঠিন জীবনকে সহজ করে ভাবতে এই সব নির্মল সামগ্রী আমাকে বেঁচে থাকার সুস্থ পথ দেখিয়েছে যেখানে সৃজনের আনন্দে সবটুকু পৃথিবীকে পাওয়া যায়।"

ফেরদৌসীর প্রথম দিককার প্রদর্শনী সবাই তাচ্ছিল্যই করেছেন। কিন্তু একের পর এক তার প্রদর্শনী তাঁকে আলাদা মাত্রা দিয়েছিল, ভাস্কর্যে তিনি প্রাণের সৃষ্টি করেছিলেন, কম দামে শিল্পকর্ম সংগ্রহ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তার কোন প্রদর্শনী হলে, আমি ও আমার বন্ধুরা যেতাম, শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতাম, বিক্রির বন্দোবস্ত করতাম। তখন বিয়ার ভাই অবসর নিয়েছেন। সুতরাং, শিল্পকর্ম বিক্রিটা জরুরি ছিল। ক্রমে তিনি এলিট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, ভাস্কর হিসেবে বাংলাদেশে স্বীকৃতি শুধু নয় পরিচিত হয়ে উঠলেন।

অন্যদিকে, তাঁর স্বীকারোক্তি এবং সমাজ-এর মুখোমুখি সত্য বলা অনেক নির্যাতিতা নারীকে সাহস যুগিয়েছে সমাজের মুখোমুখি করার। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও বিচার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনন্য। তিনিই তো মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রতীক। এভাবে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সংগ্রামের, নারীদেরও মুখপাত্র হয়ে উঠলেন। বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিতে তাঁর অবদান যথেষ্ট। তিনি, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এককভাবে লড়াই করে নির্যাতিতদের স্বীকৃতি ও সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। সত্য যে এ সমাজ তো নির্যাতিতদের সম্মানও দেয়নি, গ্রহণও করেনি। ফেরদৌসী সেটি বদলে দিয়েছিলেন। এরপর বীরাঙ্গনারা মুখ খুলেছেন। নতুন প্রজন্ম তাদের সম্মান করতে শিখেছে। মানুষের ভালোবাসা, সহানুভূতি পাচ্ছেন, ফেরদৌসী লিখেছেন,

"জীবনের সুন্দর সময়গুলো একত্রিত করে আমার একান্ত প্রহরগুলো আজও তেমন ভালো কাটে। ১৯৭১-এর নির্যাতনের কষ্ট শরীরে ও মনে ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়ালেও এ দেশের সকল নারী সমাজ সুশীল সমাজ অগণিত তরুণ সমাজ যেভাবে আমাকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসে। সে ক্ষেত্রে দুঃখকে প্রশ্রয় দেবার সুযোগ নেই। স্বদেশের প্রীতিময়তায় আমি নিজের সময়কে সবসময়ই সুসময় মনে করি। '৭১-এর দুর্যোগ থেকে শক্তি অর্জন করতে শিখেছি। নিজেকে আমি পর্যাপ্তভাবে ভালোবাসি। নিজেকে ভালো না বাসলে অন্যকে ভালোবাসা যায় না। সংসার ভীষণ প্রিয় আমার। ঘর সংসারের ভাঙাচোরা টিন ঘষে মেজে ছিমছাম করে রাখতে খুব ভালো লাগে। রান্না করা আমার প্রিয় কাজ।"

সেই সুন্দর সময় সবসময় ধরে রাখতে চেয়েছেন তিনি। ধানমণ্ডিতে থাকার সময় আস্তে আস্তে দু'জনের শরীরেই ভাঙন ধরে। বড় ধরনের অসুখে দু'জনে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। বিয়ার ভাই দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকেন। আমি তখন যেতাম মাঝে মাঝে যখন বারান্দায় চায়ের আসর বসত। নতুন কাজ দেখতাম। তিনি তখুনিই কিছু না কিছু নতুন খাবার তৈরি করতেন। বলতেন, 'বিয়ার ভাইয়ের আফশোষ এখন আর নিজে আপনার লেখা পড়তে পারেন না। জনকণ্ঠ রাখিই আপনার জন্য। লেখা বের হলে আমার কাজ হলো আপনার লেখা পড়ে শোনানো।' আমাকে বলতেন ইতিহাস যোদ্ধা। আমার নিজের প্রিয় একটি বই 'কোই হ্যায়' আমি তাঁদের দু'জনকে উৎসর্গ করেছিলাম, কী যে খুশি হয়েছিলেন বলার নয়।
তিনি অশক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু সৃজনশীল কাজ থেমে থাকে নি। এই অশক্ত শরীরেও একদিনের জন্য আমাদের কোন মিটিং মিছিলে অনুপস্থিত থাকেন নি। আমি অনেকবার মুকুলকে বলেছিলাম, 'ফেরদৌসী আপাকে আর সব সময় ডেকো না।' মুকুল বলল, 'সেটি উনি মানবেন না। দরকার হলে আমাকে নিয়ে আসতে হবে।'

জীবনকে ভালোবাসতেন। পরিপাটি হয়ে থাকতেন। তিনি বিচিত্র ধরনের মালা-বালা পড়েন দেখে যখন বাইরে গেছি তখন কখনও না কখনও খুঁজে পেতে তার জন্য অমন মালা বা বালা নিয়ে এসেছি। কিশোরীর মতো খুশি হয়ে উঠতেন তখন। আমি আর শিল্পী হাশেম খান কয়েকবার তাঁকে একুশে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছি। যতটা না পুরস্কার তার চেয়ে বেশি অর্থ মূল্যের জন্য যাতে তাঁর সংসারের খানিকটা সুরাহা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেন। এভাবে অন্তিমে রাষ্ট্র তাঁকে সম্মান জানায়। এটি তাঁর জন্য ছিল পরম পাওয়া।

বেশ কয়েকমাস আগে ঢাকা থেকে দূরে যেখানে তিনি থাকতেন সেখানে গেছি। ধানমণ্ডির বাড়ির বাড়িঅলা ডেভেলপারকে দিয়ে দিলে তঁকে বাড়ি ছাড়তে হয়। বিকেলে পৌছেছিলাম। বিয়ারভাই তখন চোখে দেখেন না, হাঁটতেও কষ্ট হয়। তবুও আমি এসেছি শুনে বারান্দায় এলেন, ফেরদৌসী আপাও অশক্ত। তারপরও মনে হয় অনেকক্ষণ আমরা নিজ নিজ দুঃখ ভুলে সুখের কথা আলোচনা করেছিলাম।

শেখ হাসিনার অন্ধ ভক্ত ছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, শেখ হাসিনাও তাঁকে ভালোবাসতেন, খোঁজখবর নিতেন। তবে, ঢাকার মূল কেন্দ্র থেকে দূরে চলে যাওয়ায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। কিন্তু, কোন না কোন সভায় দেখা হতো। আন্দোলনের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার, ভাস্কর্যের গল্প হতো। দেশ-মানুষ-জীবন সব নিয়ে তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। লিখেছেন-

"আমার সংগ্রামের পৃথিবী অনেক বেশি সুন্দর। এ জীবন মহান। এ জীবনকে আমি শ্রদ্ধা করি। দেশকে ভালোবাসি। মাকে ভালোবাসি এ কথা যেমন বলে দিতে হয় না, তেমন সত্যিকার সম্পর্ক যে মাটির সাথে অভিন্ন, তার কাছেও নানা ভাষায় বলা যায় না কতটুকু ভালোবাসা তার জন্য। মনে হতে শুরু হলো মহান স্বাধীনতা প্রাপ্ত স্বদেশে আমার মতো এমন অনেক মেয়েরা পরাধীন।"

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে নিজেকে এবং নারীদের এই পরাধীনতা থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন। শিল্প কর্মের মাধ্যমে, আন্দোলনের মাধ্যমে। নারী যে স্বতন্ত্রভাবে অধস্তনতা থেকে মুক্তি পেতে পারে নিজের মনের জোরে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তা শুধু প্রমাণ নয়, অনুপ্রাণিতও করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের। তাঁর জীবন ও কর্মই শুধু নয় তাঁর লেখা আত্মজীবনী 'নিন্দিত নন্দন'ও এর বড় প্রমাণ।