মুম্বাইয়ের কৃষক লংমার্চ থেকে শিক্ষা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 13 March 2018, 03:25 PM
Updated : 13 March 2018, 03:25 PM

বাণিজ্যনগরী মুম্বাই তো বটেই, কার্যত গোটা ভারতের হৃদয়ে ঝড় তুলে একে একে ২০টি দাবিই আদায় করে ছাড়লেন মহারাষ্ট্রের কৃষকরা। নতজানু হয়ে সমস্ত দাবি মেনে নিতে বাধ্য হল ফরণবীশ সরকার। ঋণ মকুব, আদিবাসীরে জমির পাট্টা দেয়ার দাবি মেনে লিখিত বয়ান দিতে বাধ্য হয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার। নাসিক থেকে শুরু করে সাতদিন টানা ১৮০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ হেঁটে এসে গতকাল রাজধানীতে এই বিজয়কেতন উড়িয়েছেন মহারাষ্ট্রের প্রায় ৫০ হাজার কৃষক-খেতমজুর।

গোড়ার উদাসীন থাকার পন্থা নিয়েছিল মহারাষ্ট্র সরকার। কিন্তু মুম্বাইয়ের দিকে আসা কৃষিজীবীদের ঢল দেখেে পিছু হঠতে বাধ্য হয় ফরণবীশ সরকার। বিরোধী কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি তো বটেই, এমনকি জোটসঙ্গী শিবসেনাও দাঁড়ায় কৃষকদেরই পাশে। কিন্তু তার চেয়েও সোমবার সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় মুম্বাইয়ে শ্রমজীবীদের সংহতি। রোববার এবং সোমবার অদম্য কৃষকদের হাতে হাতে খাবার ও জলের প্যাকেট তুলে দিয়েছেন নগরবাসী। একতার নতুন আখ্যানে আন্দোলনত কৃষিদীবীদের মাথায় ফুল ছুঁড়ে দিয়েছেন তাঁরা।

১২ মার্চ সন্ধ্যায় আজাদ ময়দানি অপেক্ষায় থাকা কৃষকদের কাছে দাবি মেনে নেয়ার বার্তা পৌঁছে দেন কৃষিমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত পাতিল। সেখানে তখন কৃষকদের সঙ্গেই রয়েছেন সারা ভারত কৃষকসভার নেতা অমরা রাম, সাংসদ কে কে রাগেশ, সিপিআই (এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। মাথায় লাল টুপি আর হাতে লাল পতাকায় আজাদ ময়দান তখন লাল সমুদ্র। পাতিল বলেন, কৃষকদের সব দাবিই মেনে নেয়া হচ্ছে। কৃষকসভার সভাপতি অশোক ধাওলে বলেছেন, কৃষক আন্দোলনের বড় জয় এই ঘটনা।

কৃষিঋণ মওকুফ এবং ফসলের ন্যায্য দাবিসহ দুই দফা দাবি নিয়ে শুরু হয়েছিল মিছিল। গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল বনাঞ্চল অধিকার আইন অনুযায়ী জমির পাট্টা দিতে হবে কৃষকদের। গত সাত দিনে মিছিল যত এগেয়েছে, ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যোগদান। ৫০ হাজারেরও বেশি কৃষক মিছিল করে রোববার (১ মার্চ,২০১৮) পৌঁছান মুম্বাই। মিছিলকারী অনেকেরই পায়ে চটি বা জুতো ছিল না। খালি পায়েই তীব্র গরমে তাঁরা ১৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন। আজাদ ময়দানে অনেকেরই পা ফেটে গিয়ে রক্তপাত হচ্ছিল। এই রক্তপাতেরই জয় হল। অশোক ধাওলে বলেছেন দাবিমানার ক্ষেত্রে সরকার যে সমস্ত শর্ত আরোপ করেছিল, তা সবই তুলে নিয়েছে তারা।

মুম্বাইয়ের লঙ মার্চে নিজে অংশ নিয়েছিলেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক পি সাইনাথ। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বলেন, অসাধারণ লড়াই করে জয় ছিনিয়ে এনেছেন কৃষকরা। ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তাঁরা হেঁটেছেন। হাইওয়ের তাপমাত্রা আরো বেশি। কারো পা ফেটে গেছে, রক্ত পড়ছে, ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায়ও হার মানেননি তাঁরা। দৃঢ়তা নিয়ে, প্রত্যয় নিয়ে তাঁরা পথ হেঁটেছেন। এক সপ্তাহ মিছিলে হাঁটা মানে, তাঁদের আয়ে টান পড়ে গেল, তাঁদের খাবারে টান পড়ে গেল। তাও সব কিছু তুচ্ছ করে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেন কৃষকরা। চারপাশের মানুষকে কৃষক সমাজের মন্ত্রণার হদিশ দিলেন। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় তাঁদের আবেগের গভীরতা। অন্যদিকে বোঝা যায় কতটা দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন তাঁরা। উল্টোদিকে আন্দোলনকারী কৃষকদের পাশে সব রকম ভাবে দাঁড়িয়েছে মুম্বাইবাসী।

সাধারণ মানুষ ডাব্বাওয়ালাদের দেয়া খাবার আর জল তো ছিলই, টুইটার ফেসবুকে আবেদন ওঠে চটি সংগ্রহ করার। যাতে কৃষকদের কালি পায়ে ফিরে যেতে না হয়। দাবির সঙ্গে মানুষের মনও দিতে নিয়েছেন মহারাষ্ট্রের কৃষকরা। বিশিষ্ট শিল্পপতি আনন্দ মাহিন্দ্রা পর্যন্ত বলেছেন, "এত জন কৃষক দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে এতটা পথ এসেছেন দাবি আদায় করতে। মুম্বাইয়ের বাসিন্দাদের খাবার জোগান তাঁরা। বয়স্ক কৃষকদের পায়ের অবস্থা দেখার পর আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। তাঁদের দৃঢ়তার চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কী হতে পারে?"

ঘরে ফেরার আগে মুম্বাইবাসীর মনও জিতে নিয়েছেন কৃষকরা। সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধেয় না ফেলে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে যে আন্দোলন করা যায়, দাবি আদায়ের পাশাপাশি মানুষের মনও জিতে নেয়া যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন মহারাষ্ট্রের কৃষকরা।

১২ মার্চ থেকেই শুরু হয়েছে দশম শ্রেণীর পরীক্ষা। ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধে হতে পারে আঁচ করেই কৃষক নেতারা ঠিক করেন, ভোরের আগেই মুম্বাইয়ে ঢুকে পড়বেন তাঁরা। সেই মতো রাত একটার পর ফের যাত্রা শুরু হয়। ১৯ কিলোমিটার হেঁটে মুম্বাই ভালো করে জেগে ওঠার আগেই মিছিল পৌঁছে যায় আজাদ ময়দানে। অশোক ধাওলে বলেন, ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধের কথা ভেবে আমরা না হয় রাতের ঘুমটা বাদই দিলাম। এখানেই মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে গেছেন তারা। মিছিল যখনই মুম্বাইয়ে ঢুকেছে তখনই অনেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে দিয়েছেন খাবার ও জল।

সেভাবে অবশ্য বিধানসভা ঘেরাওয়ের দরকারও পড়েনি। তার আগেই ১১ জন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফরণবীশ। দাবি মেনে মুখ্যসচিব সই করে লিখিত প্রতিশ্রুতিও দেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "আমরা সব দাবিই মেনে নিচ্ছি। ছয় মাসের মধ্যে সব দাবি পুরণ হবে। লিখিত প্রতিশ্রুতির কথা আমরা বিধানসভাতেও ঘোষণা করব। মিছিলে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের ৯০ শতাংশই ভূমিহীন আদিবাসী। চাষের জমিতে তাঁদের অধিকার ছ'মাসের মধ্যে পুরণ হবে।

বলিউডের সঙ্গে কৃষক ও কৃষিকাজের সম্পর্কও বহু পুরনো। ইদানিংকার পিপলি লাইভ, লগান, মটরু কা বিজলি কা মন্ডলা, মাউন্টেন ম্যান তো বটেই, দো বিগা জমিন, নয়া দৌড়, মাদার ইন্ডিয়া এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। সেই বলিউডও দু'হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছে আন্দোলনরত কৃষকদের। এক কৃষকের ধূলিধুসরিত, রক্তাক্ত পায়ের ছবি পোস্ট করে কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছেন রীতেশ দেশমুখ, প্রকাশ রাজ, কুনাল খেমু, দিয়া মির্জা, নন্দিতা দাশ, হুমা কুরেশি, মেঘনা গুলজারের মতো চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা।