স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার: ভারতীয় আদালতের রায়ের প্রেক্ষিত ও বিশ্লেষণ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 9 March 2018, 03:56 PM
Updated : 9 March 2018, 03:56 PM

শেষ পর্যন্ত আদালতের অঙ্গনেও স্বীকৃতি পেলো সেই শাশ্বতবাণী। যা পারেনি ভারত সরকার, যা পারেনি সমাজ, অবশেষে তাই করে দেখালো আদালত। আইনি স্বীকৃতি পেল, বৈধতা পেল- স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার। ৯ মার্চ, ২০১৮ শুক্রবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করলো এই ঐতিহাসিক রায়। ইতিহাস শুধু এ দেশে নয়, মহা ইতিহাস সৃষ্টি হলো গোটা বিশ্বে।

জীবন যখন মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক তখনও যেভাবে হোক বেঁচে থাকতে হবে, বেঁচে থাকতেই হবে। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। অশীতিপর বৃদ্ধ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত, শেষ জবাব দিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। অসহ্য যন্ত্রণায় খাওয়া ঘুম বন্ধ। চলচ্ছক্তিহীন পূর্ণ জরাগ্রস্ত গোটা শরীরে 'বেড মোরের' দগদগে ক্ষত তাঁকে আইনি বাধ্যতার কারণে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার ভেন্টিলেশন, অক্সিজেন ও আরো নানা উপকরণসহ জীবন সহায়ক লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম। জীবন্মৃত এই শরীরটিকে 'বাঁচিয়ে রাখতে' হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের খরচ মেটাতে ঘটিবাটি সর্বস্ব বেঁচে ক্রমশ নিঃস্ব হতে থাকে পরিবার, ঘণিষ্ঠ আপনজন।

জীবনের নাম এই নরক যন্ত্রণা থেকে অবশেষে মুক্তির পথ বাতলালো ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চ। বেঞ্চের শাশ্বত ঘোষণা, যা অমর হয়ে থাকবে এখন থেকে পরবর্তী মানব ইতিহাসে- 'সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু, জীবনের অধিকার। এটা মানুষের মানবিক অধিকার।'

স্বেচ্ছামৃত্যুর এই অধিকারের কোনও রকম অপপ্রয়োগ যাতে না ঘটতে পারে তার জন্য বেঞ্চের নির্দেশ- মেডিকেল বোর্ডের অনুমতি স্বাপেক্ষেই মরণাপন্ন রোগীর শরীর থেকে খুলে নেয়া যাবে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম।

আদালতস্বীকৃত এই স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারের প্রয়োগের পরিসর নিতান্তই সীমিত। কারণ, এক্ষেত্রে মুত্যৃ পথযাত্রী কোনও রোগীর জীবনদীপ নির্বাপনের জন্য ব্যবহার করা যাবে না কোনো ইঞ্জেকশন বা প্রাণনাশের অন্য কোনো প্রত্যক্ষ পদ্ধতি।

সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশিত রায় অনুযায়ী এক্ষেত্রে কেবল মেডিকেল বোর্ডের অনুমতিপ্রাপ্ত রোগীর দেহ থেকে খুলে নেয়া যাবে কৃত্রিম প্রাণরক্ষা ব্যবস্থা বা লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম, যা হবে ওই রোগীর চূড়ান্ত মৃত্যুর কারণ। আইনি পরিভাষায় এই ধরনের স্বেচ্ছামৃত্যুকে সর্বোচ্চ আদালত 'প্যাসিভ ইউথেনেশিয়া' নামে অভিহিত করেছে। আজকের এই ঐতিহাসিক রায়ে প্রধান বিচারপতির পাশাপাশি সম্মতি জানিয়েছেন, বিচারপতি একে সিক্রি, বিচারপতি, এ এম খান উইলকর, বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুড়, ও বিচারপতি অশোক ভূষণ। স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার চেয়ে জনস্বার্থ মামলাটি করেছিলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'কমন কজ'।

ইউথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর স্বপক্ষে আইনজীবী লক্ষ্মী যাদবের সওয়ালের পর বিচারপতিরা বলেন, "স্বেচ্ছামৃত্যুর ইচ্ছের কথা পরিবারকে আইনসঙ্গতভাবে জানাতে হবে। মেডিকেল বোর্ড সেই আবেদন বিচার করলে তারপর লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম তুলে নেয়া হবে।"

বাঁচানো যাবে না, বাঁচানো অসম্ভব এমন রোগীর ক্ষেত্রেই কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যুকে বিচারপতিরা বৈধতা দিয়েছেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে এই অধিকার দেয়া হবে না। রোগীকে চিকিৎসার মাধ্যমে আদৌ বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব কিনা তা বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে বিচার করে দেখবে এই সংক্রান্ত মেডিকেল বোর্ড। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলে তবেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম তুলে নিতে পারবে।

স্বেচ্ছামৃত্যুকে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করার আগে প্রধান বিচারপতি বলেন, সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু আসলে জীবনেরই অধিকার। এই অধিকারকে আগে বৈরী হিসাবে দেখা হত না। কিন্তু এর কোনও আইনি স্বীকৃতিও ছিলো না।

আদালত বলেছে, এই অধিকার কোনোমতেই দেশের সংবিধান সম্মত অধিকারের বিরোধী নয়, বরং তা ব্যক্তি অধিকারের পরিসরেরই অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্ট বলে দিয়েছে, সবাই এই অধিকার পাবেন না। একমাত্র মরণাপন্ন রোগীরাই স্বেচ্ছা অধিকারের জন্য বিবেচিত হবেন। এই অধিকারের কারণ তাঁর শারীরিক যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে তাঁকে স্বস্তি দেয়া।

ইউথেনেশিয়ার বা স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দেয়ার ব্যাপারে ভারতই অগ্রগণ্য এমনটা অবশ্য নয়। তবে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলির মধ্যে ভারতই প্রথম এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলো। এই মুর্হুতে বিশ্বের চারটি দেশে ইউথেনেশিয়া চালু রয়েছে। সেগুলি হলো লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়াম। সর্বপ্রথম ২০০৮ সালে লুক্সেমবার্গ স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে আমেরিকার কয়েকটি রাজ্য, জার্মানি ও জাপান সহায়তা নিয়ে আত্মঘাতি হওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকার যেসব রাজ্য সহায়তা নিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার অনুমোদন দিয়েছে সেগুলো হলো- ওয়াশিংটন, ওরেগাঁও কলরেডো, ভেরমন্ট ও কালিফোর্নিয়া। আমেরিকার বাকি রাজ্যগুলিতে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার একেবারেই স্বীকৃত নয়, বরং তা অপরাধ হিসাবেই বিবেচিত হয়।

এ দেশে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার নিয়ে বহুদিন আগে থেকেই আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে দলমত বা ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ সওয়াল করেছেন। অশীতিপর কমিউনিস্ট নেতা হীরেন মুখোপাধ্যায় একসময় এই প্রসঙ্গে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন। নিজের দীর্ঘ জীবনের কথা মাথায় রেখে তিনি বলেছিলেন, সক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যুর বা ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারকেও স্বীকৃতি জানানো প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি আত্মহত্যা নিয়েও সুপ্রিম কোর্ট ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে। আগে আত্মহত্যার ব্যাপারে পুলিশ সুয়েমোটো মৃত বা মৃতপ্রায় ব্যক্তির বিরুদ্ধেই অভিযোগ দায়ের করতো। এ ব্যাপারেও ভিন্নমত প্রসঙ্গ করেছে আদালত।

মুম্বাইয়ের কেইএম হাসপাতালে প্রাক্তন নার্স অরুণা শানবাগের মৃত্যুই কী ভারতে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারের রাস্তা প্রশস্ত করে দিল? দেশের আইনজ্ঞদের একটা বড় অংশ তেমনটাই মনে করছেন। ২০১৫ সালের ১৮ মে মৃত্যু হয় অরুণার। তার আগে ২০১১ সালে তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল আদালত। সেই ঘটনা থেকেই ভারতে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার নিয়ে বিতর্ক তীব্র হতে শুরু করে। দেশের শীর্ষ আদালত আজ যে রায় দিয়েছে, তাতে স্বীকৃতি দেয় হয়েছে মুমূর্ষু কিংবা মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারকে।

কী হয়েছিল অরুণার? ১৯৭৩ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে ব্রেন-ডেড অবস্থায় ছিলেন অরুণা। সেই সময় তাঁর ওপর নৃশংস যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল ঐ হাসপাতালেরই এক ওয়ার্ড বয়। শারীরিক অত্যাচার করার সময় কুকুর বাঁধার মিকল দিয়ে অরুণার গলায় পেঁচিয়ে ধরেছিলো সে। ঐ ঘটনায় অরুণা মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাথায় রক্ত সংবহনও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকী অন্ধও হয়ে যান অরুণা!

এই অবস্থায ৪২ বছর বেঁচে থাকতে হয়েছিল অরুণাকে। একদিকে কেইএম হাসপাতালের চিকিৎসকরা জীবন্মৃত অরুণাকে বাঁচিয়ে রাখার পবিত্র কর্তব্য সম্পাদনে আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। অন্যদিকে সমাজের বিভিন্ন দিক থেকে বারবার প্রশ্ন উঠেছে, কী লাভ এইভাবে বেঁচে থেকে? বাঁচিয়ে রেখে? অরুণা কোনো সওয়াল-জবাবের পরিস্থিতিতে ছিলেন না। কিন্তু হাসপাতালের বাইরে বৃহত্তর সমাজে উঠে আসে একের পর এক প্রশ্ন।

এই রকম বাহ্যজ্ঞানরহিত, শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত, মৃত্যুপথযাত্রী কোনো ব্যক্তিকে দিনের পর দিন কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা বাস্তবে কতখানি মানবিক কাজ। বছরের পর বছর কোমায় থাকা রোগীর জন্য অন্য ব্যবস্থা কী হতে পারে। একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, ভারতের মতো দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ধরণের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্জীব স্তরে রয়েছেন। এই বিপুল পরিমাণ মানুষের এই পর্যায়ের চিকিৎসা করা কি বাস্তবসম্মত চিন্তা?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেছিলেন জটিলতা হতে পারে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু বিষয়টি নিয়েও। অরুণা শানবাগের ক্ষেত্রে মামলা গড়িয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। সেখানে শীর্ষ আদালত কিন্তু সম্মতি দিয়েছিল পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষেই। অর্থাৎ অরুণার লাইফ-সাপোর্ট খুলে নেয়া হবে এবং কৃত্রিমভাবে খাওয়ানো হবে এবং কৃত্রিমভাবে খাওয়ানো হবে না।

আইনি, সমাজতাত্ত্বিক বিতর্ককে ছাপিয়ে উঠে এসেছিল ধর্মীয় ব্যাখাও। ভারতের একটা বিরাট অংশের মানুষ মনে করেন, স্বেচ্ছামৃত্যু আসলে ঈশ্বরের ইচ্ছে বা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হবে। দ্বিতীয়ত, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসক বা পরিবারের সদস্যরা কেউই 'ঈশ্বরের ভুমিকায়' অবতীর্ণ হতে চাইবেন না।

আরও যে বিষয় নিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর বিরোধিতা করেছিলেন বিশিষ্টরা, তার মধ্যে ছিল বিজ্ঞানও। চিকিৎসকদের একাংশের পাশাপাশি অনেকেই মনে করেছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে চিকিৎসা-বিজ্ঞান হয়তো এমন পর্যায় পৌঁছাবে, যখন অরুণা শানবাগদের আবার স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। কে বলতে পারে, হয়তো ২০২০ সালেই আসবে না সেই ক্ষণ? ফলে শুরু হয় নতুন একটি বিতর্ক।

একদল দাবি করেন, যথেষ্ট সময় দেয়া দরকার চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের। আবার আরেক দল দাবি করেন, কতটা সময় দেয়া দরকার তা কে ঠিক করবে? কোথাও তো একটা থামতে হবে।