নারীর ক্ষমতায়ন গণদাবিতে পরিণত করতে হবে

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 8 March 2018, 12:19 PM
Updated : 8 March 2018, 12:19 PM

একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে পালন করা হলেও আমাদের দেশে বিশেষভাবে এই দিনটি নারীমুক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, নারী-পুরুষ সমতার চেতনা সঞ্চারিত করার ক্ষেত্রে এই দিনটির ভূমিকা অসাধারণ। কারণ নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশে স্থায়িত্বশীল কোনো উন্নতি আশা করা যায় না। অনুধাবন করা যায়, প্রতিবারের মতো এবারও আমাদের দেশে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পূর্ণ মর্যাদার এই দিবসটি পালন করা হবে।

তবে এবার এই দিবসটি উদ্যাপনের আগ মুহূর্তে জাতি হিসেবে আমরা এক বিশেষ ভাবাবেগে উদ্বেলিত এবং গৌরবদীপ্ত। ১৯১০ সালে বিশ্ব নারী দিবস প্রবর্তনের পর থেকে নারী প্রগতির আন্দোলন যে নতুন মাত্রা লাভ করতে শুরু করেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় নারী সমাজের এই অর্জন।

বিশ্ব নারী দিবসকে সামনে রেখে নারী সমাজ তাদের প্রতি বিরাজমান সব বৈষম্য সনাক্ত করতে পেরেছিল এবং সেই বৈষম্যের ক্ষতিকর দিক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সামাজিক, অর্থনেতিক, সংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য জোর দাবি তুলেছিল। পরবর্তীতে তারই প্রতিফলন ঘটেছে আন্তর্জাতিক সিডও সনদের ১৬টি ধারায়। যদিও নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারার ওপর থেকে সরকার এখনো সংরক্ষণ তুলে নেয়নি, তবে তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।

১৯৭৫ সালকে বিশ্ব নারীবর্ষ ঘোষণার মূল স্লোগান ছিল সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি, যা আজও নারী প্রগতির আন্দোলনে দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৯ সালে ঘোষিত সিডও সনদও এ ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী মাত্রা হিসেবে যুক্ত হলো। এর সঙ্গে আরো উল্লেখ করতে হয় আন্তর্জাতিক চারটি বিশেষ সম্মেলনের কথা।

প্রথমটি মেক্সিকো, দ্বিতীয়টি কোপেনহেগেন, তৃতীয়টি নাইরোবি এবং চতুর্থটি বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ^ নারী সম্মেলন। এই সম্মেলনে নারীর অধিকার ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে এমন ১২টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে বেইজিং প্লাটফর্ম অব অ্যাকশন চূড়ান্ত করা হয়, যা একটি দিকনির্দেশনা- হিসেবে সব দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহযোগ্যতা পেয়েছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও নারী ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গে প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশন একটি সুচিন্তিত পথনির্দেশনা-এই সূত্র ধরে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে এসেছে।

এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যেসব ইস্যু নিয়ে আওয়াজ তোলা হয়েছিল, তা আজও প্রাসঙ্গিক। আজও বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে নারীরা বৈষম্যের শিকার, দেশীয় রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠানে নারীকে অধস্তন করে রাখার প্রবণতা বিরাজমান। যদিও যুগে যুগে নারী প্রগতির আন্দোলনের পথ ধরে অর্জনও কিছু কম হয়নি। ভোটাধিকার অর্জিত হয়েছে, দাসপ্রথার অবসান ঘটেছে, আট ঘণ্টা কাজের সময় মেনে নেওয়া হয়েছে, নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনা এবং উন্নত বিশে^ স্বাস্থ্যসেবা সরকারিভাবে দেওয়ার ব্যবস্থাও গৃহীত হয়েছে, সেই সঙ্গে নিশ্চিত করা হয়েছে নারী শিক্ষা, নারীকে রাজনৈতিক সচেতন ও নারীর কর্মসংস্থানের ব্যাপক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের নারীর শক্তিশালী আন্দোলন জাতিসংঘের এ ব্যবস্থাগুলো এগিয়ে নিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এত কিছু অর্জনের পারও কোথায় যেন একটা ফাঁকা রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামো এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। ফলে নারীও যে মানবসম্পদ এবং অর্ধেক নারী সমাজের কাছে মেধা, মনন, প্রজ্ঞা. দক্ষতা, প্রতিভার অর্ধেক সঞ্চিত আছে এবং এর যথাযথ ব্যবহার না হলে যে জাতির জন্য শুভ কল্যাণকর কিছু হবে না, সেই সত্য আমরা হৃদয় দিয়ে যথাযথভাবে এখনো অনুধাবন করি না।

এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে 'নারীর ক্ষমতায়ন'। আমরা জানি, এখনো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর পিছিয়ে পড়া অবস্থানের কারণে তারা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী এখনো নির্যাতনের শিকার এবং দু:খজনক হলেও সত্য, ৬০ শতাংশ নারী এই নির্যাতনের ব্যাপারে নীরব থাকে। আমাদের দেশের নারীরা এখনো ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর পারিশ্রমিক অনেক কম, কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ নেই। যৌন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি আশঙ্কাজনক। গার্মেন্টের নারী শ্রমিকরা দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা এনে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখছে অথচ কারখানায় আগুন লাগার কারণে আগুনে পুড়ে তাদেরই বহুজনকে প্রায়শই প্রাণ দিতে হচ্ছে।

একের পর এক ঘটনা ঘটার পরও কর্তৃপক্ষের বোধোদয় পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায় না। নেওয়া হচ্ছে না প্রতিকারের স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা, এমনকি সঙ্কটের সময় বাইরে বেরিয়ে আসার অবাধ সুযোগ, তাদের উদ্ধার, আহতদের যথাযথ চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করা হয় না।

জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদানকে স্বীকার ও হিসাব না করার যে রেওয়াজ চলছে, তা ওই উপেক্ষা এবং অমানবিকতারই নামান্তর । এ অবস্থা কোনোভাবেই জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির সহায়ক হতে পারে না। তাই পুরুষের সমান সুযোগ, মজুরি এবং সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করা আজ খুবই জরুরি।

এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় নারী নির্যাতন চলছে নির্বিচারে, শ্লীলতাহানি, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পুড়িয়ে মারা, বহুবিবাহ, যৌতুকসহ ফতোয়াবাজি চলছে অহরহ। আইন আছে কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজই দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীকে ক্ষমতাহীন করে রেখেছে। অথচ নারীর আজ বাঁধাধরা কিছু ক্ষেত্রে নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের দৃপ্ত পদচারণা ঘটছে। নানা চ্যালেঞ্জিং পেশায় তারা অবতীর্ণ, উচ্চতর পর্বতশৃঙ্গে আরোহণের ক্ষেত্রেও সমান দক্ষতা প্রদর্শন করে সম্প্রতি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।

বহু অভাবনীয় পদে নারী দাপটের সঙ্গে এগিয়েছে। এখন প্রয়োজন নারী উন্নয়ন নীতির সঙ্গে সাহসী ও অভিনব সামাজিক নীতির যোগসূত্র ঘটানো। আমাদের সংবিধানে 'রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে' বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন ঘটছে না।

এর জন্য নারীর ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করা গণমাধ্যমসহ সব পর্যায়ে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং জাতীয় সংসদসহ রাজনৈতিক দলে নারী আসন এক তৃতীয়াংশ করা এবং সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, এবং সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

তাই এবারের নারী দিবসের দাবি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। কারণ সংরক্ষিত আসনের সাময়িক ব্যবস্থা নারীর মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। কারণ নারী আন্দোলন মনে করে সরকার যখন এসডিজি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে তখন নারীর সংরক্ষিত আসনের এই ঘোষণা নারী পুরুষ সমতার চেতনার পরিপন্থী। এতে সংসদে নারীর মর্যাদা এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে। এটি নারীর ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ না বাড়লে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে না।