অর্থবহ জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যাশায়

রণেশ মৈত্র
Published : 5 March 2018, 02:44 PM
Updated : 5 March 2018, 02:44 PM

এ বছরের ১৬ জানুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে রওনা হয়ে পরদিন রাত প্রায় ১২টায় সস্ত্রীক সিডনি পৌঁছাই। এবার সঙ্গে স্ত্রী পূরবী ছাড়াও কনিষ্ঠ পুত্র প্রলয়ও এসেছিল মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য। প্রলয় চলে গেলেও আমরা দু'জন থেকে যাব এই বছরটা।

এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া সফর করলাম। অত:পর আর বিদেশ সফরের ইচ্ছে নেই। পিতৃভূমি পাবনাতেই থেকে যাব বাকি জীবনটা। এবারের আসার বিশেষ আকর্ষণ ও অনিবার্যতা ছিল আমাদের বড় নাতনি ঈহিতার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান। অপূর্ব অনুষ্ঠানমালা দিয়ে সাজানো এই বিয়েটা না দেখতে পেলে অনেক কিছুই হারাতাম যেন।

তাই দর্শক হলেও অনুষ্ঠানাদি শেষ না করে লেখালেখিতে হাত দেইনি দু'সপ্তাহেরও বেশি। সে কারণেই দেশের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ছিল আমার অকস্মাৎ দীর্ঘ অনুপস্থিতি। তবে নিশ্চয়তা নেই, নিয়মিত লেখা সম্ভব হবে কি না আগের মত। আজকের এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। তাই সেই প্রসঙ্গেই ফিরে যাই।

অতীতে একবার বা দুইবার এই নির্বাচন নিয়ে লিখেছিলাম। তখনও নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সংলাপ শুরু করেন নি। ইতোমধ্যে যেই সংলাপ শেষ হয়েছে। অনেকগুলি নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে তাঁদের আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন- কাকে কাকে নিবন্ধন দেওয়া হবে তা আজও অবশ্য জানা যায় নি।

যা হোক, বড় বড় রাজনৈতিক দল যাঁরা ক্ষমতায় আছেন বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চান তাঁদের সক্রিয়তা চোখে পড়ার মত। যদিও মামলা মোকদ্দমায় জর্জরিত বিএনপি অনেকটাই যেন হতবিহ্বল ও শক্তিহীন জামায়াতে ইসলামী দলটি বিস্ময়করভাবে আজও বে-আইনি ঘোষিত হয়নি বলে তারা দলীয়ভাবে আজও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে অনুষ্ঠানিকভাবেই থাকতে পারছে।

তবে যেহেতু তারা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারিয়েছে তাই হয়তো তারা দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। তাই ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই তারা নির্বাচন লড়তে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে সকল দলই ইচ্ছুক।

কিন্তু যে নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। অংশগ্রহণকারী দলগুলিকে নির্বাচনের সকল সুযোগ-সুবিধা সমভাবে দিতে হবে, এমন দাবিও সংলাপে সকল দলই তুলে ধরেছেন। কিছুদিন দিব্যি বিতর্ক চললো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অংশ নেওয়া, না নেওয়া নিয়ে। সরকারী দলের সবাই এক বাক্যে বলেছেন- শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বিএনপি বলেছে, তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচন হলে তা নিরপেক্ষ হবে না এবং ফলে ওই নির্বাচনে তাঁদের অংশগ্রহণ হবে অনিশ্চিত। তাঁরা নির্বাচনের পূর্বে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রত্যাশী বলে দাবি করেছেন। কিন্তু তার কোন স্পষ্ট রূপরেখা বিএনপি আজও তুলে ধরতে পারে নি। কিন্তু এ বিতর্ক অহেতুক তিক্ততাই সৃষ্টি করে মাত্র।

স্পষ্ট কথা হলো নির্বাচন হতে হবে পুরোদস্তুর নির্বাচন কমিশনের অধীনে। তাই নির্বাচন পরিচালনায় সকল দায়িত্ব ও ক্ষমতা অবশ্যই ঐ কমিশনের হাতে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে আইন কানুনের কোনো ঘাটতি থেকে থাকলে অবশ্যই দ্রুত তার অবসান ঘটাতে হবে। প্রয়োজনে আইনের সংশোধন-সংযোজন করে নিতে হবে অবিলম্বে।

মন্ত্রণালয়গুলি কতিপয় দিক– যেমন, স্বরাষ্ট্র জনপ্রশাসন অপরাপর সকল ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে সামান্যতম সংশয় সৃষ্টি হওয়ার সুযোগও যেন আদৌ না থাকে। নির্বাচনের প্রচারণা আমাদের মিডিয়াগুলিতে পুরোপুরিভাবে দুটি বড় দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাই অংশগ্রহণকারী সকল দলের জন্য প্রতিদিন সংবাদপত্রসমূহে ও বেতার টেলিভিশনে সমান সময় ও সেপস নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

দলীয় প্রধানসহ সকল নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যই গুরুত্বসহকারে প্রকাশের জন্য নির্বাচন কমিশন মিডিয়াগুলিকে আবেদন জানাতে পারবেন। নির্বাচনে কাল টাকার বন্যা বইতে থাকে। এগুলো চলে ধর্মের নামে সূক্ষ্ণ প্রচারণাও। নেমে আসে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির উপর নির্যাতন।

ফলে নির্বাচন অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হয় না। এ ক্ষেত্রে কঠোরভাবে টাকার মেলা, পেশি শক্তির ব্যবহার, ধর্মের নামে প্রচারণা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কোথাও এমন কোনও ঘটনা ঘটলে তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনকে তাৎক্ষণিকভাবেই নিতে হবে।

এ ব্যাপারে কালবিলম্ব হলে পরবর্তীতে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার পথে অনেক অনাকাঙ্খিত বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হতে পারে। নির্বাচনী শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ ও তার জন্য নির্ধারিত শাস্তির মেয়াদ অবশ্যই বাড়ানো উচিত। তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়নও কঠোরভাবে করা প্রয়োজন।

যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল যদি নির্বাচনী বুথে বা নির্দিষ্ট কেন্দ্রে মারামারি করে, ব্যালটপেপার ছিনতাই করে বা প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের পোলিং এজেন্টকে বুথ থেকে জোর করে বের করে দেয় সেগুলি মারাত্মক অপরাধ। তেমনি আবার ধর্মের নামে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো বা লৈঙ্গিক ভিন্নতাকে টেনে এসে কোন প্রার্থীর বিরোধিতা করে প্রচার-প্রচারণা চালানো বা ভয়-ভীতি হুমকি দেখিয়ে প্রার্থীবিশেষকে ভোট দিতে বা না দিতে বলা বা বাধ্য করাও অপরাধ।

পাশাপাশি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর এক মাসে পর্যন্ত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংস আক্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে এখন এগুলিকে অধিক গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। একদিকে তার জন্য কঠোরতর শাস্তির বিধান আইনের সংস্কারের মাধ্যমে করে তা বাস্তবায়নে নিশ্চয়তা বিধান করার সাথে সাথে ঐ আইন বাস্তবায়নে যে কোন ব্যক্তির শৈথিল্য বা সময়ক্ষেপনও সমতূল্য অপরাধ বলে গণ্য করা হোক।

ভূক্তভোগীরা দীর্ঘদিন ধরে এই দাবিগুলি উত্থাপন করে এলেও তার প্রতি কোন প্রকার কর্ণপাত না করায় সংশ্লিষ্টদের মনে নির্বাচন সম্পর্কে এক ধরণের ভীতি বাসা বেঁধেছে যা অবিলম্বে দূরীভূত করা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।

এ জাতীয় অপরাধ সম্পর্কে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ভোটকেন্দ্রের কর্মকর্তা, রিটার্নিং অফিসার, থানা কর্তৃপক্ষ পুলিশ সুপার এঁদের সকলের কাছেই পাঠানোর বিধান রাখা সঙ্গত। যাতে অভিযোগটি পাওয়া যায়নি এমন কথা বলা না যায়। তদুপরি, বিশেষ পরিস্থিতিতে ভোট স্থগিত ঘোষণার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট ভোট কেন্দ্রের প্রধানকর্মকর্তার হাতে থাকাও বাঞ্ছনীয়। ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর তা কোনওক্রমে স্থগিত ঘোষণা করা বা বিরতি দেওয়া বে-আইনি এমন বিধানও রাখতে হবে।

ভোট দেওয়া না দেওয়া আমাদের দেশে সংশ্লিষ্ট ভোটারের ব্যক্তিগত অধিকার হিসেবে বিবেচিত। আবার অস্ট্রেলিয়ান প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ভোট প্রদান বাধ্যতামূলক। অবশ্য গুরুতর অসুস্থতা, সামরিকভাবে ভিন্ন দেশে অবস্থান প্রভৃতি জাতীয় প্রতিবন্ধকতা (যা আবার প্রমাণ করতে হয়) না থাকলে।

সেখানে ভোটের দিন ছুটিও ঘোষণা করা হয় না। তবে ভোটদানের জন্য কিছুটা সময় দেওয়া হয় প্রত্যেককে। যা হোক, আমাদের দেশেও ভোটদান বাধ্যতামূলক করা উচিত এবং ভোটদানের ক্ষেত্রে কোনওপ্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচনা করে তা কঠোর শাস্তিযোগ্য হিসেবে কার্যকরও করা উচিৎ।

কিন্তু অর্থবহ নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বিকাশ ও তার প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলির উপর বহুলাংশে প্রথমত, দলগুলির আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র কঠোরভাবে চর্চিত হওয়া প্রয়োজন এবং এ ব্যাপারে দলগুলির গঠনতন্ত্রে উপযুক্ত সংস্কারও প্রয়োজন। তদুপরি, নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হলে শুধু আইন নয় তার সাথে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ধনী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ইত্যাদি পেশার লোককে যথাসম্ভব পরিহার করে দরিদ্র দেশপ্রেমিক সৎ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে।

১৫ অগাস্টের আগে আমাদের দেশে তাই হতো। জিয়ার আমলে ওই প্রথা বদলে দিয়ে ধনীদেরকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয় এবং এখন ঐ রোগ প্রধান বড় দলগুলিতে ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। কার্যকরভাবে এ প্রথা বন্ধের উদ্যোগ এখুনি নিতে হবে। সমাজকর্মী, শিক্ষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র শিল্পপতি এবং অনুরূপ সামাজিক স্তর থেকে আসা রাজনৈতিক কর্মীদেরকে মনোনীত করলে সংসদ জনগণের সংসদে পরিণত হতে পারে।

বর্তমানে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করেছি বটে কিন্তু সংসদকে জনগণের সংসদে পরিণত করতে আজও পারিনি। সেখানে দরিদ্র, শোষিত জনগণের সমস্যা আলোচনা তো দূরের কথা, উত্থাপিত কোন বিল এর উপর তার ভাল মন্দ-নানা দিক নিয়ে কোন আলোচনাও সংসদে হয় না।

বিল উত্থাপন হতে না হতেই তা কণ্ঠভোটে পাস হয়ে যায়। তদুপরি কোন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তাঁর সদস্য পদ থাকবে না মর্মে যে আইন আছে তার ফলেও সংসদে কোন বিষয়ে আলোচনা হয় না। দলীয় প্রধান যা বলে দেন চোখ বুঁজে সবাই তার সপক্ষে হাত তুলে তা পাস করে দেন। ফলে আমাদের সংসদ সরব হতে পারে না। অথচ গণতন্ত্র বাঁচাতে হলে সরব সংসদের বিকল্প নেই তাই এ ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা জরুরি।

শুধু সরকারের প্রতি কেউ অনাস্থা প্রস্তাব আনলে সেক্ষেত্রেই এমন ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। জনগণের সংসদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণেরও অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় নামতে হবে। গৎ বাঁধাভাবে 'মার্কা' বা 'প্রতীক' দেখে ভোট দেওয়ার রেওয়াজ পাল্টাতে হবে।

প্রার্থীটি কেমন- যোগ্য কিনা, সৎ কিনা, গরীব ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কি না-তাঁদের স্বার্থে লড়াই করার ঐতিহ্য আছে কি না অসম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী কিনা সেগুলি সম্পর্কে অবহিত হয়ে ঐ গুণাবলী বা তার বেশির ভাগ যাঁরা আছে তাঁকে ভোট দেওয়ার রেওয়াজ চালু করা অপরিহার্য।

ভোটদানের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয় প্রাসঙ্গিক হলো জনগণ, জনগণের ও দেশের স্বার্থ। 'অমুককেই তো ভোট দিতাম কারণ উনি যোগ্য। কিন্তু উনি যদি অমুক প্রতীক নিয়ে দাঁড়াতেন তবে অবশ্যই ভোট দিতাম। তা না হওয়াতে ওনাকে ভোট দিলে ভোটটাই নষ্ট হবে', এমন মানসিকতা ছাড়তে হবে। কারণ যোগ্য লোককে ভোট দেওয়ার জন্যই তো নির্বাচন – তাঁকে ভোট না দিলেই ভোট নষ্ট হয় ভোটারদের এই কথাটি বোঝা দরকার।