মার্চে কিছু দিবস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালন আবশ্যক

মুহম্মদ মাহবুব আলী
Published : 4 March 2018, 03:53 PM
Updated : 4 March 2018, 03:53 PM

পত্রিকার খবরে প্রকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২ মার্চকে 'পতাকা উত্তোলন দিবস' হিসেবে পালন করেছে। ঐ ব্যাপারে অবশ্য কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাব তবে একটি খ্যাতনামা পত্রিকায় তাকে পতাকা প্রদর্শন দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (প্রথম আলো, ৩রা মার্চ, ২০১৮)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকসুর তদানিন্তন সহ-সভাপতি এই দিনটিকে পতাকা উত্তোলন দিবস হিসাবে পালন করলেও অপর নেতা ডাকসুর সাধারন সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন তাকে বড়জোর পতাকা প্রদর্শন দিবস বলেই মেনে নিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অপর নেতা ও ছাত্রলীগের তদানিন্তন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী পতাকা প্রদর্শন কথাটা মেনে নিতে নিমরাজি।

এই উত্তোলন দিবসকে কেন্দ্র করে ইতিহাস যেভাবে বিকৃত হয়েছে তা অবিশ্বাস্য এবং আ স ম রব এর সকল কৃতিত্ব তাদের নেতা সিরাজুল আলম খান ও সিরাজপন্থীদের অকাতরে ঢেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে শুধু কিঞ্চিতকর নয় আজ্ঞাবহের পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। অবশ্য কাজী আরেফ ও আবদুর রাজ্জাক তাদের জীবদ্দশায় নিদ্বির্ধায় স্বীকার করেছেন যে এ সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে সবসময় ও সর্বত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন কর্মসূচিই পালিত হয়নি। ২রা মার্চ নিয়ে বিতর্কে নূরে আলম সিদ্দিকী যে প্যারোডি তৈরি করেন তা নিন্মরূপ-

"আমি শুনে হাসি

আঁখি জলে ভাসি

এই ছিল মোর ঘটে।

যত ধড়িবাজ

হিরো হল আজ

মোরা আজ জিরো বটে।"

তবুও আমি বলব ২ মার্চকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করুক এবং ইতিহাসকে তার স্বমহিমায় ও স্ব-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করুক। প্রাপ্ত তথ্যের নির্মোহ সমাবেশ ঘটালে তারা দেখবেন যে আসলে সেদিন আকস্মিকভাবে যে পতাকা প্রদর্শিত হয়েছিল যা জহুর বাহিনীর পতাকা হিসাবেই তৈরি করা হয়েছিল এবং যা শেখ জাহিদের হাত থেকেই আ স ম রব গ্রহণ করেন এবং দোলাতে থাকেন। এর গুরুত্ব কম নয়, কারণ পতাকা উত্তোলন কিংবা প্রদর্শন ছিল পাকিস্তানী রাষ্ট্রের মৃত্যু পরোয়ানা।

এই পতাকাটি প্রদর্শিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের কলা অনুষদের গাড়ি বারান্দার উপর থেকে; ২মার্চ সকাল ১১টার পর স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশ থেকে। আনুষ্ঠানিকতা বিবর্জিত এ পতাকা প্রদর্শন নিয়ে বিতর্কের সূচনা করেছিলেন আ স ম রব এবং তার পরিসমাপ্তি কবে ঘটেছিল বা ঘটবে তাও জানিনা। তবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নিয়ে বিতর্ক নেই। ১লা মার্চ ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন বাতিলের ঘোষনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হয়েছিল যাতে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুস কুদ্দুস মাখন।

এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই সেই সময় থেকে বিজয় দিবস পর্যন্ত ছাত্রদের পক্ষে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বহুল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। এই দিনটির গুরুত্ব কম নয় বরং বলা যায় এটা ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে ছাত্রপক্ষীয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই দিনটিসহ মার্চের প্রথম থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করলে ইতিহাসকে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হবে।

আমি ৩ মার্চকে পালন করার অনুরোধ করবো; কেননা সেদিন পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। সভাটি ছিল আনুষ্ঠানিক এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সর্ব সম্মতিতে ইশতেহার পাঠ করে শাহজাহান সিরাজ দু'বার- একবার বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে পৌছার পূর্বে আর একবার বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছার পরে। 'আমার সোনার বাংলা' গানটি দিয়ে ২ মার্চ প্রদর্শিত পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। সেদিন স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বার্থহীন উচ্চারণ হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গঠন ও কার্য প্রণালী বিবেচনায় রাখলে এই দিনটিকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালন করা উচিত। অপর একটি কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৩ মার্চ পালন করা উচিত।

কেননা, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি তার ইতিহাসে প্রথম বারের মতো বটতলায় সভা আহ্বান করে। মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে সেই সভায় স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। বাণিজ্য বিভাগের তদানিন্তন লেকচারার আবদুল মান্নান চৌধুরী তা উত্থাপন করেন এবং তাকে সমর্থন করে বক্তব্য দেন দুর্গাদাস ভট্টাচার্য ও শহিদউদ্দিন আহমেদ।

এরপর সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে ৬ দফার স্থলে এক দফার দাবি মান্নান চৌধুরী উত্থাপন করলে তা বিনা বাক্য ব্যয়ে গৃহীত হয়। প্রস্তাব গৃহীত হলে তা তারস্বরে পাঠ করেন প্রস্তাবের উপস্থাপক। বঙ্গবন্ধুর উৎসাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শিক্ষকদের এ সভা ডাকা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ ও পরবর্তী আলোচনায় এ কথা স্পষ্ট হয় যে সশস্ত্র  যুদ্ধ ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। এ কথা বঙ্গবন্ধু ২৮ তারিখেই তার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুল মান্নান চৌধুরীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে প্রস্তুতির পরামর্শ দেন।

বঙ্গবন্ধুর সেই পরামর্শের প্রতিফলন ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত সভায়। সকাল ১০-১১ টায় অনুষ্ঠিত সভাটি একান্তই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের এবং সিদ্ধান্তটি সারা জাতির মনোভঙ্গির। এই প্রস্তাবের পরই সারাদেশের শিক্ষক সমাজ স্বাধীনতার প্রস্তুতিতে নেমে যায়। তাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই দিনটি পালন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাঞ্চনীয়। মার্চে এই তিনদিনের বিরতিহীন অনুষ্ঠান ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, জাতির পিতা ও স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবশ্য করণীয়। ১৭ মার্চ তার জন্মদিন মহা সমারোহে পালন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের সকল কর্মকাণ্ডের মূল হোতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, অন্যরা বরং তার আজ্ঞাবহ হিসাবে নির্দেশ কিংবা অনুরোধ পালন করে গেছেন। এটা করলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধবাদীদের চোখ খুলবে ও মুখ বন্ধ হবে।

২৩শে মার্চকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা উচিত; কেননা, ২৩ মার্চ তারিখে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে 'বাংলাদেশ দিবস' পালিত। ২ মার্চ প্রদর্শিত পতাকাটি শিল্পী কামরুল হাসানের পরিমার্জিত ডিজাইন অনুসারে তৈরি করে সেদিন তা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়। সেখানে পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা এবং গান স্যালুট দেয়া হয়। এই দিনটিকে বরং পতাকা দিবস পালনের জন্য আন্দোলনরত শীর্ষ নেতাদের সম্মতি রয়েছে। এই দিন পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর কাছে অর্পিত হয় এবং তিনি সেটা সানন্দে ১৯৭০ সালের ৭ জুনের মত গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত ডিজাইনের পতাকাটি আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে  স্বীকৃতি পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই দিনটি পালন করলে কর্তৃপক্ষ পক্ষপাতিত্বের অপবাদ থেকেও মুক্ত হবে।

তারপর আসে ২৫ মার্চের কথা। ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের সূচনা হয় ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির ব্যানারে। জাহানারা ইমামের সভাপতিত্বে এই সিদ্ধান্তে জড়িত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুল মান্নান চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম নাহিদ। দিবসটি এখন প্রতি বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পালিত হয়। তবে এই দিবসটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার নিজস্ব উদ্যোগে পালন করা উচিত। এই দিনের তাৎপর্য কাউকে বুঝিয়ে বলার নয়, একান্তই অনুভবের। অন্যান্য দিনগুলো ইতিহাস চেতনা ও সত্যের সাথে সম্পৃক্ত। তাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ১ থেকে ৩ মার্চ, ১৭ মার্চ, ২৩ মার্চ ও ২৫ মার্চ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের অনুরোধ জানাচ্ছি।