ত্রিপুরার নির্বাচন: কীভাবে বামদুর্গে আঘাত হানলো বিজেপি!

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 4 March 2018, 03:02 PM
Updated : 4 March 2018, 03:02 PM

বুদ্ধদের ভট্টাচার্যের প্রশ্নাতীত নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি প্রতিহত করতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিজয়রথকে। তার ৭ বছর পর আজ আর এক বঙ্গভাষী রাজ্য ত্রিপুরায় আবারও প্রমাণিত হলো নির্বাচনী জয়-পরাজযের কাছে সততা, নিষ্কলুষতা, নিঃস্বার্থ জনসেবার মানসিকতা এর কোনোটারই কোনো দাম নেই। দাম, টাকার। দাম, প্রভাব প্রতিপত্তির। দাম, পেশি শক্তির। দাম, ষড়যন্ত্রের। গত নির্বাচনে যে দল রাজ্যে সাকুল্যের ভোট পেয়েছিল দেড় শতাংশের মতো, জামানাত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল সবকটি কেন্দ্রে, আজ তারাই প্রায় ৪৪ শতাংশ ভোট পেযে রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ আসন দখল করলো এই রসায়নেরই জোরে।

এমনটি যে করা সম্ভব, যেনতেন প্রকারে ত্রিপুরার এই ভোট-বাজি জিততেই হবে, এরকম একটা ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিল বিজেপি নেতৃত্ব। সেই লক্ষ্যে তারা ত্রিপুরার প্রতিটি আনাচেকানাচে ঝাঁপিয়ে পড়ে গত একবছর আগে থেকে। প্রথমে সেখানকার কংগ্রেস দলটাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নেয় তারা। সেই সঙ্গে দলে নেয় সিপিআই (এম) থেকে বিভিন্ন অভিযোগে বিতাড়িত লোকদের।

এরপর নির্বাচন ঘোষণা হবার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ দু'জনেই দু দু'বার সফর করেছেন রাজ্যে। রাজ্যে প্রচারে পাঠানো হয়েছিল ৪০ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। অসংখ্য সভা করে গেছেন উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সহ ছয়-ছয়জন মুখ্যমন্ত্রী। সর্বোপরি বিচ্ছিন্নতাবাদী আইপিএফটি এর সঙ্গে জোট গঠন। একসময় যারা ত্রিপুরায় রক্তাগঙ্গা বইয়ে দিতে চেয়েছিল সেই সংগঠনের নেতা নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মার সঙ্গে প্রকাশ্য মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীকে কোলাকুলি করতে দেখে সেদিন সাধারণ মানুষ যত বিস্মিতই হোন না কেন বিজেপি নেতৃত্ব ঠিকই করে রেখেছিলেন যে রাজ্যে সিপিএম-কে উৎখাত করতে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী উপজাতিরাই তাদের প্রধান বাহন।

ছোট্ট একটি রাজ্যেও মাত্র ৬০টি ছোট ছোট এলাকার আসন- সেটাকে দিগ্বিজয় করতে গেরুয়া শিবিরের এই নিবিড় রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি ছিল হাজার হাজার কোটি টাকার খেলা। নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষিত হবার পরই দিল্লি থেকে হোস পাইপের স্রোতের মতো পাঠানো হতে থাকে টাকার সাপ্লাই। রীতিমত ভোটারদেরকে ধরে ধরে ভোট কেনার রাস্তা নেয় বিজেপি। তার আগে জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে বাম শিবিরের মধ্যে খুঁজে খুঁজে সুবিধাবাদী মানসিকতার লোকজনদেরকে কিনে নেয়া হয় টাকার বিনিমযে।

ভোটের আগের দিন রাতে প্রতিটি গ্রামে গ্রামে রীতিমত টাকার হরির লুট চলতে থাকে। এসব দেখে, শুনে বা জেনে তার সঠিক মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় বামেরা। সর্বোপরি ছিল নজিরবিহীন বাহিনী তৎপরতা। কয়েকটি উপজাতি এলাকায় অশান্তি হবার মতো পরিস্থিতি থাকলেও রাজ্যের বাকি, ৫০টি বিধানসভা এলাকায় পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণই শান্ত। তা সত্ত্বেও দিল্লি থেকে এত অজস্র কোম্পানি বাহিনী পাঠাবার কী প্রয়োজন ঘটলো তা ভোটের দিনও কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। আশঙ্কা করা হচ্ছে ভোটারদের মনে একটা বিপরীত প্রভাব সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য নিয়েই এইভাবে সশস্ত্র বাহিনীর দাপাদাপি ঘটনোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।

সবকিছুকে ছাপিয়ে এখন জোরদার হচ্ছে ইভিএম কারসাজির ভূমিকা। ইভিএম বাক্সে ভোট নেবার প্রচলন শুরু হবার পর থেকে গত দীর্ঘ প্রায় দু'দশকের মধ্যে ভোটগ্রহণের এই ইলেকট্রনিক যন্ত্র নিয়ে এমন লাগামছাড়া বিভ্রাটের ঘটনা গোটা দেশে আর কোথাও কখনোই ঘটেনি। ভোটের দিন সকালে ভোট শুরু হতেই একটার পর একটা কেন্দ্রে যেভাবে ইভিএম মেশিন বিগড়ানোর খবর আসতে থাকে তা সকলকেই বিস্মিত করে। রাজ্যের সাড়ে তিন হাজার বুথের মধ্যে ৫১৯টি ইভিএম মেশিন বিগড়ে যায়। ব্যাপক এই ইভিএম কেলেঙ্কারি নিয়ে ভোটের পর বামফ্রন্টের প্রতিনিধিরা দিল্লীতে নির্বাচন কমিশনের কাছে দেখা করে এসম্পর্কে গভীর তদন্তের দাবি জানান। বলাবাহুল্য নির্বাচন কমিশন সেই দাবিকে কোনো আমলই দেননি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভোট মেশিনে ব্যাপক হারে কারচুপি করা হয়েছিল এবং সেই কারচুপি করতে গিয়েই যান্ত্রিক পদ্ধতি সঠিকভাবে অবলম্বন না করতে পারার কারণে ব্যাপক সংখ্যাক ইভিএম মেশিন বিগড়ে যায়।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। ভোট গণানার আগে যা নেহাতই জল্পনা ছিল, ফল প্রকাশের পর দেখা ত্রিপুরায় সেই সব জল্পনাই সত্যি প্রমাণিত হল। ঐ রাজ্যের ভোট হওয়া ৫৯টি আসনের মধ্যে বেশির ভাগ আসনেই এগিয়ে আছে বিজেপি। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সরকারিভাবে ভোটের ফল প্রকাশ করা না হলেও গণনার প্রবণতাতেই স্পষ্ট, ত্রিপুরার লাল দুর্গ ঢেকে যেতে চলেছে। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি আসন এদিক-ওদিক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ সাত দশক পর ক্ষমতায় আসতে চলেছে বিজেপি। ত্রিপুরায় বিজেপি'র দাযিত্বপ্রাপ্ত রাম মাধব বলেছেন, "আজ বিকেলে বৈঠকে বসছে বিজেপি'র সংসদীয় দল। সেখানেই ঠিক হবে রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন।" উল্লেখ্য, গত বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্তও বিজেপি ভোট এই রাজ্যে ছিল মেরেকেটে দেড় থেকে দুই শতাংশ। এবারের নির্বাচনে সেই ভোট পৌঁছেছে ৪৪ শতাংশে। নির্বাচন কমিশনও মনে করছে ভারতের কোনো রাজ্যে ভোটবৃদ্ধির শতকরা হার এই পর্যায় পৌঁছায়নি। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পিছিয়ে রয়েছেন সিপিআই (এম)'র কাণ্ডারী মানিক সরকারও।

এক সময় ত্রিপুরায় বিজেপি'র সংগঠন তৈরির দায়িত্বে ছিলেন রাম মাধব। আজকের জযের পর প্রতিক্রিয়া দিতে গিযে তিনি বলেন, "এখনও পর্যন্ত যা ফলাফল, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। আমরাই সরকার গড়তে চলেছি। ৪০টির অনেক বেশি আসন নিয়েই সরকার গড়বে বিজেপি। এই জয় ঐতিহাসিক, বৈপব্লিক ত্রিপুরার মানুষকে অভিনন্দন। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ত্রিপুরাকে এগিয়ে নিযে যাবে বিজেপি।"

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, "নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে উত্তরপূর্ব ভারতের বিশ্বাস যে বাড়ছে তা আরো একবার প্রমাণিত হল ত্রিপুরার ফলে। নাগাল্যান্ড এবং মেঘালয়েও প্রভাব বিস্তার করেছে বিজেপি। অসম, মণিপুরের পর নাগাল্যান্ড এবং মেঘালয়েই গেরুয়া ঝড় বইবে।"

তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া মুকুল রায় বলেছেন, "আগেই নৈতিক জয় হয়ে গিয়েছিল। গত বছরও বিধানসভা নির্বাচনে ২ শতাংশ ভোট পেযেছিল বিজেপি। সেই ভোট এখনই ৪২ শতাংশ পেরিয়ে গিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং দলের সভাপতি অমিত শাহরা স্লোগান দিয়েছিলেন, "চলো পাল্টাই"। ত্রিপুরার মানুষ সেই স্লোগানে গলা মিলিয়েছেন, ভোট দিয়েছে বিজেপি'র প্রার্থীদের। নিশ্চিতভাবে এই ফলের প্রভাব পড়বে বাংলাতেও। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই বিজেপি'র প্রভাব দেখা যাবে।"

একই সঙ্গে তিনি কটাক্ষ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। তিনি বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ত্রিপুরায় বামেরা হেরে গেলে তিনি দুঃখ পাবেন। তাই বামেদের এই হারের দায় তাঁর ওপরেও বর্তায়"।

বিজেপি সূত্রের খবর, ত্রিপুরার পরবর্র্তী মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন বিপ্লব দেব। সে রাজ্যে তাঁর নেতৃত্বেই লড়েছিল বিজেপি।

মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার নিজেও বিপুল ভোটে পিছিয়ে রয়েছেন। সকালের দিকে কিছুটা লড়াই দিলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়ের গন্ধ পেয়ে যায় বিজেপি। আগরতলায় দলের অফিসে সাংবাদিকদের সামনে কোনো রাখঢাক না রেখেই উত্তরপূর্বে বিজেপি'র দাযিত্বপ্রাপ্ত রাম মাধব জানিয়ে দেন, ত্রিপুরাবাসীর এই রায় ঐতিহাসিক। প্রধানমন্ত্রীর পরিশ্রমের ফলেই এই ফল সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে অসমের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, এর ফলে দলের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল।

এই ভোটযুদ্ধে গেরুয়া শিবিরের নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লব দেব। যিনি বিজেপি'র রাজ্য সভাপতি। বিপুল জযের জন্য রাজ্যবাসীকে অভিনন্দন জানান তিনি। এই তরুণ নেতাই এগিযে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে। শেষ খবর পাওয়া অনুযায়ী ঐ রাজ্যে ৫৯টি আসনের মধ্যে ৪০টিরও বেশি আসনে এগিয়ে আছে বিজেপি। বামেদের আসন ১৬।

ত্রিপুরায় দীর্ঘ সময় বিরোধী আসনে থাকা কংগ্রেস যখন ভাঙতে শুরু করেছে তখন থেকেই ঐ রাজ্যে বিজেপি'র উত্থান। বাম-বিরোধীদের অধিকাংশ প্রথমে তৃণমূলে ভিড়লেও পরে গেরুয়া পতাকাই তুলে নেন সুদীপ রায়বর্মনরা। তখন থেকেই সিপিআই(এম) এর মাথাব্যথার কারণ বিজেপি। তৃণমূল স্তরে সঙ্ঘ পরিবার এবং সবস্তরের প্রচারে কোনো রকম খামতি রাখেননি অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদিরা। শুরু থেকেই ত্রিপুরা নিয়ে বিজেপি'র উদ্যোগ অন্যরকম ছিল। উত্তর পূর্বের বাকি রাজ্যগুলির জন্য এতটা আগ্রাসী ছিল না বিজেপি'র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ফলে জাতীয় রাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে ২টি লোকসভা আসনের ত্রিপুরা।