একুশের দেশে, ভাষার দেশে…

আশফাকুর রহমান
Published : 2 March 2018, 11:38 AM
Updated : 2 March 2018, 11:38 AM

যতদূর ছড়িয়েছে শহীদ মিনার, ততদূরই আমাদের দেশ। এ বাংলা থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এ স্মৃতির মিনারের দিকে আমরা ভোরের ফুটতে থাকা কমলা-হলুদ আলোয় হেঁটে হেঁটে মিলেমিশে যাই একে অপরের সাথে। এ মিনারকে ঘিরেই যে আমাদের একসাথে জড়ো হতে হয়। এ মিনার আমাদের ঐক্যের-প্রশান্তির বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার নিশানা। এ মিনারই দিয়েছে আমাদের দেশ।

দেশের ধারণা আজ বিশ্বায়নের বিচিত্র প্রভাবে বহুমাত্রিক। আর দেশের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে প্রকৃতি, ভূগোল, জমিন, ভাষা, জনজীবন আর সৃজনশীল ও চর্চিত জ্ঞান সৃষ্টির ঐতিহাসিক বয়ান। এ সম্পর্ক জন্ম থেকে জন্মান্তরের। না চাইলেও এ অর্জন আর অভিজ্ঞতা বহন করতে হয় মন থেকে শরীরে। কিংবা সেই চিহ্ন থেকে যায় ফেলে যাওয়া এক দেশ থেকে চলে আসা আরেক দেশে।

আসলে এ দেশ সেই দেশ, যে দেশের জন্ম হয়েছে রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায়, রক্তের অব্যক্ত ভাষায়। এ দেশের জন্ম দিতে প্রাণ দিয়েছেন নাম জানা, না জানা, চেনা-অচেনা লাখ লাখ মানুষ। যার শুরু মায়ের ভাষা রক্ষায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের মাধ্যমে। যে ভাষা রক্ষায় ঝরেছে রক্ত। উৎসর্গিত হয়েছে তাজা প্রাণ। রক্তে লাল হয়েছে বাংলার সুফলা ভূমি। বাংলা ভাষার টিকে থাকার এ লড়াই ৭০০ বছরের। এ ভাষাই জন্ম দিয়েছে একটি দেশের। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এ বাংলাদেশ নিয়ে লিখলেন এভাবে, 'ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা / তাহার মাঝে আছে দেশ- এক সকল দেশের সেরা; / ও সে, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে-দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা; / এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, / সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি'। দেশের সাথে এ সম্পর্ক প্রতিদিনের, অনিবার্য, জন্মান্তরের বাঁধনে বাঁধা। এ নিয়তি সবার জন্যই এক-অদ্বিতীয়, শুধু বার বার নতুন করে আবিষ্কার করা। এ হয়তো আবেগের কথা। এ আবেগ আছে বলেই ফিরতে হয় আমাদের। ফিরতে হয় দেশের কাছে। নিঃশ্বাস নিতে হয় প্রাণভরে এই মাটি-পানি-হাওয়ার দেশে।

কিন্তু এ কোন দেশ? কার দেশে যাই আমরা? বা কার দেশেই আমরা ফিরে আসি? জন্মের দেশ, থাকার দেশ, যাওয়ার দেশ, পরের দেশ, প্রাণের দেশ, কল্পনার দেশ, স্বপ্নের দেশ- এভাবে আর কত কত দেশের কথাই না বলা যায়।

কিন্তু কোথায় আমার দেশ, আমাদের দেশ? এ দেশ কী সেই দেশ, যে দেশে আছে মায়ের ভাষা- আছে প্রাণ জুড়ানোর ভাষা। এ দেশ তো একুশের। এ ভাষার দেশ। এ দেশেই তো আমাদের ফিরে আসতে হয়। এমন সত্যের মুখোমুখি হয়েই ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত মার্তিনিকে জন্ম নেওয়া কবি এমে সেজায়ার 'দেশে ফেরার খাতা'য় ক্রেয়ল ভাষায় লিখেছেন, 'ছেড়ে যেতে হবে। নাছোড় বদান্যতায় আমার মন বিবৃত হয়েছিল। ছেড়ে যেতে হবে… পৌঁছতে চাই গিয়ে সেই দেশে, আমার দেশে, নমনীয় আর তরুণ, বলতে চাই সেই দেশকে যার মৃত্তিকায় গড়া আমার শরীর: অনেক দিন ছেড়েছিলুম তোমাকে, এখন ফিরে আসছি তোমরা নিঃসঙ্গ দগদগে ঘাগুলোয়। / ফিরে আসতে চাই সেই দেশে, আমার দেশে, আর তাকে বলতে চাই:'ভয় পেয়ো না, জড়িয়ে ধরো আমায়… আর, যদি নাও জানি কী বলতে হবে, তবু শুধু তোমার জন্যই আমি কথা বলি' (ভাষান্তর:দেবলীনা ঘোষ ও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)। এভাবেই আমাদের প্রত্যেকের দেশে ফিরতে হয় বেঁচে থাকতে। ফিরতে হয় সেই ঘরে, যে ঘরের দেয়াল ধরে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শিখেছি, বলেছি হাত-পা ছুড়ে নিজের মতো করে, ঘুমিয়েছি মাটির বিছানায়, ছয় ঋতুর দেশের আলো-ছায়ার পাঠ নিয়েছি।

এভাবেই বৈশাখ হয়ে চৈত্র মাস আসে। জানুয়ারি হয়ে ডিসেম্বর দিয়ে শেষ হয় এক একটা বছর। যদিও ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে চললেও এখন বইছে হিম হাওয়া। মার্চ মাসের আছি অপেক্ষায়, আমাদের মুক্তির কথা বলতে, স্বাধীনতার ডাক শুনতে। যদিও আজকের দিনের পর থেকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে কোনো কথা বলব না, করব না মায়ের ভাষা নিয়ে কোনো চিন্তা। সুযোগ পেলেও বলব না মায়ের ভাষায় কোনো কথা, করব না কারো সাথে প্রাণের আলাপ। আবার বছর ঘুরে ফাল্গুনে রাষ্ট্রভাষার ইতিহাস মেনে ২১শে ফ্রেব্রুয়ারিতে শহীদ দিবস স্মরণ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করতে গিয়ে ক্ষোভের সাথে বলবো, কেন এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি, কেন এখনো আদালতের ভাষা বাংলা নয়, কেন মায়ের ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করা যাবে না অথবা করা যাবে না কোন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। কিংবা বলব না, কেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ভাষা রক্ষায় যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

এভাবে এক ফাল্গুন যাবে, আসবে আগুন লাগিয়ে দেয়া আরেক ফাল্গুন; এভাবে হয়তো একদিন জানব একসময় আমাদের ছিল মায়ের ভাষা বাংলা। তারপরও আমরা চাইব মায়ের ভাষায় কথা বলতে।

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ৭০৯৭টি ভাষার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। এর মধ্যে আগামী শতাব্দীতে তিন হাজার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন গবেষকরা। আবার জানা যাচ্ছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ১৫টি ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান অষ্টম। সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য, ইন্টারনেটে সার্চ ইঞ্জিন গুগলে বহুভাষিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১০৩টি ভাষায় লেখা, বক্তৃতা ইত্যাদি অনুবাদ সম্ভব করে তুলেছে। অন্যদিকে এঙ্কো মডেল অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের বিশ্বে মুখের ভাষার শীর্ষ তালিকায় থাকবে যথাক্রমে মান্ডারিন, ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি-উর্দু ও আরবি।

আবার মানুষের বহুভাষিক বিশ্বে বাস করার কথা জানিয়ে ইউনেস্কো বলছে, বর্তমান বিশ্বে শিশুসহ ৪০ ভাগ মানুষ যে ভাষা বুঝে বা কথা বলে সেই ভাষায় অংশগ্রহণ ও শিক্ষাগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইউনেস্কো এ কথাও বলছে, বেশিরভাগ শিক্ষাব্যবস্থা বহুভাষিক ধারণাকে উপেক্ষা করছে। অন্য এক সাম্প্রতিক গবেষণা তথ্য অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, বিশ্বে দ্বি-ভাষিক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ ও রাশিয়ান দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি লক্ষণীয়। আবার এ চিত্রও স্পষ্ট, দেশে বা অঞ্চলভেদে না চাইলেও একেক ভূ-খণ্ডে নানা ভাষার সংস্পর্শে মানুষকে আসতে হচ্ছে। সেই ভাষা ও সেই ভাষার সংস্কৃতির অভিজ্ঞতার ছাপও পড়ছে যার যার জীবনে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার কথা তো বলাই যায়। অনেকে এ বাস্তবতাকে আগ্রাসন হিসেবে দেখবেন। এর ফলে স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে এ দেশের মানুষের বিচ্যুত হওয়ার কথা বলবেন। অনেকে বলবেন, অতীতের অভিজ্ঞতার মতো অন্য ভাষার সংস্পর্শে বাংলা ভাষা নিজ শক্তিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে।

ভাষা যেমন মানুষের জীবিকার উপায়, জ্ঞান-ঐতিহ্যের ধারক, তেমনি আগামীর জীবনী শক্তি সৃষ্টির উপায়ও। এমন কথা শুনে অনেকে বলবেন, মাতৃভাষাকে আঁকড়ে থাকার কারণে সাম্প্রতিক বিশ্বের গতি-প্রকৃতি থেকে নিজেকে পিছিয়ে রাখা যায় না। মাতৃভাষা নিয়ে এমন সব বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের প্রতিনিয়ত। আবার এটাও সত্য, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমাদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি।

রাষ্ট্রের জন্য ভাষার দরকার আছে- এমন চিন্তা সেই সময়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অধীনে থেকে পূর্ব-বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া আজও এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। ভাষাসংগ্রামী ও বাংলাদেশের চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেছেনই, 'রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন ছিল আমাদের অস্তিত্বের লড়াই।' রাষ্ট্র গঠনের জন্য ভাষার প্রয়োজনীয়তা ৬৬ বছর আগে চোখে আঙুল দিয়ে, প্রাণ বিসর্জন দিয়ে রক্তস্নাত হয়ে আমরা দেখিয়েছিলাম। সেই দেখানো পথে বাঙালিরা বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। তাহলে কি বাংলা ভাষাকে আমাদের উপেক্ষা করার কোন সুযোগ আছে?

২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ইউনেস্কোর আহ্বান ছিল, 'বহু ভাষার শিক্ষার মাধ্যমেই টেকসই ভবিষ্যৎ'। যদিও প্রথম ভাষা হিসেবে শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে মায়ের ভাষা ও ঘরের ভাষার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এ আহ্বানে। এরপর দ্বিতীয় ভাষায় শিক্ষা নতুন জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতায় একজন মানুষ হয়ে উঠবে এক সঙ্গেই বৈশ্বিক ও লৌকিক। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক নাগরিক হওয়ার পথ রচনা করা হবে সম্ভব বলে ইউনেস্কো ওই আহ্বানে প্রত্যাশা করেছে। অবশ্য ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষিক পৃথিবীর ডাক দিয়েছে ইউনেস্কো। এসডিজি-২০৩০-এর কৌশলপত্রে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষায় শিক্ষাগ্রহণের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। ইউনেস্কো ভাষাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে আগামীর টেকসই পৃথিবী গড়ার কথাও বলেছে।

কে করবে এ কাজ? মানুষকেই গড়তে হবে আগামীর এ পৃথিবী। এ একক পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষায় এক ভূগোলের সাথে আরেক ভূগোলের জ্ঞান ও সংস্কৃতির এ নেয়া-দেয়া আর মানুষের বিশ্বব্যাপী যাত্রা এক স্বাভাবিক রীতি, চলমান বিষয়। এ প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেয়ার নেই কোনো উপায়। বিশ্বায়নের জোয়ারে বা স্থানীয় শক্তির প্রতি আস্থা- কোনো কিছুই এ বিস্তারকে রুদ্ধ করে রাখতে পারে না, সুযোগও নেই। ঠিক যে কারণে ১৩ শতকের পারস্যের কবি জালাউদ্দিন রুমির লেখা আজকের যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পড়া হয়। রুমির কবিতার অনুপ্রেরণা, প্রশস্তি আর মরমীভাব যুক্তরাষ্ট্রের বহু বিখ্যাত মানুষের জীবনকে করছে পরিবর্তিত, আধ্যাত্মিক জাগরণকে করেছে সমৃদ্ধ।

ফার্সি ভাষায় লেখা রুমির কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদের কারণে এ সংযোগ সম্ভব হয়েছে। রুমির কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে দুই সংস্কৃতির যোগসূত্র ধরে ইরাকি কবি ও অনুবাদক সিনান অ্যান্তন বলেন, 'ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়। ভাষা স্মৃতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের জলাধার'। সুফি সাধক জালাউদ্দিন রুমির ফার্সিতে লেখা 'মাসনাভি'র অনুবাদক আফগানিস্তানে জন্ম নেওয়া রুমি বিশেষজ্ঞ জাইদ মুজাদ্দেদি ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের ভাষার প্রতি ঋণ স্বীকার করে বলেছেন, 'সবকিছুর একটি আকার আছে, সবকিছুর একটি সংস্কৃতি ও ইতিহাস আছে।'

ভাষা আসলে তাই যার ভেতর দিয়ে এক স্থানের অর্জন অন্য স্থানের মানবজীবনকে প্রসারিত করে তোলে। নিভৃতে নির্জনে পাওয়া এমন অভিজ্ঞতা সবসময় ভাষায় প্রকাশও অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভাষা আরো গভীরের বিষয়, রক্তে আর প্রাণে থাকা ভালোবাসার অহংকার। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার হাতিয়ার। ভাষা কীভাবে জীবিত রাখে মানুষকে, কীভাবে নিয়ে যায় চিনিয়ে দেয় মূলকে সেই কথা বলেছেন ইটালিয়ান দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও কথাসাহিত্যিক উমবার্তো একো। দ্য প্যারিস রিভিউয়ে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'আমার আঞ্চলিক কথ্য ভাষা ছিল আলেসান্দ্রিনো। কিন্তু আমি এ ভাষায় কথা বলতাম না। কারণ আমার পরিবার ছিল পেটি বুর্জোয়া এবং আমার বাবা মনে করতেন আমার ও আমার বোনের উচিত শুধু ইটালিয়ান ভাষায় কথা বলা। অবশ্য নিজেদের মধ্যে মা-বাবা আলেসান্দ্রিনোতেই কথা বলতেন। তাই আমি এটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারতাম কিন্তু বলতে পারতাম না। অর্ধশতক পরে আলেসান্দ্রিয়ায় পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর হঠাৎই বুঝতে পারলাম আমি অনর্গল আলেসান্দ্রিনো বলতে পারছি! জানি না আমার পেটের মধ্যে, নাকি অবচেতন মনে আলেসান্দ্রিনো লুকিয়ে ছিল। সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি একদিকে যেমন ভুলে যাওয়া কথা মনে করতে পারছি, তেমন কিছুও মনে পড়ছে, যা আমি কখনো শিখেছি বলে মনে হয়নি।' (ভাষান্তর: শানজিদ অর্ণব)

ভাষা তাহলে এমনই সর্বগ্রাসী যাকে আসলে চিনে নিতে হয় না। ভাষার প্রাণ থাকে রক্তে, প্রতিটির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। ভাষায় মানুষকে করে তোলে আত্মমর্যাদাশীল। নিজের কাছে ফিরে আসার রাস্তা। এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে রাষ্ট্রভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা বাঙালি ঐতিহ্যের অংশ। জাতিগত চেতনার ভেতর দিয়ে একুশের দেশের জন্ম হয়েছে। এ দেশ শুধু একুশের নয়, এ দেশ ভাষারও। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এমন দাবি শুধু আমরাই করতে পারি। একুশের অর্জন আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে যোগ করেছে অনন্য অবদান করেছে সমৃদ্ধ। এই গৌরব আমাদের, একইভাবে বিশ্বের সব মানুষের। একাধিপত্যের এ বর্তমান বিশ্বে আমাদের এ অর্জন আর ত্যাগের কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং শক্তভাবে ভিত গড়ার জমিন নিজেদের নির্মাণ করতে হবে। আত্মমর্যাদার রক্ষার এ যুদ্ধ যে আমাদেরই করতে হবে। এ যুদ্ধ রক্তে রাঙানো একুশের জন্য যুদ্ধ।

'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কী ভুলিতে পারি'। আমি, আপনি ও আমরা আজকের দিনে কী ভুলব আর কী ভুলব না- এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কী আমাদের কাছে আছে? কিন্তু মনে রাখার অধিকার নিশ্চয়ই আছে আমাদের। একুশের দেশ এ অধিকারের কথাই বলে।